• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

৬০ হাজার শিক্ষকের সনদ জাল!


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ২, ২০১৭, ০৮:৪৮ পিএম
৬০ হাজার শিক্ষকের সনদ জাল!

ঢাকা: ষাট হাজারের বেশি শিক্ষক জাল সনদে চাকরি করছেন। তারা মাসের পর মাস তুলে নিচ্ছেন ‘মান্থলি পে-অর্ডার’ (এমপিও) সুবিধা। একই সঙ্গে তারা তৎপর হয়ে উঠেছেন ভুয়া সনদ ‘বৈধ’ করার জন্য। এর জন্য ‘ম্যানেজ’ করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।

শিক্ষকদের ভুয়া সনদ ‘বৈধ’ করার অনিয়ম চলছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে মূল ও বিএডের (ব্যাচেলর অব এডুকেশন) জাল সনদে এ যাবৎ চাকরি করে আসছিলেন এসব শিক্ষক। তারা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকা নিচ্ছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা চক্রের যোগসাজশে।

অনিয়ম চলতে থাকায় জাল সনদধারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাদের কাছ থেকে টাকা ফেরত নেয়ার সুপারিশ করে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার পর গত দেড় বছরে কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

তথ্যমতে, ডিআইএ গত কয়েক বছরে জাল সনদে (শিক্ষাগত মূল সনদ) নিয়োগ পাওয়া এক হাজার দুশ’র বেশি শিক্ষককে চিহ্নিত করে। নিবন্ধন সনদের বৈধতা যাচাইয়ের জন্য ডিআইএ থেকে গত বছরের মাঝামাঝি চিঠি দেয়ার পর বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) জবাব দেয়। এনটিআরসিএর জবাব থেকে ১০৫ জনের মধ্যে ৯৩ শিক্ষকের সনদ জালের প্রমাণ মিলে।

ডিআইএর কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, সারা দেশের ৩০ হাজার প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন শেষে আরো ১০ হাজারের বেশি জাল সনদধারী শিক্ষক চিহ্নিত হতে পারে। জাল সনদে নিয়োগ পেলেও তাদের এমপিওভুক্তিতেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ডিআইএ ৮৬৯৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন, নিরীক্ষা ও তদন্ত শেষে প্রতিবেদন তৈরি করে। এগুলোর মধ্যে মাত্র ৩০০ প্রতিবেদন নিষ্পত্তি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যোগাযোগ করলে মাউশির মহাপরিচালক এস এম ওয়াহিদুজ্জামান অভিযোগ অস্বীকার করেন। এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইনের বক্তব্য জানতে কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি।

সূত্র জানায়, জাল সনদের শিক্ষকদের এমপিও সুবিধা দিতে মাউশির কাছে প্রথম প্রস্তাব আসে জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছ থেকে। সনদপত্র জাল কি না, তা নিয়ম অনুযায়ী প্রাথমিক যাচাইয়ের দায়িত্ব শিক্ষা কর্মকর্তাদের। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা জাল সনদধারীর কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে তাদেরকে সরকারি সুবিধা পেতে সুযোগ করে দিচ্ছেন।

অনেক উপজেলা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও তারা জবাবদিহিতার বাইরে থাকেন। অভিযোগ ব্যাপক হয়ে উঠলে মাউশি তাদেরকে অন্যত্র বদলি করে ‘দায়’ সারতে চায়। বিভিন্ন অভিযোগে ১৬ জন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার বদলির আদেশ গত ১৩ মার্চ জারি করে মাউশি। তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

গত বছরের ৫ এপ্রিল বেসরকারি বিদ্যালয় ও মাদরাসার এমপিও প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে নির্দেশ দেয় মাউশি। প্রতিষ্ঠানটির আওতাধীন ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, রংপুর, কুমিল্লা ও সিলেট অঞ্চলের শিক্ষকদের এমপিও কার্যক্রমের আদেশ দেয়া হয়।

