• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

১৫ আগস্ট এলেই কেবল খোঁজ পড়ে আমাদের


এম আরমান খান জয়, গোপালগঞ্জ আগস্ট ১৪, ২০১৭, ০৬:৫২ পিএম
১৫ আগস্ট এলেই কেবল খোঁজ পড়ে আমাদের

বঙ্গবন্ধুর দাফনকারী দুই ভক্ত

গোপালগঞ্জ : সারা বছর আমাদের কীভাবে চলে সে খবর কেউ রাখে না, নেয় না। ১৫ আগস্ট এলেই কেবল খোঁজ পড়ে আমাদের। বঙ্গবন্ধুর লাশ যখন মিলিটারিরা এখানে নিয়ে আসে, তখন ভয়ে অনেকে কাছেই আসেনি। সেনা কর্মকর্তারা চেয়েছিল তাড়াহুড়ো করে দ্রুততর সময়ের মধ্যে তাকে কোনরকমে মাটি চাপা দিয়ে ঢাকায় ফিরতে, কিন্তু সেদিন টুঙ্গিপাড়ার মুজিবপাগল কতিপয় মানুষের সাহসী ভূমিকার কারণে তা তারা পারেনি। 

৫৭০ সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে রেড-ক্রিসেন্টের রিলিপের মার্কিন কাপড় এনে জানাজার কাপড় তৈরি করে তারপর বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফন করেছিলাম আমরা। কাঠের বাক্স যখন খোলা হলো, দেখলাম শুয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। শিউরে উঠলাম। কোন কথা বলতে পারলাম না। কাঁদলাম নিঃশব্দে। এখন অনেকেই অনেক কিছু বলে, কিন্তু তখন অনেককেই পাওয়া যায়নি। বঙ্গবন্ধুর দাফন কাজে আমরা যারা সম্পৃক্ত ছিলাম, তাদের অনেকে এখন নেই। যারা বেঁচে আছি, এখনো সেই স্মৃতিকেই ধারণ করে আছি।’ -কথাগুলো বলছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাফনকারীদের একজন কাজী ইদ্রিস আলী। 

গত মঙ্গলবার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি আরো জানান, ১৯৭৩ সালে টুঙ্গিপাড়া রেড-ক্রিসেন্ট হাসপাতালে বঙ্গবন্ধু তাকে চাকরি দিয়েছিলেন। ২০১১-এর ৯ জানুয়ারি তিনি অবসরে গেলেও এখনো তিনি ওখানেই কাজ করছেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে তাকে ৬ হাজার টাকা বেতন দেয়া হয়। আগামী ৯ জানুয়ারি তার সে মেয়াদ শেষ হবে। তার দু’টি মেয়ে, বিয়ে হয়ে গেছে। বড় ছেলে এমএ পাস করে ঢাকায় একটি গার্মেন্টসে কাজ করে, কোন সরকারী চাকরি হয়নি। মেজ ছেলে ডিগ্রী পড়ছে। ছোট ছেলে এইচএসসি পাস করে বেকার। তার সামনে শুধু অন্ধকার। 

পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোন রকমে তিনি দিনানিপাত করছেন। কয়েকবার ঢাকা গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখার করার চেষ্টা করেছেন। অনেকেই তাকে শুধু আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি দেখা করতে পারেননি। তিনি আরো বলেন, মৃত্যুর আগে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসি দেখে যেতে পেরেছি। মনের কষ্ট কিছুটা হলেও কমেছে। তবে যারা বিদেশে পলাতক রয়েছে তাদের ধরে এনে ফাঁসিতে ঝোলাতে হবে। এমন সোনার মানুষকে যে পাষুরা খুন করল তারা মানুষ নামের কলঙ্ক। তাদের শাস্তি হওয়া উচিত, ওই খুনীদের কোন ওয়ারিশকেও এই মুজিবের বাংলায় বসবাস করতে দেয়া ঠিক না। 

বঙ্গবন্ধুর দাফনকারীদের আরেকজন হলেন রজব আলী শেখ। যিনি বঙ্গবন্ধুর লাশ এসেছে শুনে দৌঁড়ে গিয়েছিলেন তাদের প্রিয় মুজিব ভাইকে শেষবারের মতো দেখতে। পরম স্নেহের ঋণ খানিকটা শোধ করতে তৈয়ব আলীর দোকান থেকে ৬ আনা দিয়ে কিনে এনেছিলেন ৫৭০ সাবান। বছরের পর বছর জমিতে কাজ করে জীবনের এ গোধূলী বেলায় পেয়েছেন কেবলই হতাশা। ফুসফুসটিও চলে গেছে পোকার দখলে। ছেলেরা ছোট ছোট চাকরি করলেও ভাঙ্গা টিনের ঘরেই কোনরকমে কাটছে তার দিন। 

এমন ঐতিহাসিক কাজের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে কতটুকু সম্মান পেয়েছেন?- এমন এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি হতাশাচিত্তে শুধু এটুকুই বললেন, ‘কে দ্যাখফে? যে দুঃখ বোঝতো, সে তো নাই। মুজিব ভাইয়ের খুনীগো বিচার হইছে, তাই দেইহে যাতি পারলাম- এতেই খুশি।’ 

বড় পবিত্রতায় যারা সেদিন বঙ্গবন্ধুকে গোসল করিয়েছিলেন তাঁদের একজন হলো মন্নাফ শেখ। গোসলের আগে নিথরচিত্তে তিনি অবলোকন করেছিলেন জাতির পিতার বাংলাদেশের মানচিত্রসম ২১ বুলেটের ক্ষত-বিক্ষত বুকটি। গোসল করাতে গিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর মাথার কাছে পেয়েছিলেন তার প্রিয় চশমাটি আর পরনের সাদা ফিনফিনে পাঞ্জাবির পকেটে পেয়েছিলেন ধূমপানের পাইপটি। যা বর্তমানে সংরক্ষিত রয়েছে টুঙ্গিপাড়ার বঙ্গবন্ধু মাজার কমপেলেক্স জাদুঘরে। 

তার পাঁচ মেয়ে, সবার বিয়ে হয়ে গেছে এবং পাঁচ ছেলে, ছোট ছেলে সরকারী চাকরি করছে। তার বড় ছেলে শেখ রহমান (রমা) বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার একজন সাক্ষী। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে তিনি ভাল আছেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এই বাংলাদেশ সোনার বাংলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে এত দেরি হতো না। আমেরিকা, চীন, জাপান, রাশিয়ার সমকক্ষ হতে বাংলাদেশের বেশিদিন লাগত না। তাই বঙ্গবন্ধুর সব খুনীর ফাঁসি আমরা দেখে যেতে চাই। যেসব খুনী এখনও যারা বিদেশে রয়েছে তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করতে হবে। 

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এআই

Wordbridge School
Link copied!