• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হাসনাত করিমই ঘটনার মূল হোতা


বিশেষ প্রতিনিধি আগস্ট ৭, ২০১৬, ০৯:৫০ এএম
হাসনাত করিমই ঘটনার মূল হোতা

শেষ মুহূর্তে জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজ ও অন্যতম সহযোগী তাহমিদের সঙ্গে আর্টিজানের ছাদে হাসনাতের শলাপরামর্শ (বাঁয়ে)। ব্রিফিং শেষে বেরিয়ে যাচ্ছেন হাসনাত। এ সময় সশস্ত্র অবস্থায় ছিল জঙ্গিরা (গোল চিহ্নিত) -সংগৃহীত

অবশেষে নিশ্চিত হওয়া গেছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমই ছিলেন গুলশান হামলার অন্যতম হোতা। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এবং অন্যান্য প্রমাণাদি থেকে তা-ই নিশ্চিত হয়েছেন গোয়েন্দারা।

তিনি নিজে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে হামলা পরিচালনা ও মনিটরিং করেন। নানাভাবে যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদান করেন দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন মাধ্যমে। গুরুত্বপূর্ণ এ ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একেবারে স্বাভাবিক।

আর এতটাই স্বাভাবিক ছিলেন যে, বীভৎস হত্যাযজ্ঞের মধ্যে ভাত রান্নার ব্যবস্থা করে সপরিবারে রাতের খাওয়া-দাওয়াও সেরে নেন। সঙ্গে থাকা কানাডা প্রবাসী ছাত্র তাহমিদ খান ছিলেন তার অন্যতম সহযোগী। নিজ হাতে অস্ত্র চালিয়ে সেও এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয়। বিলম্বে হলেও দুটি স্টিল ছবি ও তার মোবাইল ফোনের অধিকতর ফরেনসিক রিপোর্ট থেকে এসব চাঞ্চল্যকর ক্লু বেরিয়ে এসেছে।

প্রসঙ্গত, ঘটনার পর শুরু থেকেই একটি পক্ষ হাসনাত করিম ও তাহমিদ খানকে নির্দোষ প্রমাণ করতে নানাভাবে সক্রিয় ছিল। যে কারণে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের প্রমাণ নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তিও তৈরি হয়। তবে ঘটনার ৩৬ দিনের মাথায় শনিবার সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থার কাছে হাসনাত করিমের জড়িত থাকার অকাট্য প্রমাণ মিলেছে। এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরতে আজ-কালের মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হতে পারে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের একটি গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, হামলার পরদিন আর্টিজান রেস্টুরেন্টের ছাদে বৈঠকরত অবস্থায় ক্যামেরাবন্দি হন হাসনাত করিম, তাহমিদ খান ও নিহত জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজ। তিনজনের এই এক্সক্লুসিভ গ্রুপ ছবি বিশ্লেষণ করে জঙ্গি হামলার সময় তাদের ভূমিকার বিষয়টি তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হামলার সঙ্গে হাসনাত ও তাহমিদের সম্পৃক্ততার অকাট্য প্রমাণ হিসেবে এই ছবি সরকারের উচ্চ পর্যায়কেও দেখানো হয়। এরপর উপর মহলের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী আইনি পদক্ষেপগুলো দ্রুত সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

ভিডিওটি যুগান্তর থেকে সংগৃহীত

গুলশান হামলায় হাসনাত করিমের ভূমিকা গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলাকারীদের সঙ্গে হাসনাত করিমের জড়িত থাকার বিষয়টি নিয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই। রাত ৮টা ৪৬ মিনিটে রেস্টুরেন্টে হামলা হয়। এর ১১ মিনিটের মাথায় ৮টা ৫৭ মিনিটে হাসনাতের মোবাইল ফোনটি সন্দেহ করার মতো বেশ কিছু কাজে সক্রিয় হয়ে ওঠে। হাসনাত করিম হামলার খবরাখবর জানাতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের ওপর নজর রাখতে শুরু করেন। ধারণা করা হচ্ছে, হামলা শুরুর পর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া জানার জন্য তিনি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের ওপর নজর রাখছিলেন। একইসঙ্গে রেস্টুরেন্টের বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ও বাইরের পরিস্থিতি সম্পর্কে জঙ্গিদের আপডেট রাখছিলেন তিনি।

