• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
ন্যায্য মূল্য বঞ্চিত চাষি

হাতবদলেই বাড়ে সবজির দাম


নরসিংদী প্রতিনিধি জানুয়ারি ১৫, ২০১৭, ০৬:৪৯ পিএম
হাতবদলেই বাড়ে সবজির দাম

নরসিংদী: সবজি চাষের জন্য বিখ্যাত নরসিংদী অঞ্চল। প্রায় দুই মাস আগে থেকেই এখানকার বিভিন্ন হাট বাজারে শীতকালীন সবজি আসতে শুরু করছে। অন্যদিকে নতুন করে সবজি চাষে পুরোদমে ব্যস্ত রয়েছেন কৃষকরা।

তবে এ জেলার কৃষকরা প্রতিনিয়তই পাইকারি বাজারের মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। যার ফলে হাতবদলে বাড়ে সবজির দাম। কৃষকের ক্ষেত থেকে সবজি যায় পাইকারি বাজারে, পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজারে সবজির দামের ব্যবধান হয় আকাশ-পাতাল। কৃষক পর্যায় থেকে পাইকারি বাজারে দাম বেড়ে যাচ্ছে দ্বিগুণ, আর খুচরা বাজার থেকে ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে তা তিনগুণ দামে।

কৃষকদের অভিযোগ ন্যায্যমূল্যে শাক-সবজি বিক্রি করতে না পারায় তাদের লোকসান গুণতে হচ্ছে প্রতি মৌসুমেই। তবে যুগ যুগ ধরে এই অবস্থা চলে এলেও কৃষকের ভাগ্যের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। শীত বা গ্রীষ্মকালীন আগাম সবজির ক্ষেত্রে কৃষক কিছুটা বাড়তি মূল্য পেয়ে থাকলেও খুচরা পর্যায়ে এসব পণ্যের যে দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে তার তিন ভাগের এক ভাগও পান না কৃষকরা।

নরসিংদী জেলায় সবচেয়ে বেশি সবজি চাষ হয়- শিবপুর, পলাশ, বেলাব, মনোহরদী ও রায়পুরা উপজেলায়। এসব উপজেলায় বেগুন, করলা, সিম, শসা, বরবটি, চিচিংগা, ঝিঙা, চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, লালশাক, ডাটাশাক, কচু, আলু, ঢেঁড়স, পেঁপে, মূলা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটু, লাউ ও মরিচসহ বিভিন্ন প্রকারের সবজি চাষ হয়।

উৎপাদিত সবজি বেলাব উপজেলার বারৈচা ও নারায়ণপুর, রায়পুরা উপজেলার জঙ্গি শিবপুর ও মরজাল, শিবপুর উপজেলার শিবপুর, পালপাড়া, গাঙ্গুলপাড়া, যোশর, সৃষ্টিগড় ও কোন্দারপাড়া বাজারে বিক্রি করে থাকেন কৃষকরা। ভরা মৌসুমে পাইকারি ক্রেতারা স্থানীয় বিভিন্ন বাজার থেকে প্রতিদিন অন্তত ৫০/৬০ ট্রাক শাক-সবজি কিনে রাজধানী ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও সিলেট জেলায় পাঠাচ্ছেন।

নরসিংদীর শাক-সবজি এসব জেলার মানুষের চাহিদার প্রায় ৪০ ভাগই পূরণ করে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর পাইকারি সবজি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, হাটের দিন আশপাশের গ্রাম থেকে সবজিচাষিরা ভ্যান ও রিকশায় করে বিভিন্ন ধরনের সবজি নিয়ে আসছেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে ক্রেতা ও বিক্রেতার সংখ্যা বাড়তে থাকে।

এ বাজারে কথা হয় সবজিচাষি মরজাল গ্রামের হাসেন আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, পাইকারি ক্রেতারা স্থানীয় দালালদের সঙ্গে হাট বসার আগেই আলোচনা করে একটা দাম ঠিক করে নেন। সেই দামেই পাইকাররা বাজার থেকে সবজি কিনেন। সিন্ডিকেটের কারণে শেষ পর্যন্ত লোকসান দিয়েই সবজি বিক্রি করতে হয়।

তিনি আরো বলেন, আমরা কৃষক মাথার গাম পায়ে ফেলে কষ্ট করে সবজিব উৎপাদন করি ঠিকই কিন্তু বাজারে সঠিক দাম আমরা পাই না।

বেলাব উপজেলার হোসেন নগর গ্রামের কৃষক আবু সাদেক বলেন, সার ও কীটনাশকের দাম আকাশছোঁয়া। সঠিক সময়ে বাজারে সবজি বিক্রি করতে হলে জমিতে বিভিন্ন উপায়ে লায়েক দিতে হয়। পরে সবজি উৎপাদন হয়। কিন্তু বাজারে গিয়ে ঠিক মতো দাম পাই না।