তখন জাল সনদের অনেকের আবেদন এলে তাদেরকে মাউশি থেকে এমপিও সুযোগ করে দেয়া হয় বলে অভিযোগ আছে। তখন মাউশির মহাপরিচালক ছিলেন ফাহিমা খাতুন। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ফোন করলেও তিনি ধরেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাউশির এক কর্মকর্তা জানান, ‘অনেক শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ থেকে সনদ নিয়ে চাকরি করেন। তারা অবৈধভাবে সনদ সংগ্রহ করেন। এসব বিষয়ে মাউশি এখন কঠোর অবস্থানে আছে। সনদ জালিয়াতি বন্ধে সরকার গত বছর থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়োগ ব্যবস্থা চালু করে। দেশে আর বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ স্থাপনের অনুমতি না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।’

মাউশির অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, ‘নিয়োগ থেকে শুরু করে এমপিও সুবিধা পাওয়া পর্যন্ত কারো কাগজপত্র অন্তত ১০ ধাপে নিরীক্ষা হওয়ার কথা। যেমন-নিয়োগ কমিটি, প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও সভাপতি, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ডিলিং কর্মকর্তা, শিক্ষা কর্মকর্তা, সহকারী পরিচালক, উপপরিচালক, পরিচালক এবং মহাপরিচালক। মাউশির পাশাপাশি অন্যদেরও এখানে দায় থাকে।’

সূত্র জানায়, ঢাকার মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুল সালামের বিএড সনদ সম্প্রতি ভুয়া প্রমাণিত হয় মাউশির তদন্তে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ২৯ ডিসেম্বর তার সনদ তদন্তে মাউশিকে নির্দেশ দেয়। মাউশির সেসিপ প্রকল্পের উপপরিচালক কাজী নূরে আলম সিদ্দিকী ও সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক) চন্দ্র শেখর হাওলাদার তদন্ত করে সম্প্রতি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেন। মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) এলিয়াস হোসেন জানান, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্ত করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়। কি ব্যবস্থা নেবে তা মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার।’

অন্যদিকে অনিয়মকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের নামে বেসরকারি কয়েকটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় রমরমা সনদ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে মাউশি ও মন্ত্রণালয়ের চক্র নিয়মিত উৎকোচ পাচ্ছে বলে ব্যাপক অভিযোগ আছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বিএড সনদ না নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কয়েকবার নির্দেশ দিলেও অনেক শিক্ষক তা মানেন না। মন্ত্রণালয়ের ২০০৮ সালের ১৫ মে জারিকৃত পরিপত্র অনুযায়ী শিক্ষকদের এমপিও সুবিধা পেতে বিএড সনদ থাকার বাধ্যবাধকতা আছে।

কম খরচ ও যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা থাকলেও সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজগুলোর অর্ধেকের বেশি আসন ফাঁকা। ১৪টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাত হাজার আসনের অর্ধেকও পূরণ হয় না। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের নিয়মিত পরীক্ষা দিতে হয় বলে এ অবস্থা বলে জানা যায়। এ সুযোগে বেসরকারি কলেজে ঝুঁকছেন শিক্ষকরা। যেখান থেকে জাল সনদ সহজে পাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। দেশজুড়ে এ রকম প্রায় একশ প্রতিষ্ঠান চালু আছে।

ঢাকা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মমতাজ শাহানারা বলেন, ‘আমাদের এখানে ক্লাস পরীক্ষা নিয়মিত দিতে হয়। আমরা একজন শিক্ষক কিভাবে শ্রেণিকক্ষে পড়াবেন, এসব নিয়ে এক বছরের ডিগ্রি কমপ্লিট করাই। শিক্ষকরা এগুলো করতে চান না বলে এখানে আসেন না।’

শিক্ষক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সনদ কেনার সত্যতা আছে। অনেক অসাধু শিক্ষক তা কেনেন। অনেকে বিএডের জন্য প্রতিষ্ঠান থেকে এক বছরের ছুটি না পাওয়ায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বিএড সনদ নেন।’ কয়েকটি শিক্ষক সংগঠনের দাবি, বিএড সনদেও বাণিজ্যরত ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দিলে জালিয়াতি ও জটিলতা কমবে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এমএইচএম

Wordbridge School
Link copied!