• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আফগান রোমিও জুলিয়েট


নিজস্ব প্রতিবেদক ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৬, ০৮:০১ পিএম
আফগান রোমিও জুলিয়েট

সোনালীনিউজ ডেস্ক


‘কাছে এসো প্রিয়তমা আমার!
বুক চিরে তোমায় দেখাতে দাও,
যেখানে রয়েছে নগ্ন এই হৃদয় আমার!’
 

প্রতিটি দেশের সাহিত্যাঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে সেদেশের নর-নারীর প্রেমময় সম্পর্কের আখ্যান। দেশ-কাল ও সংস্কৃতি ভেদে সেই সম্পর্কের নানান মাত্রিকতা দেখা গেলেও সম্পর্কের মূল কিন্তু সেই সহজ প্রেমিক-প্রেমিকা। আফগানিস্তানের জাকিয়া এবং আলীকে তাদের ‘অবৈধ’ ভালোবাসার কারণে মোটামুটি সবাই চেনেন। সাহিত্য নয়, বাস্তব দুনিয়ার এই দুই প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে জাকিয়া হলো তাজিক বংশোদ্ভুত সুন্নি মুসলিম এবং আলী হাজারা গোত্রের শিয়া মুসলিম। একই ধর্মের দুটো মতবাদে বিশ্বাসী এবং দুটি ভিন্ন গোত্রের মানুষ হওয়ায় সমাজের দৃষ্টিতে তাদের দুজনার ভালোবাসা আজ ‘অবৈধ’। অনেকটা বিখ্যাত ইংলিশ সাহিত্যিক শেক্সপিয়েরের বিখ্যাত রোমিও-জুলিয়েট চরিত্রের আদল যেন তারা।

রড নর্ডল্যান্ড নামের এক সাংবাদিক আফগানিস্তানের এই রোমিও-জুলিয়েটকে প্রথম খুঁজে পেয়েছিলেন। এমন একটা অবস্থান তিনি তাদের পেয়েচিলেন যখন তাদের জীবনের শেষ হয়তো সম্মানজনক মৃত্যুর মধ্য দিয়েই হতে পারতো। রড এই প্রেমিক-প্রেমিকার সঙ্গে পরিচয় হবার পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন তাদের উপরে। এরপর সৌভাগ্যক্রমে ওই নিবন্ধ কিছু মানুষের দৃষ্টিগোচর হয় এবং আপাত সম্মানজনক মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান তারা। কিন্তু দুর্ভোগের তবু শেষ হয়নি।

নিজের নতুন বই ‘দ্য লাভারস’ শিরোনামটি নিয়ে রেড বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম আমার নিবন্ধের পরবর্তী এবং চূড়ান্ত অংশটি শেষ করবো এই ভাবে যে, কিভাবে মেয়েটির পরিবার রাতের আধারে মেয়েটিকে ছুরিকাঘাত করে। আমাদের সকলের উপর হামলা হতে পারতো সেসময়। এরপরই মূলত পৃষ্ঠা পরিবর্তন হবে। আর সাধারণত এভাবেই গল্পগুলো শেষ হয়। কিন্তু আমি আসলে ভুল ছিলাম এবং তাদের আসলে ওটা ছিল সূচনা মাত্র।’

বিশ্বাস এবং প্রিয়জনকে সঙ্গী করে তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় এবং বিচিত্র ঘটনার মধ্য দিয়ে তারা টিকে থাকার সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। রডের ভাষায়, ‘তারা প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত নয়। তারা কোনোদিন স্কুলেও যায়নি। তাদের দুজনের বয়সের পার্থক্য এক কিংবা দুই বছরের। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই দুজনের জীবনে কবিতা এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। অথচ তারা পড়তে বা লিখতেও জানে না, কিন্তু স্থানীয় জনপ্রিয় সঙ্গীতগুলোর সঙ্গে তারা জড়িয়ে ছিল।’

দ্য লাভারস বইটিতে রড নরল্যান্ডের জবানিতে আলীর মুখে গাওয়া একটি পশতুন রোমান্টিক গানের বর্ণনা জানা যায়। গানটি জাকিয়াকে উদ্দেশ্যে করে গেয়েছিলেন আলী। আর রড সেই গানটি নিজের ভাষায় অনুবাদ করে বইয়ে তুলে ধরেন।

‘কাছে এসো প্রিয়তমা আমার!
আমার বুক চিরে তোমাকে দেখাতে দাও,
যেখানে রয়েছে নগ্ন এই হৃদয় আমার!’

