• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হদিস মিলছে না ‘তালিকাভুক্ত’ নিখোঁজদের


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ১৫, ২০১৭, ১০:৫৩ পিএম
হদিস মিলছে না ‘তালিকাভুক্ত’ নিখোঁজদের

ঢাকা: গেল বছর গুলশান ও শোলাকিয়া ট্র্যাজেডির পর সারাদেশে ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তিদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নিখোঁজদের একাধিক তালিকাও প্রকাশ করে অনুসন্ধানে নামে র‌্যাব-পুলিশ।

কিন্তু দিন যত পেরিয়েছে অনুসন্ধান ততই ঝিমিয়ে পড়েছে। দীর্ঘ আট মাস পেরিয়ে গেলেও নিখোঁজ সেসব ব্যক্তির বিষয়ে কোনো হদিস দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরই মধ্যে নিখোঁজদের তালিকা আরো দীর্ঘ হচ্ছে।

গত ডিসেম্বরে রাজধানী থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থীসহ সাত তরুণের ‘লাপাত্তা’ হয়ে যাওয়ার ঘটনায় নতুন করে উদ্বেগ ও আতঙ্কের সৃষ্টি করে। র‌্যাব-পুলিশ নিখোঁজ শতাধিক তরুণের তালিকা দিলেও তাদের কতজন জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই তাদের কাছে।

পরবর্তী সময়ে কতজন নিখোঁজ হয়েছেন তারও কোনো হিসাব নেই গোয়েন্দাদের কাছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, কেউ নিখোঁজ হওয়ার পর তথ্য না জানালে ব্যবস্থা নেয়া হবে অভিভাবকের বিরুদ্ধেও।

গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় অংশ নেয়া পাঁচজনই দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। এ ঘটনার পর নিখোঁজদের বিষয়ে নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নিখোঁজদের পরিবারের পক্ষ থেকেও র‌্যাব-পুলিশকে অবহিত করা হয়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা তৎপরতার পরেও শিক্ষার্থী ও তরুণদের জঙ্গিবাদে নিয়োগ প্রক্রিয়া থেমে নেই।

তবে প্রথম দিকে নিখোঁজ সন্তানদের বিষয়ে পুলিশকে তথ্য দিলেও এখন বেশির ভাগ অভিভাবকই তথ্য আড়ালের চেষ্টা করছেন। তারা জানাতে চান না তাদের সন্তান নিখোঁজ। এর কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে, নিখোঁজ সন্তান জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছে-এমন তথ্য পরিচিতজনদের কাছে গেলে তাদের সম্মানহানির ঝুঁকি থাকছে। আর তাই সন্তান নিখোঁজের বিষয়টি পুলিশকে জানাতে চাইছেন না তারা।

তবে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অভিভাবকরা নিখোঁজ সন্তানদের তথ্য না দিলে তাদের বিরুদ্ধেও জঙ্গিবাদে মদদ দেয়ার অভিযোগ আনা হবে। এ বিষয়ে শিগগিরই একটি নির্দেশনা দেবে পুলিশ সদর দপ্তর। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটির অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন বলেন, এ রকম একটা সিদ্ধান্তের কথা তিনি শুনেছেন। ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা বিষয়টি চূড়ান্ত করবেন।

আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, নিখোঁজদের অনেকেই ফিরে এসেছে। বাকিদের খোঁজা হচ্ছে। জঙ্গি কার্যক্রমে থেকেও অনেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে। ভুল পথ ভেবে তারা ফিরে এসেছে। যারা এখন জঙ্গি কার্যক্রম চালাচ্ছে তারাও ফিরে আসবে বলে আশাবাদী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

এদিকে গেল বছরের ২০ জুলাই সারা দেশে নিখোঁজ ২৬১ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করে র‌্যাব। পরবর্তীতে ২৫ জুলাই এই তালিকা সংশোধন করে ৬২ জনের এবং সর্বশেষ ৯ আগস্ট নিখোঁজ ৭০ জনের তালিকা প্রকাশ করে র‌্যাব। তবে এখন পর্যন্ত ‘তালিকাভুক্ত’ কারোর-ই সন্ধান দিতে পারেনি আইন প্রয়োগকারী কোনো সংস্থা।

এ বিষয়ে র‌্যাবের সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) এএসপি মিজানুর রহমান ভূঁইয়া জানান, নিখোঁজদের সন্ধানে কাজ থেমে আছে বলা যাবে না। নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা ছাড়াও নিয়মিত অনেক কাজও করতে হয় র‌্যাবকে।