সূত্র জানায়, তিনি হামলার সময় তার মোবাইল ফোন থেকে উইকারসহ বেশ কয়েকটি অ্যাপসও ডাউনলোড করেন। বিভিন্ন স্থানে বার্তা আদান-প্রদানের কাজে এসব অ্যাপস ব্যবহার করে জঙ্গিরা। এছাড়া হামলায় নিহত বিদেশি নাগরিকদের ক্ষত-বিক্ষত দেহের ছবি পাঠানোর কাজেও হাসনাতের মোবাইল ফোন ব্যবহৃত হয়। উগ্রবাদীদের মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক মুখপত্র ‘আমাক নিউজ এজেন্সি’ ও ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের গুপ্তচর রিটা কার্টৎজের ওয়েব পোর্টাল সাইট ইন্টেলিজেন্সের কাছেও ওইসব ছবি পাঠানো হয়।

যৌথ তদন্ত দলের একজন উচ্চপদস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, হামলার পরদিন কাকডাকা ভোরে জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজ, তাহমিদ খান ও হাসনাত করিমকে রেস্টুরেন্টের ছাদে ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখা যায়। পাশের ভবন থেকে তাদের এই গুরুত্বপূর্ণ সহ-অবস্থানের কয়েকটি ছবি তুলতে সক্ষম হন পার্শ্ববর্তী ভবনের একজন বাসিন্দা। ভবনের ছাদে তিনজনের আলাপরত অবস্থার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও দুর্লভ মুহূর্তের দুটি ছবি সম্প্রতি যুগান্তরের কাছে আসে।

এতে দেখা যায়, জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজের গলায় সামরিক কায়দায় ঝোলানো আছে একটি অত্যাধুনিক অস্ত্র। আর তার পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তাহমিদ খান ও হাসনাত করিম। ছবিতে তাহমিদের হাতেও অস্ত্র দেখা যায়। তিনজনই ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিতে একেবারে স্বাভাবিকভাবে একে অপরের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন।

এই ছবি বিশ্লেষণ করে যৌথ তদন্ত দলের একজন দায়িত্বশীল গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ছবিতে দেখা যাচ্ছে জঙ্গি রোহানের গলায় ভারি অস্ত্র ঝোলানো থাকলেও সে সতর্ক অবস্থানে নেই। দুটো হাতই পেছনে রেখে সে অনেকটাই ‘নরমাল’ (স্বাভাবিক) ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে তাহমিদ খানের হাতে দেখা যায় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। পিস্তল আকৃতির সেই অস্ত্রটি তিনি সতর্কভাবে ধরে আছে। অস্ত্র পরিচালনার আগ মুহূর্তে সামরিক কায়দায় যেভাবে প্রস্তুতি নেয়া হয় অস্ত্র হাতে তার শারীরিক ভঙ্গিও তেমন ছিল। তার অস্ত্র ধরার এই ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে তাহমিদ অস্ত্র চালনায় বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তবে দু’অস্ত্রধারীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করার সময় হাসনাত করিমকে এতটুকু বিচলিত মনে হয়নি। খোলা চোখে যে কেউ এ ছবির দৃশ্য দেখলে তার কাছেও এমনটি মনে হবে।

ছবির বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকার সময় জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজ একেবারে অসতর্ক অবস্থায় ছিল। ইচ্ছে করলেই তাহমিদ ও হাসনাত খুব সহজেই তাকে প্রতিহত করতে পারত। কিন্তু তারা সে ধরনের চেষ্টাই করেনি। বরং সশস্ত্র অবস্থায় ছাদে দাঁড়িয়ে মিটিং করে তারা এবং মিটিং শেষে তিনজনই ধীরে ধীরে ছাদ থেকে নেমে যান। এরপর হাসনাত করিম সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় সপরিবারে রেস্টুরেন্টের বাইরে বেরিয়ে আসেন।