আলীর সঙ্গে জাকিয়ার সম্পর্কের একটা অদ্ভুত দিক হলো তাদের সাহিত্য রসবোধ। আলী তার নিজের লেখা পশতুন ভাষায় জাকিয়ার উদ্দেশ্যে গান শুরু করলেও ধীরে ধীরে পশতুন অঞ্চলের প্রাচীন রোমান্টিক চরিত্র হয়ে একেবারে বাইবেলের চারিত্রিক ব্যাখ্যাতেও চলে যান। এটা তাদের জীবনের আবেগঘন মুহূর্তের একটা বিরাট অংশ জুরেই আছে। আফগানিস্তানের মতো একটি দেশের একেবারে প্রত্যন্ত একটি অঞ্চলে এধরনের দৃশ্য সত্যিই বিরল।

জাকিয়ার জন্য তাদের সম্পর্ককে মেনে নিয়ে সামাজিক স্বীকৃতি দেয়া খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। কারণ তিনি সামাজিক সমস্যাগুলো জানতেন এবং এধরণের বিয়েতে কত বিপদ হতে পারে সেটাও তার অজানা ছিল না। আলী একদিকে শিয়া মুসলিম ও অন্যদিকে নিষিদ্ধ হাজারা গোত্রের মানুষ হওয়ায় জাকিয়ার পক্ষ থেকে নেয়া পদক্ষেপ যে সহজেই তার গোটা পরিবারের পক্ষে সম্মানহানিকর সেটাও তিনি জানতেন। এমনকি তারই পরিবারের সদস্যরা যে তাকে হত্যা করতে বিন্দুমাত্র চিন্তা করবে না এই বাস্তবতাও ছিল তার জানা।

আফগানিস্তানে এখনও একটি অদ্ভুত আইন জারি আছে। সেই আইন মোতাবেক পারিবারিক সম্মান বাঁচানোর জন্য পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্য যদি নারী সদস্যকে হত্যা করে তাহলে সর্বোচ্চ দুই বছরের সাজা হতে পারে আইনানুগ। দেশটিতে এমন অনেক ঘটনা আছে যেখানে পরিবারের মেয়েটিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার জন্য কয়েক বছর ধরে আদালতে মামলা চলতে থাকে। সবাই জানে যে, শেষমেষ আদালত ওই মেয়েটিকে হত্যার পক্ষেই রায় দেবে এবং নির্মম বাস্তবতা নিয়ে সেই মেয়েটিও অপেক্ষা করতে থাকে অবধারিত মৃত্যুর। বছরের পর বছর ধরে একই ঘটনা ঘটে আসছে আফগানিস্তানে।

দুজনার সম্পর্ক জানাজানি হওয়ার পর জাকিয়া এবং আলী জলদি বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। ওই ঘটনায় প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ হয়ে যান জাকিয়ার বাবা। রডের ভাষায় তার বাবার প্রতিক্রিয়া, ‘খোদার নামে শপথ নিয়ে বলছি, যা হয় হবে আমি আমার মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসতো। সে আমার শরীরের একটি অংশের মতো। কিভাবে একটি ছেলের সঙ্গে তাকে এভাবে চলে যেতে দেই?’ উল্লেখ্য যে, ২০০১ সালে থমসন রয়টার্সের করা এক জরিপে নারীদের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দেশ হিসেবে আফগানিস্তানকে চিহ্নিত করা হয়েছিল।

উষর মরুভূমির এক প্রান্তে উদাস তাকিয়ে থাকা জাকিয়া। ও প্রান্তে কান্নাবিজরিত কণ্ঠে একটি আফগান গান গাইছেন আলী। তাদের মধ্যিখানে সাংবাদিক রড়। আলীর কণ্ঠের সুর মরুভূমির লু হাওয়ার সংস্পর্শে আর তপ্ত বালুর উপরে দৃশ্যমান মরিচীকার হৃদয়বিদারক বিষন্নতা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। এভাবেই এই দুই প্রেমিক প্রেমিকার চোখের পাতায় সন্ধ্যা নামে, প্রকৃতির বুকে নেমে আসে ঠান্ডার এক তাজা আমেজ।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে জাকিয়া-আলীর জীবনের ঘটনা প্রকাশ হবার পর দেশে এবং বিদেশে সমান আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয় তারা। আফগানিস্তানের কয়েক প্রজন্মের চোখে অমর হয়ে যান তারা। এই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত এবং জরাজীর্ণ দেশের তরুণ-তরুণীরাও যে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে মৃত্যুকে মাথায় নিয়ে পথ চলতে পারে তার উদাহরণ জাকিয়া-আলী। শুধু পরিবারই নয়, দুটি বৃহত গোত্রের মানুষদের চোখ এড়িয়ে প্রতিটি দিন বাঁচতে হচ্ছে তাদের। অনেকবার দেশের বাইরে যাবার চেষ্টা করলেও পাসপোর্ট-ভিসা সংক্রান্ত জটিলতায় তারা সেটা পারেননি। তবুও আজও নিজেদের প্রেমের সাক্ষর সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে আফগানিস্তানের অজানা কোনো এক স্থানে সংসার পেতেছে তারা। হয়তো আগামীকালই কোনো এক ঝড়ে পন্ড হবে তাদের সংসার, তবু প্রতিটি মুহূর্ত তারা বেঁচে আছে পরবর্তী মুহূর্তে বেঁচে থাকার জন্য।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!