হার্টঅ্যাটাকের দুশ্চিন্তার দিন ফুরালো!

ঢাকা: হার্টের রোগীদের জন্য সবচেয়ে বড় খবর এটা। এতোদিন যারা স্ট্রোক বা হার্টঅ্যাটাক নিয়ে সীমাহীন দুশ্চিন্তায় কাটাচ্ছিলেন তাদের জন্য সুসংবাদ। বিজ্ঞানীরা এবার বানিয়ে ফেলেছেন কৃত্রিম ধমনী। এটা প্রাকৃতিক ধমনীর মতো শরীরের সঙ্গে বেড়ে উঠবে। ধমনী দিয়ে রক্ত বয়ে যাওয়ার সময় আর বাধা পাওয়ার ভয় থাকছে না। অস্ত্রোপচারের হাজারো ধারালো অস্ত্রের ভয়ও আর পেতে হবে না।

আগামী দু-তিন বছরের মধ্যেই বাজারে চলে আসতে পারে নব আবিষ্কৃত কৃত্রিম ধমনী। আমার বা আপনার শরীরে সংযুক্ত এই ধমনীর মধ্যে দিয়ে কোনো বাধা, বিপত্তি ছাড়াই তরতরিয়ে বইতে পারবে রক্তস্রোত।

আর যেটা আরও চমকে দেয়ার মতো তথ্য তা হল, একটা ছোট্ট টিউবের মতো কৃত্রিম ধমনী আমার, আপনার শরীরে বসিয়ে দেয়া হলে, তা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাড়তে পারবে গায়ে-গতরে। একবারে প্রাকৃতিক নিয়মেই। বাইরে থেকে ‘গায়ের জোর’ খাটাতে হবে না। নিতে হবে না কোনো কৃত্রিম উপায়। যার শরীরে বসানো হল ওই ছোট্ট টিউবের মতো ধমনী, তার শরীরের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোষ, কলাগুলি যখন, যতটা সময়ের সঙ্গে বাড়ে, সেই গতিতেই সেগুলি শরীরের ভেতরে বসানো কৃত্রিম ধমনীকে ঠেলেঠুলে বাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবে। দিতে পারবে তার পূর্ণাঙ্গ রূপ।

বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দেয়া এই আবিষ্কারটি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অফ সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক রবার্ট ট্রাঙ্কুইল্লোর নেতৃত্বে একটি গবেষকদল। যে দলে রয়েছেন এক অনাবাসী ভারতীয় বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার অনিতা কুলকার্নিও।

একেবারে কচি ভেড়ার শরীরে ওই কৃত্রিম ধমনী বসিয়ে দেখা গিয়েছে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেড়ার শরীরের কোষ, কলাগুলি যেমন একটু একটু করে বেড়েছে, তেমনই তা ভেড়ার শরীরে বসানো কৃত্রিম ধমনীটিকে একটু একটু করে বাড়িয়েছে। আড়াআড়ি আর বহরে। শরীরের ভেতরে বসানো কোনো কৃত্রিম অঙ্গের এইভাবে শরীরেই আপনা আপনি বেড়ে ওঠার ঘটনা রীতিমতো অভিনব।

গেল সেপ্টেম্বর মাসে গবেষণাপত্রটি ছাপা হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার-কমিউনিকেশন্স’-এ। সাড়াজাগানো ওই গবেষণাপত্রটির শিরোনাম- ‘টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং অফ আসেলুলার ভাসকুলার গ্র্যাফ্টস কেপাব্‌ল অফ সোম্যাটিক গ্রোথ ইন ইয়ং ল্যাম্বস’।

চলুন জেনে নেই কীভাবে বানানো হয়েছে ওই কৃত্রিম ধমনী: যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর অনিতা কুলকার্নির কথায়, ‘আমরা কচি ভেড়ার গায়ের চামড়ার কোষের সঙ্গে জিল্যাটিনের মতো একটা রাসায়নিক পদার্থ (ফাইব্রিন) মিশিয়ে ওই কৃত্রিম ধমনীর টিউবটাকে বানিয়েছি। তারপর টানা পাঁচ সপ্তাহ ধরে কচি ভেড়ার শরীরের কোষ, কলাগুলিকে একটু একটু করে গায়ে-গতরে বাড়িয়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর পদার্থ (নিউট্রিয়েন্টস) আমরা বায়ো-রিঅ্যাক্টরের মাধ্যমে ওই টিউবে ঢুকিয়েছি। এরপর ওই টিউবটিকে একটি বিশেষ ধরনের ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে তার গায়ে লেগে থাকা ভেড়ার চামড়ার কোষগুলিকে সরিয়ে দিয়েছি। কারণ, ওই কোষগুলির স্বাভাবিক বাড়-বৃদ্ধির জন্য কৃত্রিম ধমনীতে রক্তস্রোত বাধা পেতে পারে। তা আটকে যেতে পারে।