শিবপুর উপজেলার কোন্দারপাড়া গ্রামের কৃষক আবদুল মালেক সবজির ন্যায্য দাম না পেয়ে আক্ষেপ করে বলেন, হাটে পাইকাররা একবার সবজির একটি দাম বললে আর বাড়তে চায় না। তাই বাধ্য হয়েই কম দামে সবজি বিক্রি করতে হয়। পাইকারি ক্রেতারা সিন্ডিকেট ভাঙতে পারলে আমরা বেশি লাভবান হতাম।

সরেজমিনে নরসিংদীর সবচেয়ে বেশি সবজির বাজার বলে খ্যাত জঙ্গি শিবপুর, বারৈচা ও পালপাড়া পাইকারি সবজির বাজারে দেখা গেছে, বেগুন প্রতি মণ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকায় দরে, নরসিংদী বাজারে খুচরা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকা দরে, সিম পাইকারি বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা টাকায় দরে খুচরা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২৫ থেকে ৩০ টাকায়, ১০০টি মাঝাড়ি আকার লাউ পাইকারী বিক্রি হচ্ছে ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকায় খুচরা বিক্রি হচ্ছে প্রতিপিছ ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়, ফুলকপি ছোট সাইজের পাইকারি ১০০ পিস বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকায় খুচরা বিক্রি হচ্ছে প্রতি পিস ১৫ থেকে ২০ টাকায়, বাঁধাকপি ১০০ পিস পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ১০০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকায় খুচরা বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকায়, টমেটো পাইকারি প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকা থেকে ৯০০ টাকায় খুচরা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২০ থেকে ২৫টায় দরে, পেঁপে পাইকারি প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৬০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা খুচরা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৫ থেকে ২০ টাকায়, কাঁচামরিচ প্রতি মণ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ১২০০ টাকা থেকে ১৪০০ টাকায় খুচরা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩০ টাকা থেকে ৩৫ টাকা দরে, করল্লা প্রতিমণ পাইকারী বিক্রি হচ্ছে ২০০০ টাকা থেকে ২১০০ টাকায় খুচরা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫০ টাকা থেকে ৬০ টাকা দরে, চাল কুমডা ১০০ পিস পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ২০০০ টাকা থেকে ২৪০০ টাকায় খুচরা বিক্রি হচ্ছে প্রতি ১৫ টাকা থেকে ২০ টাকায়।

এছাড়াও লতি পাইকারি প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ১৬০০ টাকা থেকে ১৮০০ টাকায় খুচরা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪০ টাকা থেকে ৪৫ টাকা, বরবটি প্রতিমণ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ২০০০ টাকা থেকে ২১০০ টাকায় খুচরা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫০ টাকা থেকে ৬০ টাকা দরে, কচু ১০০ পিস পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ২০০০ টাকা থেকে ২১০০ টাকায় খুচরা বিক্রি হচ্ছে প্রতি পিস ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা দরে, পুঁইশাক প্রতি মণ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৮০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকায় খুচরা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮ টাকা থেকে ১০ টাকায়, শসা পাইকারি প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকায় খুচরা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা দরে ও লালশাক পাইকারি প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকায় খুচরা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৫ টাকা থেকে ২০ টাকা দরে এবং কচুরছড়া পাইকারি প্রতিমণ বিক্রি হচ্ছে ২০০০ টাকা থেকে ২২০০ টাকায় খুচরা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩০ টাকা থেকে ৪০ টাকা দরে।

নরসিংদী কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. লতাফত হোসেন জানান, চলতি শীত মওসুমে নরসিংদী জেলার ৬ টি উপজেলায় ৫ হাজার ৮শত ৯৫ হেক্টর জমিতে সবজী চাষ করা হয়েছে।

সিন্ডিকেট করে দাম নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বলে স্বীকার করে তিনি বলেন, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষি খাতকে ধ্বংস করছেন। এতে একদিকে ন্যায্যমূল্য না পেয়ে চাষিরা ভোগান্তি পোহাচ্ছেন, অন্যদিকে উচ্চমূল্যে সবজি ক্রয় করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। তার পরও কৃষকরা উৎপাদিত মূল্য পেয়েও লাভবান হচ্ছেন। তবে সবজি দ্রুত পচনশীল হওয়ায় এবং সেই সঙ্গে সামপ্রতিক সময়ে পরিবহন ব্যয় বাড়ায় পাইকারি সবজির বাজারের সঙ্গে খুচরা বাজারের দামের ব্যাপক তারতম্য হচ্ছে।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!