• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৩০ ঘণ্টা পানির নিচে যেভাবে বেঁচে ছিল সোহাগ


নিউজ ডেস্ক অক্টোবর ২৪, ২০১৭, ০৫:৪৩ পিএম
৩০ ঘণ্টা পানির নিচে যেভাবে বেঁচে ছিল সোহাগ

ঢাকা: সোহাগ হাওলাদারের সকালটা শুরু হয়েছিল অন্য কোনো দিনের মতোই। এমভি মুসা নূর নামের মালবাহী নৌযানে (বাল্কহেড) ততক্ষণে বালু বোঝাই করা হয়েছে। হাতের কাজ সেরে ইঞ্জিনরুমে ঢুকে পড়েছিলেন সোহাগ। একফাঁকে মুঠোফোনে কথাও বলেছিলেন মায়ের সঙ্গে। 

গত ১০ বছরে এই কক্ষেই বেশি সময় কেটেছে তাঁর। ১১ অক্টোবর সকালে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বৈদ্যের বাজার এলাকা থেকে তাঁদের গন্তব্য ছিল নারায়ণগঞ্জ বন্দর। 

২১ অক্টোবর সকালে, সোহাগ হাওলাদারের সঙ্গে কথা শুরু হয়েছিল ওই সকালের বর্ণনা নিয়ে। 

বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়নের রাহুতকাঠি গ্রামে সোহাগের বাড়ি। যদিও মানুষ এখনো বিশ্বাস করতে পারে না সোহাগ ফিরে এসেছেন। তাঁর বাড়ির আঙিনায় বসে আবারও কান পাতি সোহাগের কথায়। 

সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে থাকেন সোহাগ- “চলতে চলতে একসময় মনে হলো জাহাজের সামনের অংশ কোনো কিছুতে আটকে গেছে। তখন আমি জাহাজ পেছন দিকে নেওয়ার (গন ব্যাগার) নির্দেশ পাই। গন ব্যাগার দিয়ে আমি ইঞ্জিনরুম থেকে ওপরে উঠে আসি। এসময় জাহাজটি একদিকে হেলে পড়ছিল। তখন সকাল ১০টা। বন্দর উপজেলার ২ নম্বর ঢাকেশ্বরী সোনাচড়া এলাকার ডকইয়ার্ডের সামনে ছিল এমভি মুসা নূর। ওপর থেকে ইঞ্জিন বন্ধ করার ঘণ্টাধ্বনি পাই। সঙ্গে সঙ্গে আবার ইঞ্জিনরুমে গিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে ওপরে ওঠার চেষ্টা করি, কিন্তু ততক্ষণে দরজা দিয়ে প্রচন্ড বেগে পানি ঢুকছে। পানি ঠেলেই বের হওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু কিছুতেই বের হতে পারলাম না।” সাড়ে ১৬ হাজার বর্গফুট বালুভর্তি এমভি মুসা নূর ধীরে ধীরে ডুবে যায় শীতলক্ষ্যার পানিতে।

সেদিন নৌযানে কর্মী ছিলেন মোট ছয়জন। সোহাগ হাওলাদার ছাড়া পাঁচজনই সাঁতরে তীরে ওঠেন। এরপর? সোহাগ হাওলাদার অজানায় দৃষ্টি রাখেন। শুধু বলেন, “আমার আর কিছুই মনে নেই”। সেদিন বিকেলেই শুরু হয়ছিল উদ্ধারকাজ। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল নিখোঁজ সোহাগ হাওলাদারকে উদ্ধারের চেষ্টা করেন। দীর্ঘ সময় চেষ্টার পরও উদ্ধার না হওয়ায় স্বজনেরা মরদেহ গ্রহনের প্রস্তুতি নিয়েছিল। ডুবুরি দিয়ে খুঁজতে থাকেন মরদেহ। আনা হয় কফিন, চা-পাতা, সাদা কাপড়। সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত চলল উদ্ধার তৎপরতা। কিন্তু খুঁজে পাওয়া গেল না সোহাগের মরদেহ। সমাপ্ত ঘোষণা করা হলো উদ্ধার অভিযান। 

গ্রামে চলছিল জানাজার প্রস্তুতি। ১২ অক্টোবর, এর মধ্যেই পেরিয়ে গেছে ২৪ ঘণ্টা। সোহাগের মরদেহ উদ্ধারের আশা ছেড়ে দিয়েছিল অনেকে। তবে হাল ছাড়েননি স্বজনেরা। 

এদিকে গ্রামবাসী প্রস্তুতি নিয়েছিল গায়েবানা জানাজা নামাজের। কিন্তু বিকেল চারটায় থেমে গিয়েছিল সব প্রস্তুতি। শোকের কান্না রূপ নিয়েছিল আনন্দের অশ্রুতে। কারণ, তখন সোহাগের বাড়িতে পৌঁছে গেছে ডুবুরি জাহাঙ্গীরের কথা, সে বেঁচে আছে। 

১২ অক্টোবর সকালে ডাক পড়েছিল ডুবুরি জাহাঙ্গীর আলম সিকদারের। মাদারীপুরের শিবচরের এই ডুবুরি ৫০ বছর ধরে এ কাজ করছেন। জাহাঙ্গীর আলম সিকদারের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। 

