• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‌নিখোঁজরা কী আর ফিরবে-ই না?


বিশেষ প্রতিনিধি জানুয়ারি ৬, ২০১৭, ০১:৪৫ এএম
‌নিখোঁজরা কী আর ফিরবে-ই না?

রহস্যজনকভাবে ‘উধাও’ হয়ে যাচ্ছেন আস্ত একটা মানুষ! এসব ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তির বিষয়ে কোনো হদিসই দিতে পারছেন না তাদের স্বজন কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কোনো ধরনের পূর্বাভাস ছাড়াই ‘হাওয়ায়’ মিলিয়ে যাচ্ছেন তারা। নিখোঁজদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। 

শুধু গেল বছরই রহস্যজনক নিখোঁজ হয়েছেন শতাধিক মানুষ। তাদের মধ্যে গত ১১ মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ৮৮ জনকে তুলে নেওয়া হয়েছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। তারা ‘গুম’ না ‘নিখোঁজ’ হয়েছেন, নাকি নিজেরাই ‘আত্মগোপন’ করেছেন সে বিষয়েও স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। চলতি মাসে রাজধানী থেকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীসহ ৬ তরুণ ‘নিখোঁজ’ হন। একই সময়ে পাবনা মেডিক্যাল কলেজের দুই শিক্ষার্থীও ‘লাপাত্তা’। এ নিয়ে নতুন করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

তবে পুলিশের সন্দেহ, নিখোঁজ তরুণরা স্বেচ্ছায় কোনো ধর্মীয় উগ্রপন্থি সংগঠনের সঙ্গে যোগ দিয়ে থাকতে পারেন। কারণ গুলশান হামলার পর অনেক ‘নিখোঁজ’ ঘটনায় দেখা গেছে, স্বেচ্ছায় পালানো তরুণ জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে। 

এ বিষয়ে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, উগ্র-জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যারা ঘর ছেড়েছেন, তাদের বেশির ভাগই মাসের শুরুতে অথবা শেষে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। এমনকি নিখোঁজ হওয়ার আগে তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম সেই সন্দেহ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ওই কর্মকর্তা জানান, গুলশানসহ অন্য জঙ্গি আস্তানায় নিহত জঙ্গিদের সবাই স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়ে পালিয়েছিলেন।

এ বিষয়ে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, রহস্যজনকভাবে নিখোঁজদের বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। নিখোঁজদের নিজ এলাকা, স্বজন ও পরিচিতজনদের আবাসস্থলে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া প্রযুক্তির মাধ্যমেও নিখোঁজদের অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা করা হচ্ছে। 

এদিকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে আরও ২০ জনকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ‘র‌্যাব-পুলিশ পরিচয়ে’ তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই থেকে পরিবারগুলো সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি পুলিশসহ বিভিন্ন কার্যালয়ে গিয়ে ধরনা দিয়েছেন। 

প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন জায়গায় একাধিকবার সভা-সমাবেশ করে প্রতিবাদ জানিয়েছে। গুম হওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে র‌্যাব পরিচয়ে বাসা থেকে আদনানকে তুলে নেওয়া হয়। এরপর থেকে কোনো খোঁজ নেই তার। আদনান তেজগাঁও থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

নিখোঁজ আদনান চৌধুরীর বাবা রুহুল আমিন চৌধুরী বলেন, ডিসেম্বরের শীতের এক গভীর রাতে ‘র‌্যাব পরিচয়ে’ ছেলেটাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেল। বলেছিল, কিছুক্ষণ পরই ছেলেকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তিন বছর পেরিয়ে গেল। সেই ছেলে আর ঘরে ফিরল না। ছেলে আমার কোথায় আছে, সেই খোঁজও নেই; বেঁচে আছে কি মরে গেছে, তা-ও জানি না। 

অন্যদিকে প্রায় একই সময়ে নিখোঁজ ছাত্রদলের নেতা পারভেজ হোসেনের বাবা তো জানতেই পারলেন না তার ছেলে বেঁচে আছে, না মরে গেছে। তার আগেই তিনি মারা গেলেন। এ রকম নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন রহস্যজনক নিখোঁজ ও গুমের শিকার আরও অসংখ্য পরিবার। গুম হওয়া মাজহারুল ইসলামের ভাই মশিউর রহমান বলেন, আমাদের পুরো পরিবারের সুখ-স্বচ্ছন্দ আর আনন্দ হারিয়ে গেছে চিরতরে। মা এখনো গভীর রাতে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকেন ছেলে আসবে বলে। বৃষ্টি হলে মায়ের দুশ্চিন্তা হয়, ছেলে ভিজে গেল কি না। ভাইয়ের শোকে আমার বাবা-মায়ের অবস্থা এখন ভালো না। 

গুম হওয়া সবুজবাগ থানা ছাত্রদলের সভাপতি মাহাবুব হাসানের ভাই জাহিদ খান বলেন, ‘একেকটা গুম হওয়া পরিবারের কী কষ্ট, তা অন্য কেউ ভাবতেও পারবে না। একেকটা দিন যে কী দুঃসহ যন্ত্রণায় পার হচ্ছে, বলে বোঝানো যাবে না। আমাদের করের টাকায় চলা বাহিনীগুলো আমাদের ভাইদের গুম করলে আমরা কার কাছে বিচার চাইব?’

এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি গুপ্তহত্যা ও গুমের শিকার হয়েছেন। নিখোঁজের পর অনেক পরিবারই র‌্যাব-পুলিশের রোষানল থেকে বাঁচতে মুখ খুলতে চান না। এমনকি থানায় জিডিও করেন না। আবার র‌্যাব তুলে নিয়ে গেছে শুনলে থানা-পুলিশ জিডি কিংবা মামলা নিতে চায় না। কেউ জিডি বা মামলা করলেও লোক দেখানো ও ঢিলেঢালা তদন্তে সময় পার করে দেয় পুলিশ।

এ বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহিদুল হক বলেন, নিখোঁজের বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের সফলতা আছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। 

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের পরিচালক নাসিরউদ্দীন বলেন, কয়েক বছরে গুমের শিকারের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে ৮০ জনকে তুলে নেওয়া হয়েছে। আর এ-সংক্রান্ত খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিতও হয়েছে। 

এর মধ্যে ৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে, ৩ জনকে পরে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে, ১৮ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাকিদের কোনো খোঁজ নেই। ২০১৫ সালে গুম হন ৫৫ জন। পরে তাদের ৭ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়, ৫ জন ফিরে আসেন, লাশ উদ্ধার হয় ৮ জনের।

২০১৪ সালে গুম হন ৮৮ জন। তাদের ২৩ জনের লাশ উদ্ধার হয়, ১২ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়, গ্রেফতার দেখানো হয় ১ জনকে।

গেল বছর গুলশান ও শোলাকিয়া ট্র্যাজেডির পর সারা দেশে নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নিখোঁজদের তালিকা করে অনুসন্ধান শুরু করে তারা। কিন্তু দিন যত পেরিয়েছে অনুসন্ধান ততই ঝিমিয়ে পড়েছে। চলতি বছরের ২০ জুলাই সারা দেশে নিখোঁজ ২৬১ জনের তালিকা প্রকাশ করে র‌্যাব। 

এরপর সর্বশেষ ৯ আগস্ট নিখোঁজ ৭০ জনের একটি সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত ‘তালিকাভুক্ত’ কারোর-ই সন্ধান দিতে পারেনি আইন প্রয়োগকারী কোনো সংস্থা। এরই মধ্যে নিখোঁজদের তালিকা আরও দীর্ঘ হচ্ছে। সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শিক্ষার্থীসহ আরও ৯ জন ‘লাপাত্তা’ হয়েছেন। পরিবারের অভিযোগ, তাদেরকে সাদা পোশাকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে।

র‌্যাবের ‘তালিকাভুক্ত’ নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজে পাওয়া না গেলেও সম্প্রতি খোদ রাজধানী থেকেই ‘নিখোঁজ’ হয়েছেন ৬ তরুণ। এদের মধ্যে গত ১ ডিসেম্বর বনানী থেকে নর্থ সাউথের দুই সহপাঠীসহ জায়েন হোসাইন খান পাভেল, সাফায়েত হোসেন, মেহেদী হাওলাদার ও মোহাম্মদ সুজন নামে চার তরুণ একসঙ্গে নিখোঁজ হয়েছেন। 

আর ৫ ডিসেম্বর বনানী থেকে সাঈদ আনোয়ার খান নামে আরেক তরুণও নিখোঁজ হন। এর আগে গত ৩০ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মাটিকাটার বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফিরে আসেননি মোহাম্মদপুরের কেয়ার মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী ইমরান ফরহাদ। গত ৩০ নভেম্বর নিখোঁজ হন পাবনা মেডিক্যাল কলেজের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র তানভীর আহম্মেদ তনয়। আবার একই মেডিক্যালের আরেক শিক্ষার্থী জাকির হোসেন নিখোঁজ হন গত ৩ ডিসেম্বর। 

এদিকে গত ১৪ অক্টোবর ভোরে রাজধানীর ধানমন্ডি সিটি কলেজের সামনে থেকে ডা. ইকবাল মাহমুদ নামে এক ব্যক্তিকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। তার কোনো খোঁজ পাচ্ছে না পুলিশ। এরপর ২৪ অক্টোবর রাতে তারেক হোসেন (৩৫) নামে এক ব্যক্তিকে সাদা পোশাকের পুলিশ পরিচয়ে রাজধানীর উত্তরার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

দীর্ঘদিনেও খোঁজ মেলেনি যাদের : ২০০৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাতে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন ব্যবসায়ী লায়ন মোজাফফর আহমদ (৬৫)। এর আগের দিন ৮ সেপ্টেম্বর সকালে হাসপাতাল থেকে কর্তব্যপালন শেষে বাসায় ফেরার পথে নিখোঁজ হন ডা. নুশরাত। ২০১০ সালের ১৭ এপ্রিল কুড়িল বিশ্বরোড থেকে নিখোঁজ হন ঝালকাঠির রাজাপুর থানা যুবদল নেতা মিজানুর রহমান জমাদ্দার ও তার দুই সঙ্গী মুরাদ ও ফোরকান।

২০১০ সালের ২৫ জুন রাতে ঢাকা মহানগর ৪১ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ২০১০ সালের ৮ নভেম্বর গাজীপুর থেকে নিখোঁজ হন চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর আহলা করলডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম বাছা। ২০১০ সালের ২৩ নভেম্বর রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়া থেকে নিখোঁজ হন বরিশাল উজিরপুরের হাতরার সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন খান।

২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল বনানীর নিজ বাসার সামনে থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী। দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও তাদের কোনো খোঁজ মেলেনি।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!