• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হাওয়া বদল হাওয়াখানার, উন্মুক্ত হয়নি এখনও


ইলিয়াস আরাফাত নভেম্বর ১৫, ২০১৬, ০৫:৩২ পিএম
হাওয়া বদল হাওয়াখানার, উন্মুক্ত হয়নি এখনও

রাজশাহী: পুঠিয়ার ঐতিহ্যবাহী সেই হাওয়াখানার হাওয়া বদলে গেছে। অযত্ম অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসা ভবনটির সংস্কার হয়েছে। হাওয়াখানা ভবনে প্রবেশের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে রাস্তা। তবে আজও সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়নি ভবনটি।  

রাজশাহীর পুঠিয়া রাজপ্রাসাদ থেকে ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে ও নাটোর-রাজশাহী মাহাসড়কের তারাপুর বাজার থেকে ৫০০ গজ দক্ষিণে তারাপুর গ্রামের একটি দীঘিতে এ হাওয়াখানা অবস্থিত। চুন সুরকি আর পাতলা ইটের গাঁথুনি দিয়ে নির্মিত বিলাসবহুল এ ভবন। হাওয়াখানার দরজা জানালাবিহীন প্রথম তলা পানির নিচে থাকে। দ্বিতীয় তলার পশ্চিম দেয়ালে একটি ও অন্য তিন দিকে তিনটি করে মোট ১০টি দরজা। দীঘিটি দশ একর আয়তনের। ঠিক মাঝ খানে ৪৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪২ ফুট প্রস্থ একটি ভবন। ভবনটির উচ্চতা ৩৪ ফুট। 

ভবনের চার পাশে আছে ৬ ফুট চওড়া বারান্দা। তৃতীয় তলায় ওঠার জন্য আছে ৩ ফুট চওড়া একটি সিড়ি। তৃতীয় তলার পশ্চিম দেয়ালে কোন দরজা নেই, আছে বাকী তিন পাশে তিনটি ফাঁকা দরজা। এর চারপাশে আছে রেলিংসহ ৬ ফুট চওড়া বারান্দা। প্রথম তলায় আছে ১০০ বর্গফুটের বর্গাকৃতির একটি স্নানাগার। এছাড়া স্নানাগারের পূর্বপাশে ছিল প্রায় ৪৫০ বর্গফুট আয়তনাকার জলঘর, বর্তমানে এটি মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। স্নানাগারের আর জলঘরে পানি প্রবেশের জন্য আছে চার পাশে ৭টি করে ফুকার বা প্রবেশ পথ।

রাজ কার্য চালাতে গিয়ে রাজারা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়তেন, তখন বিনোদনের জন্য প্রকৃতির নির্মল বাতাসে প্রাণ ভরে নেয়ার জন্য হাওয়াখানায় ছুটে আসতেন তারা। ভবনটির নাম হাওয়াখানা। 

অনেক বছর ধরে অযত্ন-অবহেলায় থাকার ফলে কালের গহবরে হারিয়ে যেতে বসেছিল ভবনটি। বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে এসে ভবনটি সংস্কারের উদ্দ্যোগ নেয়। 
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের রির্চাজ এসিস্ট্যন্ড কাস্টরিয়ান শাওলি তালুকদার জানায়, বর্তমানে ভবনটির সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে। ভবনটির সংস্কারে ব্যয় হয়েছে ২২ লাখ টাকা এবং হাওয়াখানা ভবনে প্রবেশের জন্য নির্মিত রাস্তার ব্যয় হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। তবে এখনও সর্বসাধারণের জন্য ভবনটি উন্মুক্ত করা হয়নি।

ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, জলঘরে খাবার ছিটিয়ে রাজা বাহাদুর দিঘির মাছ দেখতেন। বিকেল বেলা স্নিগ্ধ হাওয়ার পরশ নিতে রাজা বাহাদুর ঘোড়ায় চেপে দিঘির পাড়ে গিয়ে ডিঙি নৌকায় চড়ে দীঘির কাজল কালো জলে ভাসতে ভাসতে হাওয়াখানা ভবনে গিয়ে উঠতেন। আবার কোন কোন সময় ডিঙি নৌকায় চড়ে পুরো দীঘি ঘুরে বেড়াতেন।

হাওয়াখানা পুঠিয়া রাজবংশের কোন রাজার তৈরি তা জানা না গেলেও রাজা নরেশ নারায়ণ রায় ভবনটি সর্বশেষ ব্যবহারকারী রাজা ছিলেন। দেশ বিভাগের সময় রাজা নরেশ নারায়ণ রায় বাংলাদেশ ছেড়ে কলকাতায় যাবার সময় গনী মল ও দেলজার মল নামে দুই কর্মচারিকে হাওয়াখানা দিঘিটি পত্তন দিয়ে যান। ফলে দিঘির মাঝামাঝি বাঁধ দিয়ে ভাগাভাগি করা হয়। বর্তমানে দিঘির পশ্চিম পাশের বাঁধের ওপর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন পথ।