তিনি জানান, ‘আমাকে বলা হয়েছিল ভেতরে একটি মৃতদেহ আছে, বের করতে হবে। চুক্তি হয়, উদ্ধার করতে পারলে ২০ হাজার টাকা দেবেন, না পারলে ৫ হাজার।’ উদ্ধারকাজ করতে এসে জাহাঙ্গীর আলম সিকদার দেখেছিলেন ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় ডুবুরিরাও আছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি বুঝে নিয়েছিলেন তিনি। উদ্ধারকাজে সহযোগী হিসেবে নেন উদ্ধারকারী জাহাজ প্রতয়ের ডুবুরি মাসুম মল্লিককে। শুরু করেছিলেন তাঁর উদ্ধারকাজ। 

জাহাঙ্গীর আলম সিকদার জানান, “আমি ইঞ্জিনরুমে গিয়ে দেখি সামনে ও পেছনে দুটি দরজাই আটকানো। প্রথমে গিয়ে পেছনের দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করি। পরে ব্যর্থ হয়ে সামনের দরজা ভাঙ্গি। দরজা খোলার পর সেটা বারবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আবার ওপরে ওঠি। বড় দড়ি নিয়ে ফের পানিতে নামি। দড়ি দিয়ে দরজা একটি হুকের সঙ্গে বাঁধি। ঢুকে পড়ি রুমের ভেতরে। সেখানে কোনো পানি ছিল না। শুধু হাওয়া ছিল। আমি ভাবছি, মৃতদেহ হয়তো পানিতে ভেসে থাকবে। ভেতরটা ছিল খুব অন্ধকার। ডিজেলের গন্ধ। আধা ঘণ্টা পর খুঁজে পাই সোহাগকে। খুঁজে পাওয়া সোহাগ যে তখনো জীবিত, বুঝে উঠতে পারিনি। ওর শরীরে হাত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ও হাত সরিয়ে দেয়। আর বলছিল আল্লাহ। অবিশ্বাস্য মনে হয়ছিল। আমার অক্সিজেন মাস্ক খুলে সোহাগের কাছে জানতে চাইলাম, জীবিত আছ? ও উত্তর দিয়েছিল, হ্যাঁ। সাহস দিয়ে বলছিলাম, ভয় পেয়ো না, তোমারে উদ্ধারের চেষ্টা করতেছি। ওপরে উঠে এসে অন্য ডুবুরির অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে আবার চলে গিয়েছিলাম সোহাগের কাছে। কিন্তু ও ভয়ে কাঁপছিলো। মাস্ক পরতে চাইছিলো না। ওরে বলছিলাম, দেখো, আমি মানুষ। আমার দাড়ি ধরিয়েছিলাম, বুক মেলালাম। এভাবেই ওর সাথে কথা চলছিল প্রায় ৫০ মিনিট। সংবিৎ খুঁজে পেয়েছিল সোহাগ। রাজি হয়েছিল মুখোশ পরতে। বেল্ট লাগিয়ে আস্তে আস্তে ওপারে ওঠিয়েছিলাম। ভেতরে অনেক লোহালক্কড় ছিল। ব্যথা যাতে না পায়, সে জন্য মাথায় এক হাত রেখে ওপরে তুলছিলাম।” এর মধ্যেই পেরিয়ে গেছে ৩০ ঘণ্টা। কিন্তু কিছুই মনে নেই সোহাগের। 

উদ্ধার করে ওপরে তুলে আনার পর স্বজনদের দেখে অবাক হয়েছিল সোহাগ হওলাদার। তাঁর মাথায় প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, এত আত্মীয়স্বজন এখানে এসেছে কেন? সোহাগের চাচা আনছার আলী হাওলাদার জানান, আমি ঢাকায় থাকি। খবর পেয়েই ছুটে গিয়েছিলাম। ১২ অক্টোবর বিকেল চারটায় সোহাগকে উদ্ধার করার পর বিশ্বাস হচ্ছিল না সে জীবিত।’ 

বাবুগঞ্জের এক সাধারণ পরিবারের ছেলে সোহাগ হাওলাদার। বাবা বাদল হাওলাদার ও মা পাপিয়া বেগমের বড় ছেলে। ২০০৭ সালে বাবা মারা যান। এরপর সোহাগ পড়াশোনা ছেড়ে পরিবারের দায়িত্ব নেন। কাজ শুরু করেন বালুবাহী জাহাজে ইঞ্জিনচালক হিসেবে। সেদিন উদ্ধারের পরপরই তাঁকে নারায়ণগঞ্জের ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়েছিল। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলানোর ব্যবস্থা করা হয়। সোহাগ দেখেন তাঁর মা কাঁদছেন। তিনি কিছুতেই বুঝতে পারেন না মা কাঁদছেন কেন। 

সোহাগ বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছিল একটু আগেই মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমার কাছে সবকিছু স্বাভাবিকই মনে হচ্ছিল। শুধু শরীর, হাত-পা ব্যথা করছিল। জ্বর বোধ হচ্ছিল।’ সেদিন হাসপাতালে স্যালাইন দেওয়ার পর চিকিৎসকেরা সোহাগের অবস্থা শঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছিল আত্মীয়দের। তারপর বরিশালের বাবুগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে আনা হয় সোহাগকে। এখন মায়ের কাছেই আছেন তিনি।

সোনালীনিউজ/জেএ

Wordbridge School
Link copied!