বায়ো-রিঅ্যাক্টরের মাধ্যমে আদতে দু’টি কাজ করেছি আমরা। প্রথমত, কোষ, কলাগুলিকে বাড়ানোর জন্য পুষ্টিকর পদার্থ ঢুকিয়েছি। দ্বিতীয়ত, টিউবটাকে শক্তপোক্ত করে তোলার জন্য ওই বায়ো-রিঅ্যাক্টর দিয়ে খানিকটা যেন ‘ব্যায়াম’ করিয়েছি আমরা। যাতে শরীরের মধ্যে রক্তস্রোতের জন্য তা ফেটে না যায়। সে জন্য স্বাভাবিক ধমনীর চেয়ে কৃত্রিম ধমনীকে করা হয়েছে দ্বিগুণ শক্তিশালী।

প্রফেসর অনিতা কুলকার্নি জানিয়েছেন, মানুষের শরীরে বসিয়ে তার কার্যকারিতা প্রমাণের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও শুরু হবে খুব শিগগিরই। তবে ভেড়ার ওপর যে পরীক্ষা সফল হয়েছে, মানুষের ক্ষেত্রে তা ব্যর্থ হওয়ার কোনো বিজ্ঞানসম্মত কারণ রয়েছে বলে আমাদের মনে হয় না।

কিন্তু শরীরের ধমনী তো একটা সোজা, সরলরেখা নয় যে তা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুধু সোজাসুজি দু’দিকে বাড়বে। শরীরের ভেতরে বসানো ওই ফাইব্রিন টিউবের কৃত্রিম ধমনীকে বাঁকিয়ে-চুরিয়ে সব দিকে বাড়াবে কী ভাবে? এ বিষয়ে মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অফ সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মূল গবেষক রবার্ট ট্রাঙ্কুইল্লো জানিয়েছেন, ভেড়ার শরীরে ওই কৃত্রিম ধমনী বসানোর পাঁচ সপ্তাহের মধ্যেই দেখা গিয়েছে কোষগুলি নিজেরাই বেড়ে উঠে কৃত্রিম ধমনীটিকে বাঁকিয়ে দিয়েছে। কোনো একটি নির্দিষ্ট অঙ্গের অভিমুখী করে তোলার জন্য। এও দেখা গিয়েছে, একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত কোষগুলি বেড়ে উঠে ওই কৃত্রিম ধমনীটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে পেরেছে।

গবেষণার উল্লেখযোগ্য পর্যবেক্ষণ কী কী: গবেষকদলের অন্যতম সদস্য অনিতা কুলকার্নি জানিয়েছেন, ‘আমরা দেখেছি, কচি ভেড়াগুলির বয়স যখন ৫০ সপ্তাহে পৌঁছেছে, তখন তাদের শরীরে বসানো কৃত্রিম ধমনীর ব্যাস কম করে ৫৬ শতাংশ বেড়েছে। আর সেই কৃত্রিম ধমনীর মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া রক্তস্রোতের গতি বেড়েছে ২১৬ শতাংশ। ধমনীতে দ্রুত রক্ত সংবহনের জন্য যা খুবই জরুরি, সেই কোলাজেন প্রোটিনের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৪৬৫ শতাংশ। তার মানেটা হল, স্বাভাবিক ধমনী যে ছন্দে বাড়ে শরীরে, একেবারে সেই ছন্দেই আপনা আপনি বেড়ে উঠেছে কৃত্রিম ধমনী ভেড়ার শরীরে। আর তার ফলে রক্ত জমাট বাঁধা, ধমনী হঠাৎ সরু হয়ে যাওয়া বা ধমনীতে ক্যালসিয়াম জমে রক্তপ্রবাহে বাধা দেয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। সূত্র: আনন্দবাজার

সোনালীনিউজ/এমএন