সূত্র জানায়, নিখোঁজ তালিকার মধ্যে ১৯ জন জঙ্গিবাদে জড়িয়ে দেশের বাইরে আছেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে। এর বাইরে ওই তালিকায় থাকা বেশ কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হন। ১০ জন জীবিকার সন্ধানে অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন। আবার কয়েকজন মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে দীর্ঘদিন থাইল্যান্ডের কারাগারে ছিলেন, পরে দেশে ফিরেছেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা জানান, তরুণদের রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়া এখন অনেক কমলেও ঠিকমতো তথ্য মিলছে না। সম্প্রতি কয়েকজন তরুণের জঙ্গিবাদে যুক্ত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে, যারা কয়েক মাস আগে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়েছেন। তবে এই তরুণদের কয়েকজনের অভিভাবকরা বিষয়টি চেপে রেখেছিলেন। পুলিশকে তাদের সন্তান নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি জানাননি এসব অভিভাবক।

ধারণা করা হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভয়ে বা সামাজিক কারণে তারা এমনটি করছেন। এতে কাজ করতে খুব সমস্যায় পড়তে হচ্ছে কর্মকর্তাদের। কতজন নিখোঁজ হয়েছেন, এ ধারণাটা ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের খোঁজে বের করাও কঠিন হচ্ছে। এই কর্মকর্তা আরো বলেন, একজন নিখোঁজ হওয়ার তথ্য পেলে তার পরিবার, বন্ধু, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইত্যাদি ঘেঁটে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। এসব তথ্য ওই তরুণকে আটক কিংবা খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। কিন্তু অভিভাবকরা তথ্য না দিলে তো সমস্যা।

এ কারণে তারা এখন অভিভাবকদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের দুজন কর্মকর্তা। তারা বলেন, যদি কোনো তরুণ নিখোঁজ হওয়ার পর তার অভিভাবক পুলিশকে ইচ্ছাকৃতভাবে অবহিত না করেন এবং পরে সেই তরুণটির সঙ্গে জঙ্গিবাদ-সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়, এমন ক্ষেত্রে সেসব অভিভাবকের বিরুদ্ধেও জঙ্গিবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগ আনা হবে।

সম্প্রতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ অর্ধশতাধিক তরুণ নিখোঁজ হওয়ার পর তারা কোথায় অবস্থান করছে তা এখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিশ্চিত করতে পারেননি। গত বছর নিখোঁজদের কয়েকজন বাড়ি ফিরেছেন। এমনকি র‌্যাবের কাছে কয়েকজন জঙ্গি আত্মসমর্পণও করেন। তবে তারা কোথায় কীভাবে এই পথে পা বাড়িয়ে তার সঠিক তথ্য নেই পরিবার কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাছে।

এ বিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, তালিকায় যাদের নাম আছে, তারা সবাই জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত না-ও থাকতে পারেন। তবে এই তালিকায় থাকা ৪০-৫০ জনের বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অকাট্য প্রমাণ আছে র‌্যাবের কাছে। নিখোঁজ এসব ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে কাজ করছে র্যাব।

গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার পর সামনে আসে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জঙ্গিবাদে জড়ানোর তথ্য। পরিবার থেকে পালিয়ে অনেক তরুণের জঙ্গি তৎপরতায় জড়ানোর তথ্য পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয় ৪০ জন নিখোঁজের তালিকা। অন্যদিকে র‌্যাব প্রথমে ২৬২ জনের তালিকা দিলেও পরে সংশোধন করে ৬৮ জনের নাম প্রকাশ করে বাহিনীটি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের মুখে জঙ্গি তৎপরতার পাশাপাশি নিখোঁজ হওয়ার প্রবণতাও কমতে থাকে। তবে গেল ১ ডিসেম্বর হঠাৎ করেই রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন চার তরুণ। এরপর ৫ ডিসেম্বর বনানী থেকেই নিখোঁজ হন আরেক যুবক। এতে আবারও সামনে এসেছে তরুণদের নিখোঁজের বিষয়টি। তিন মাস পেরিয়ে গেলেও নিখোঁজ পাঁচ যুবককে খুঁজে বের করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের দাবি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এসব ঘটনার তদন্ত চলছে।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকজন তরুণ নিখোঁজ হলেও এ বিষয়ে তথ্য দিচ্ছে না অনেকের পরিবার। এসব ক্ষেত্রে তথ্য গোপনকারী অভিভাবকের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করা প্রতিটি অভিভাবকের নাগরিক দায়িত্ব বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লষকরা। নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঠেকাতে সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের আরো মনোযোগী ও যত্নবান হওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/আকন

Wordbridge School
Link copied!