• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আকাশছোঁয়া বিজয়ের দিন


নিজস্ব প্রতিবেদক মার্চ ২৬, ২০২০, ০৩:৪২ পিএম
আকাশছোঁয়া বিজয়ের দিন

ঢাকা : আজ ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। আজ থেকে ৪৯ বছর আগে ১৯৭১ সালের এই দিনে জাতির পিতা ও বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নের বীজ থেকে একটি অঙ্কুরের জন্ম হয়েছিল এই ঘোষণায়। তারপর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যায় ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের রক্তগঙ্গা পেরিয়ে ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে গৌরবময় অভিষেক হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। ২৬ মার্চ তাই এই ভূখণ্ডের মানুষের শৃঙ্খলমুক্তির দিন। আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে আকাশছোঁয়া বিজয়ের দিন।

রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সূচনার সেই গৌরব ও অহঙ্কারের দিন আজ। স্বাধীনতার ৪৯তম বার্ষিকী জাতির সামনে এসেছে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। পুরো পৃথিবীকে আতঙ্কিত করে সারি সারি লাশের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে করোনা ভাইরাস। সারা পৃথিবীই যেন এখন করোনায় আক্রান্ত, ভীত ও আতঙ্কিত জনপদ। বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে এক দেশ থেকে আরেক দেশ, প্রিয় ও আপনজনদের সঙ্গে একই ছাদের নিচে থেকেও করোনা সতর্কতা হিসেবে দূরত্ব বজায় রাখছেন এ দেশেরসহ পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ। এ দেশও করোনার থাবা থেকে মুক্ত নয়। দেশ স্পর্শকাতর পরিস্থিতির মুখোমুখি। একাত্তর সালে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। বিশ্বজুড়ে ভয়াল হয়ে ওঠা আজকের করোনাযুদ্ধেও জাতিকে রক্ষার দায়িত্ব আওয়ামী লীগ ও জাতির জনকের তনয়া এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকারের। ভাইরাসটি রোধে সরকার বৈশ্বিক ও নিজস্ব নীতিমালার ভিত্তিতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে।

জাতি আজ মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রখর চেতনায় প্রগতিবিরোধী শক্তিকে প্রতিহত করার অঙ্গীকারে প্রাণিত হবে কৃতজ্ঞ বীর বাঙালি। কেননা, হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে এই দিনে বিশ্বের বুকে স্বাধীন অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল তারা। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল এ ব-দ্বীপের মানুষ। তবে, করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও ঢাকার ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোসহ সব জাতীয় কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এর আগে স্বাধীনতা দিবসের সব কর্মসূচি বাতিল ঘোষণা করে। অন্য বছরের মতো বেসরকারি কোনো কর্মসূচিও আজ দিবসটি ঘিরে থাকছে না।

দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলাদা বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তারা দেশবাসীকে স্বাধীনতার শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস দিবসটি উপলক্ষে জাতিকে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছেন।

একাত্তরের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালিদের ওপর অতর্কিত হামলা চালালে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত হয়। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণেই সাত কোটি বাঙালিকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন। বজ্রকণ্ঠে জানিয়েছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তার এ ঘোষণার পর থেকেই পাকিস্তানি সামরিক জান্তা গণহত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন শুরু করে। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনারা নির্বিচারে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়ংকরতম গণহত্যা সংঘটিত করে।

১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর কাছে পাকিস্তনি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি বেসামরিক লোকজনের ওপর গণহত্যা শুরু করে। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল সব রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং সব সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা। সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। এর আগেই বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বাড়ি (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর) থেকে ইপিআরের ওয়্যারলেসে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন।

ইংরেজিতে ঘোষিত সেই ঘোষণায় তিনি বলেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর সর্বশেষ সেনাটিকে উৎখাত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’

বঙ্গবন্ধু একই সঙ্গে বাংলায় বার্তা পাঠিয়ে বলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ, দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোনো আপস নেই, জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রু বিতাড়িত করুন। সব আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাপ্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আমাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’

মুহূর্তের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এই ঘোষণা প্রচারিত হয়। তার স্বাধীনতার ঘোষণায় বীর বাঙালি ঘুরে দাঁড়ায় প্রতিরোধ সংগ্রামে। নগরে, জনপদে, গ্রামে গ্রামে মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়। অন্যদিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস গণহত্যা, গণধর্ষণ ও নির্মম নিপীড়ন চালাতে থাকে। ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার মুখে দাঁড়িয়েও বাঙালির প্রতিরোধ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে বিপুল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে থাকে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যেমন বলেছিলেন ‘বাঙালি জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ বীর বাঙালিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারে না, তা আবারও প্রমাণিত হয়।

সেই সময় বাস্তবতা ও নিরাপত্তাজনিত কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নথি সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তী সময়ে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে ঘোষণাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৮২ সালে সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র তৃতীয় খণ্ডে বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়,  ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে এ ঘোষণা দেন তিনি। যা তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রামে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা সেই রাতেই সাইক্লোস্টাইল করে শহরবাসীর মধ্যে বিলি করেন। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রথম পাঠ করেন আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!