• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
আশাবাদী আয়োজন

আ.লীগের শুদ্ধি অভিযান


বিশেষ প্রতিনিধি মে ১৬, ২০১৯, ০৬:১৯ পিএম
আ.লীগের শুদ্ধি অভিযান

ঢাকা : দেশের বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ঐতিহ্যবাহী এ দলটি বর্তমানে ক্ষমতাসীনও। তাও টানা তৃতীয়বারের মতো। ২৩ জুন ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে নানা নাম পেরিয়ে দলটি বর্তমানে স্বরূপে। মাঝে গেছে কয়েকটি অধ্যায়। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নাম তার একটি। ১৯৭০ সাল থেকে এর নির্বাচনী প্রতীক নৌকা। একাত্তরে বাংলাদেশ জন্মের পর সংগঠনটি বর্তমান নাম পায়।

ঈর্ষণীয় এ দলটি নানা সময় নানা বাঁক পেরিয়েছে। কখনো ক্ষমতায় কিংবা এর বাইরে থেকেছে। ক্ষমতায় থেকেও দলে বিদ্রোহীদের দেখেছে। এভাবেই বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ যত বিপত্তি। আর বিপত্তির মূল কারণ আওয়ামী লীগার ভাব সেজে থাকা। ফায়দা হাসিলের জন্য আওয়ামী লীগার হয়ে যাওয়া। যা বর্তমানে দলে প্রকটভাবে বিদ্যমান বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত।

এর কারণও আছে। টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় থাকা দলটিতে নানা মতের ও পথের মানুষ আশ্রয় নেবে এটাই স্বাভাবিক। এর মাঝে অনেকের মত, ক্ষমতাসীন দলটি বিরোধীদের নানা সময় নিপীড়ন করে আসছে। ফলে ক্ষমতার ছায়ায় এসেছেন অনেকে। তারা সুবিধাভোগী। আধুনিক পরিভাষায় হাইব্রিড।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, যার পূর্ব নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট দলটির নিবন্ধন অবৈধ এবং একে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত, এ থেকেই আওয়ামী লীগে হাইব্রিড মানুষ বেড়ে গেছে। এ ছাড়াও জামায়াতের একাধিক যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। আওয়ামী লীগে হাইব্রিড বাড়ার পেছনে এও একটি কারণ।

সারা দেশ অর্থাৎ তৃণমূলের ক্ষমতায়নে আসতে নানা দল ও মতের মানুষ আওয়ামী লীগে আশ্রয় নেবে এটাই স্বাভাবিক। ফলে চলছে নানা কথা। অনেক কথা ঐতিহ্যবাহী এ দলটির সঙ্গে যায় না। ফলে একাধিক সময় দলটিতে শুদ্ধি অভিযানও চলেছে।

এমনই এক অভিযানে ক্ষমতাসীন দলটির সাংগঠনিক সফর শুরু হয়েছে গত ১১ মে শনিবার। দেশব্যাপী এই সফরে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অংশ নিয়ে সাংগঠনিক দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। পাশাপাশি হাইব্রিডদের হাত থেকে দলকে বাঁচাতে তৃণমূল নেতাদের সতর্ক থাকার বার্তা দেওয়া হচ্ছে। অনানুষ্ঠানিকভাবে হাইব্রিডদের তালিকা তৈরির কাজও শুরু হয়েছে বলে জানায় দলীয় একাধিক সূত্র।

সম্প্রতি হাইব্রিড এবং দলে অনুপ্রবেশ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলটিতে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম গত মাসে একাধিক সমাবেশে ভাষণে বলেন, এখন সবাই আওয়ামী লীগার হয়ে গেছে। এদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। বিএনপি-জামায়াত থেকেও ভয়ঙ্কর এই নব্য আওয়ামী লীগ। এরা সুযোগসন্ধানী। এদের চিনে রাখতে হবে। যাদের কখনো সভা-সমাবেশে দেখিনি তারাও এখন আওয়ামী লীগ করে। এদের থেকে সাবধান ও সতর্ক থাকতে হবে।

এর আগে একাধিকবার দলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, আওয়ামী লীগে কাউয়া ঢুকে গেছে। এই কাউয়া বলতে সুবিধাবাদী হাইব্রিডদেরই বুঝিয়েছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত, বিগত সময়ে একাধিক হাইব্রিড আওয়ামী লীগারই দলকে বেশি ধুঁকিয়েছে।

সর্বশেষ ফেনীর সোনাগাজীতে নুসরাত হত্যার ঘটনায় জড়িত সাবেক জামায়াত নেতাকে স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার সমর্থন দেওয়ার বিষয়টি সামনে আসায় হাইব্রিড ইস্যু গুরুত্বের সঙ্গে নিতে বাধ্য হয়েছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা।