এতে বোঝা যায়, গুলশান হামলা মিশনের শেষ পর্যায়ে জঙ্গিদের তিনি সমাপনী ব্রিফিং করছিলেন। যারা বাইরে থেকে এ দৃশ্য দেখেছেন তারা হয়তো মনে করেছেন, জঙ্গিরা অবশেষে এই পরিবারকে জিম্মিদশা থেকে জীবিত অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছে।

কিন্তু প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণ ও ঘটনার ‘এই বিশ্লেষণ’ পুরো বিষয়টিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। ওদিকে তাহমিদও শেষমেশ জিম্মি পরিচয়ের আড়ালে নিজের জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র সন্দেহের আরও একটি ক্লু হিসেবে প্রতিবেদককে বলেন, প্রাপ্ত ছবিতে রোহান ইমতিয়াজ ও তাহমিদকে একই ধরনের পোশাকে দেখা গেছে। তারা দু’জনেই কালো টি-শার্ট ও খয়েরি রঙের জুতা পরেছিলেন। হলি আর্টিজানের অন্য চার হামলাকারীও একই ধরনের টি-শার্ট ও জুতা পরে হামলায় অংশ নেয়। এটি বর্তমান সময়ে জঙ্গি হামলাকারীদের পরিচয় বহনের বিশেষ একটি সদৃশ্য ক্লু বটে।

যা ছিল খুবই বিস্ময়কর: তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, রেস্টুরেন্টের ভেতরে বর্বরতম হত্যাকাণ্ড চালানোর পর ২০টি রক্তাক্ত লাশের মধ্যে দাঁড়িয়ে জঙ্গিরা নির্বিকারভাবে রাতের খাবার সারেন। রেস্টুরেন্টের সহকারী বাবুর্চি মিরাজকে দিয়ে ভাত ও তরকারি রান্না করানো হয়। সহকারী বাবুর্চি মিরাজ তদন্ত দলের কাছে দেয়া তার জবানবন্দিতে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য দেন। এ প্রসঙ্গে তিনি তার জবানবন্দিতে বলেন, পাঁচ জঙ্গির সঙ্গে বসে স্ত্রী ও শিশুসন্তানদের নিয়ে তার রান্না করা খাবার খান হাসনাত করিম। এ সময় খাবার টেবিলে তাহমিদ খানও বসেছিলেন।

সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ড চালানোর আগে রেস্টুরেন্টের ভেতরে থাকা বেশকিছু লোককে অস্ত্রের মুখে বিভিন্ন বাথরুমে বন্দি করে রাখা হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে হাসনাত করিম ও তাহমিদ ছিলেন পুরোপুরি মুক্ত। এদের দু’জনকে বাথরুমে আটকে রাখা তো দূরের কথা তারা পুরোপুরি মুক্ত অবস্থায় রেস্টুরেন্টের ভেতর ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে পেরেছে। তাদের সন্দেহ করার ক্ষেত্রে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় ক্লু।

জানা যায়, নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞের মধ্যে কাকডাকা ভোরে ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে হাসনাত করিমকে ধূমপান করতেও দেখা যায়। অথচ তখন ছিল পবিত্র রমজান মাস। হাসনাত করিম গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করলেও সেদিন তিনি রাতের খাবার খেয়েও রোজা রাখেননি। এই তথ্যও তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ভাবিয়ে তোলে। 

বিশ্লেষকদের ধারণা, পবিত্র রমজান মাসে তার এই কর্মকান্ড প্রমাণ করে তিনি ইহুদিদের নিয়োগকৃত এজেন্ট।

অবশ্য এ প্রসঙ্গে গোয়েন্দাদের জেরার মুখে হাসনাত বলেন, মাঝে মাঝে তিনি রোজা রাখেন। আবার মাঝে মাঝে রাখেন না। এশার নামাজ এবং তারাবি না পড়ে সপরিবারে কেন হলি আর্টিজানে এসেছিলেন- এমন প্রশ্নেরও কোনো সদুত্তর দেননি হাসনাত করিম।

গুলশান হামলার কিছু মুহূর্তের ভিডিও

 

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমএইউ

Wordbridge School
Link copied!