• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আর্থিক খাতে পাঁচ বিশৃঙ্খলা


নিজস্ব প্রতিবেদক জুন ২৬, ২০১৯, ০২:৫৭ পিএম
আর্থিক খাতে পাঁচ বিশৃঙ্খলা

ঢাকা : সারা বিশ্বে অর্থনীতির একটা নিয়ম আছে। তা হলো, যেখানে ঝুঁকি বেশি সেখানে রিটার্ন বেশি। ব্যতিক্রম শুধু এ দেশ। কম ঝুঁকিপূর্ণ সঞ্চয়পত্রে এখানে মুনাফা সবচেয়ে বেশি।

সার্বজনীন সত্য হলো, কোনো অর্থনীতিই বেশিদিন এমন অনিয়ম সহ্য করতে পারে না। অর্থনীতির এই বিপরীত চিত্র রক্তাক্ত করছে পুরো আর্থিক খাতকে। অথচ রাজনৈতিক কারণে অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলছে সরকার।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে সুদ ব্যয়। তাই ব্যাংকাররা দীর্ঘদিন ধরেই এর সুদহার কমানোর দাবি করে আসছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনা প্রতিবেদন বলছে, সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদ আর্থিক খাতে ৫ ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদহার বন্ড মার্কেট উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে স্বল্প মেয়াদে ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহ দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করে এখন বিপদে পড়েছে। নগদ টাকার সংকট থেকে বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে গেছে। নানা উদ্যোগ নিয়েও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি করা যাচ্ছে না।

দ্বিতীয়ত, সরকারের সুদ ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। আগামী অর্থবছরের জন্য সঞ্চয়পত্রের সুদ ব্যয় বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সুদ বাবদ বরাদ্দ রয়েছে ২৯ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ সরকারের ব্যয় হয়েছে ১৯ হাজার ১০৯ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনা মোতাবেক, ব্যাংকঋণের সুদহার কমতে বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে সঞ্চয়পত্র। দেশে ব্যাংকঋণের সুদহার কমছে না। সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারকরা সুদহার কমানোর পক্ষে। এ বিষয়ে একাধিকবার স্পষ্ট ঘোষণাও দেওয়া হয়। কিন্তু সুদহার কমেনি। বরং তা বাড়ছেই। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটেও সিঙ্গেল ডিজিট সুদহারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এটি কীভাবে সম্ভব হবে তা বলেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন বাজেটে ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংকের ওপর নির্ভরতা এবং সুদহার আরো বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। সর্বশেষ গত এপ্রিলের তথ্যমতে, প্রায় ২৩টি ব্যাংকের গড় সুদহার ডাবল ডিজিটে রয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক থেকে সরকার ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। নিজেদের তহবিল জোগানোর জন্য ব্যাংক বাধ্য হয়ে আমানত সংগ্রহে সুদহার বাড়াচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাংক ১১ থেকে ১২ শতাংশ সুদে আমানত নিচ্ছে। উচ্চ সুদে আমানত নিয়ে এর চেয়ে কম সুদে ঋণ বিতরণ সম্ভব নয়।

আমানতের সুদ হার কম থাকায় অনেক গ্রাহক ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নিয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন মোতাবেক, সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদের কারণে ক্যাপিটাল মার্কেটের কোনো স্থায়ী উন্নয়ন করা যাচ্ছে না। ক্যাপিটাল মার্কেট ডেভেলপমেন্টে এর নেতিবাচক প্রভাব আছে।

বাজেট উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত কয়েক বছর ধরেই সঞ্চয়পত্র খাত থেকে লক্ষ্যমাত্রার অতিরিক্ত ঋণ নিচ্ছে সরকার। সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৬ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা (লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা), ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫১ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা (লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা), ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৮ হাজার কোটি টাকা (লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা) এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ২৮ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা (লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা) ঋণ নেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে চলতি ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। কিন্তু সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়ার কারণে সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। গত নয় মাসে বিক্রি হয়েছে ৩৯ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা।

এদিকে, আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সঞ্চয়পত্রের ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাব পাস হলে নতুন হার কার্যকর হবে আগামী ১ জুলাই থেকে। ১০ শতাংশ কর নতুন করে যারা সঞ্চয়পত্র কিনবেন শুধু তাদের দিতে হবে নাকি আগে কেনা সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপরও দিতে হবে তা নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। তবে এর করও প্রত্যাহারের জন্য অনেকে দাবি করছেন।

জানতে চাইলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন মহলে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর দাবি করে আসছি। এ ব্যাপারে গভর্নরকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই। পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংকগুলো সংকট থেকে সহসা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।

অনেকে বলছেন, জনগণের করের টাকায় সমাজের উচ্চ শ্রেণিকে অবৈধ আয়ের সুযোগ করে দিচ্ছে সরকার। অথচ বলা হচ্ছে, সঞ্চয়পত্র সাধারণ মানুষের কাছে। কিন্তু মাত্র ৫ শতাংশ যাচ্ছে সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে। আর ৯৫ শতাংশ অর্থ যাচ্ছে বিত্তশালীদের হাতে। সরকার এ পর্যন্ত মোট ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটির টাকা ঋণ নিয়েছে এর মাধ্যমে।

বিত্তশালীদের মধ্যে বর্তমান ও সাবেক আমলা, পুলিশ, সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা ও বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারাই বেশি। সঞ্চয়পত্রে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ রয়েছে বর্তমান ও সাবেক আমলাদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এসেছে, কয়েকটি পেশার মানুষ নামে-বেনামে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন।

বর্তমানে সঞ্চয়পত্রগুলোর মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষে সুদহার ১১ দশমিক ৫২, পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশন সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ৭৬, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ২৮, তিন বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক শূন্য ৪ এবং তিন বছর মেয়াদি ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!