পুঠিয়া রাজবংশের ইতিহাস: পুঠিয়া রাজবংশ মুঘল সম্রাট আকবর এর সময় (১৫৫৬-১৬০৫) প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় পুঠিয়া লস্করপুর পরগনার অন্তগত ছিল। ১৫৭৬ সালে মুঘল সম্রাট আকবর এর সুবেদার মানসিংহ বাংলা দখল করার সময় পুঠিয়া এলাকার আফগান জায়গীরদার লস্কর খানের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে পুঠিয়া রাজবংশের প্রথম পুরুষ বৎসাচার্য যিনি পুঠিয়ায় একটি আশ্রম পরিচালনা করতেন, তিনি মানসিংহকে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করায় লস্কর খান পরাজিত হন। এ জন্য মানসিংহ বৎসাচার্যকে পুঠিয়া এলাকার জমিদারি দান করেন। বৎসাচার্য জমিদারি নিজ নামে না নিয়ে তার পুত্র পীতম্বরের নামে বন্দোবস্ত নেন।

পীতম্বর জমিদারির আয়তন বৃদ্ধি করেন। পীতম্বর নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে তার সহোদর নীলাম্বর জমিদারিপ্রাপ্ত হন। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাকে রাজা উপাধি দান করেন। নীলাম্বর এর মৃত্যুর পর পুত্র আনন্দরাম সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। আনন্দরামের একমাত্র পুত্র রতিকান্তের জ্যেষ্ঠ ছেলে রামচন্দ্র সকল সম্পত্তির মালিক হন। রামচন্দ্রের দ্বিতীয় ছেলে নরনারায়নের পর তার একমাত্র ছেলে প্রেমনারায়ন রাজ্যাধিকার পান। প্রেমনারায়নের ছেলে অনুপনারায়ণ এর সময় পুঠিয়া জমিদারীটি বার্ষিক ১,২৫,৫১৬ টাকা খাজনায় মুর্শিদকুলী খানের সঙ্গে বন্দোবস্ত হয়। 
অনুপনারায়ণের চারপুত্র (নরেন্দ্র, মেদ নারায়ন, রূপ নারায়ণ ও প্রাণ নারায়ণ) এর মধ্যে ১৭৪৪ সালে রাজ স্টেট বিভক্ত হয়। বড় ভাই নরেন্দ্র নারায়ণের অংশে পাঁচ আনা এবং ছোট তিন ভাই এর অংশে সাড়ে তিন আনা নির্ধারিত হয়। বড় ভাই নরেন্দ্র নারায়ণের অংশ পাঁচ আনি এস্টেট এবং রূপ নারায়ণের অংশ চার আনি এস্টেট নামে পরিচিত। নরেন্দ্র নারয়নের জ্যেষ্ঠ ছেলে ভুবেন্দ্রনাথ ১৮০৯ সালে রাজা বাহাদুর উপাধি লাভ করেন।

ভুবেন্দ্রনারায়ণের একমাত্র ছেলে জগন্নারায়ণ রায়ের দ্বিতীয় স্ত্রী ভুবনময়ী হরেন্দ্রনারায়ণকে দত্তক নেন। রাজা হরেন্দ্রনারায়নের ছেলে যোগেন্দ্রনারায়ণ মৃত্যুর পূর্বে সকল সম্পত্তি স্ত্রী শরৎসুন্দরীর নামে দিয়ে যান। শরৎসুন্দরী ১৮৬৬ সালে রাজশাহীর গুনাইপাড়ার কেশবকান্ত চক্রবতীর ছেলে রজনীকান্তকে দত্তক নিয়ে নাম দেন যতীন্দ্রনারায়ণ। শরৎসুন্দরী শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে প্রচুর দান করতেন। তার অজস্র দান ও নিঃস্বার্থ জনসেবায় মুগ্ধ হয়ে ১৮৭৪ সালে বৃটিশ সরকার তাকে “রানী” উপাধিতে এবং পরবর্তিতে ১৮৭৭ সালে “মহারানী” উপাধিতে ভূষিত করেন। কুমার যতীন্দ্রনারায়ণ ১৮৮০ সালে ঢাকা জেলার ভূবনমোহন রায়ের কন্যা হোমন্তকুমারী দেবীকে বিয়ে করেন। হোমন্তকুমারী দেবী ১৫ বছর বয়সে ৬ মাসের সন্তান গর্ভে নিয়ে বিধবা হন। তিনি পুঠিয়ার বিরাট রাজ প্রাসাদটি নির্মাণকরে শাশুড়ী মহারানী শরৎসুন্দরী দেবীর শ্রদ্ধায় উৎসর্গ করেন। হেমন্তকুমারী দেবী বহুসংখ্যক সৎকাজের জন্য লর্ড কার্জন কর্তৃক ১৯০১ সালে “রানী” এবং ১৯২০ সালে লর্ড আরউইনের আমলে “মহারানী” উপাধিতে ভূষিত হন। তার মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে সারাদেশে জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে গণজাগরণ ঘটলে ক্রমান্বয়ে পুঠিয়া রাজবংশেরও বিলোপ ঘটে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমএইচএম

Wordbridge School
Link copied!