দলের একাধিক সূত্র বলছে, হাইব্রিডরা আওয়ামী লীগে ভিড়তে শুরু করে ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পরপরই। প্রথমদিকে এ হার কম এবং সুবিধাবাদীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর তা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের আন্দোলনের নামে সহিংসতার সঙ্গে জড়িত জামায়াত-বিএনপির অনেক নেতা আওয়ামী লীগে ভিড়তে শুরু করেন নানা সময়ে।

সূত্রগুলো বলছে, ২০১৬ সাল এমনকি ২০১৭ সালেও বিএনপি-জামায়াতের এসব নেতাকর্মী আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতাদের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। নানা অঘটনের সঙ্গে জড়িত থাকার পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধও বাড়াতে থাকেন তারা।

এর পরিপ্রেক্ষিতে দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার এসব সুবিধাবাদী সম্পর্কে দলীয় নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন। ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিএনপি-জামায়াত থেকে কাউকে দলে নিতে নিষেধও করেন। কিন্তু এরপরও থেমে থাকেনি বিএনপি-জামায়াতের এক শ্রেণির নেতাকর্মীর আওয়ামী লীগে যোগদান।

এর পেছনেও নানা যৌক্তিক কারণ আছে। দেশের বৃহৎ এ দলটিতে মানুষের স্রোত থাকবেই। তা দুই অর্থেই, ভালো-মন্দ।

শেষোক্ত কারণে ২০১৭ সালে কেন্দ্র থেকে জেলা-উপজেলায় চিঠি দিয়ে জানানো হয়, জামায়াত-বিএনপি বা তাদের কোনো আত্মীয় আওয়ামী লীগে যোগ দিতে পারবে না। সর্বশেষ ফেনীর ঘটনায় কঠোর অবস্থা নেয় ক্ষমতাসীন দল।

অনেকেই বলছেন, ক্ষমতার বেশি স্বাদ পাওয়া দলকে গতিশীল এবং সাংগঠনিকভাবে মজবুত করতেই শীর্ষ নেতাদের সমন্বয়ে আটটি কমিটি গঠন করা হয়েছে সম্প্রতি। গত ৪ মে থেকে এ সফর শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে তা পেছানো হয়। পরে ১১ মে থেকে এ সফর শুরু হয়।

এখন দেখার পালা দলটির এমন শুদ্ধি অভিযান কতটা কাজে দেয়। অবশ্য শুদ্ধি অভিযান কাজ না দিলে দলের অতি উৎসাহীদের প্রভাব বাড়বেই। এ থেকে দল ক্ষতিগ্রস্তুও হবে এবং ক্রমশ তা হচ্ছেও।

অবশ্য দলের একাধিক নেতা বারবার বলে আসছেন মৌসুমিরা সুবিধা করতে পারবে না। একই সুর আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের।

তিনি বলেন, সুবিধাবাদী শ্রেণি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে তাদের অপরাধ আড়াল করতে পারবে না। অনেকে মামলা ও শাস্তি থেকে বাঁচতে অপরাধ লুকিয়ে যোগ দিলেও তারা রেহাই পাবেন না। আওয়ামী লীগ অনেক বড় দল। ইউনিয়ন পর্যন্ত এ সংগঠন বিস্তৃত। কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে কেউ পরিচয় আড়াল করে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাদের চিহ্নিত করে বিতাড়ন করার কাজ অনানুষ্ঠানিকভাবে আগে থেকেই চলছে। আসন্ন সাংগঠনিক সফর এবং সম্মেলনে এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব থাকবে।

অবশ্যই আশার কথা। দলটির সমর্থক এবং রাজনীতিসচেতন মানুষ এমনটাই প্রত্যাশা করেন। অন্তত বর্তমান শুদ্ধি অভিযানে মৌসুমিরা কোণঠাসা হবে। দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, হাইব্রিড কিংবা সুবিধাভোগীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সুবাদে যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতসহ অন্য কোনো দলের বিতর্কিত নেতারা কোথায় কোথায় অনুপ্রবেশ করেছে, সে বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। যাচাই-বাছাই শেষে এদের দল থেকে ছেঁটে ফেলা হবে।

তিনি বলেন, সাংগঠনিক সফরের মাধ্যমে সারা দেশে দলকে শক্তিশালী করার কাজ চলবে। দলের গতি বৃদ্ধি করা হবে। আর চলবে শুদ্ধি অভিযান। তিনি সম্প্রতি বলেছিলেন, দলে অনুপ্রবেশকারীরা বিশৃঙ্খলা ঘটায়। এদের চিহ্নিত করতে হবে।

এমন চিহ্নিতকরণের আশাবাদী আয়োজনের পর দলটি অন্তত অতীতের রূপ ফিরে পাবে এমনটাই মনে করছেন সবাই। দেখা যাক হাইব্রিড কিংবা মৌসুমিদের ভিড় কতটুকু কমাতে পারে সাংগঠনিক সফর; শুদ্ধির বর্তমান প্রক্রিয়া।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!