• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলি


সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন অক্টোবর ৪, ২০১৯, ০৩:০০ পিএম
আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলি

ঢাকা : মানুষ আল্লাহর পরিচয় জানতে পারেন তাঁর সবচেয়ে সুন্দর নামগুলো- আসমাউল হুসনার মাধ্যমে। আল্লাহ নিজেই তাঁর এসব নাম মানুষকে জানিয়েছেন।

কোরআনে আল্লাহর এসব নাম বর্ণিত হয়েছে। এসব নামের মাধ্যমে মুমিনরা আল্লাহতায়ালার সত্তা, তাঁর গুণাবলি ও সৃষ্টি সম্পর্কে জ্ঞান লাভের চেষ্টা করেন। আল্লাহতায়ালার ৯৯টি গুণবাচক নাম রয়েছে। এসব নাম তাঁর গুণের পরিচয় বহন করে। নামগুলোতে আল্লাহর গুণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে; যা মানুষের নিজের মধ্যে বিকশিত করা এবং এক অর্থে নিজের মধ্যে প্রতিবিম্বিত করার চেষ্টা করা প্রয়োজন।

এসব গুণের কোনোটিকে অস্বীকার করা তো কোনো ব্যক্তির মৌলিক ঈমান-আকিদাকে ধ্বংস করবেই, উপরন্তু তা ইসলামের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে পরিত্যাগ করার শামিলও। আল্লাহতায়ালার গুণবাচক নামগুলো কোরআনের কোনো নির্দিষ্ট অংশে বর্ণিত হয়নি, পবিত্র গ্রন্থের সর্বত্র এসব নাম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।

পবিত্র কোরআন এসব নাম সম্পর্কে মুমিনদের নির্দেশ দিয়েছে— ‘বলো : তোমরা আল্লাহকে ডাক আল্লাহ বা আল রহমান বলে, আল্লাহরই জন্য রয়েছে সর্বোচ্চ সুন্দর নামসমূহ।’ (১৭ : ১১০)।

আল্লাহর গুণগুলো উল্লেখ করে কোরআন আল্লাহর কোনোরূপ কল্পনা অথবা তার সদৃশ কিছু মনে করা, যা তাকে খর্ব বা নির্দিষ্ট আকারের মধ্যে সীমিত করতে পারে এমন যেকোনো চেষ্টাকে নিরুৎসাহিত করেছে। ‘কোন চোখ তাকে দেখতে পায়, অথচ সবকিছুই তাঁর দৃষ্টির আওতায়। তিনি সবকিছুর খবর রাখেন।’ (৬ :১০৩)।

এ আয়াতের সবশেষ দুটি শব্দে আল্লাহর দুটি গুণবাচক নাম উল্লিখিত হয়েছে : এ আয়াত থেকে দেখা গেছে, কাউকেই, এমনকি রসুল (সা.)-কেও আল্লাহতায়ালাকে চর্মচোখে দেখার অনুমতি দেওয়া হয়নি। কোরআন থেকে জানতে পারি যে, আল্লাহর নবী মুসা (আ.) আল্লাহকে দেখার চেষ্টা করেছিলেন।

যখন তিনি সত্যি সত্যিই মহান আল্লাহকে দেখার জন্য অনুরোধ করেন, তখন মুসা (আ.)-কে বলা হয় : ‘তুমি আমাকে দেখতে পাবে না, তবে পর্বতের দিকে দৃষ্টি ফেরাও, তুমি যদি পর্বতকে তার স্থানে স্থিতিশীল দেখতে পাও, তা হলে আমাকে দেখতে পাবে...।’ এ কাহিনীতে আরো বলা হয়, আল্লাহ যখন পর্বতের ওপর এসে দেখা দেন তখন (ওই দিকে তাকিয়ে) মুসা (আ.) জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। যখন তাঁর জ্ঞান আসে; তখন তিনি আল্লাহর প্রশংসা করেন; তওবা করেন এবং আল্লাহর প্রতি তাঁর ঈমানের সাক্ষ্য ঘোষণা করেন। (৭ : ১৪৩)।

এভাবে কোরআনের সাক্ষ্যপ্রমাণ আল্লাহর অলৌকিক সত্তার প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে; তিনি সম্পূর্ণভাবে মানবচিন্তার অতীত এবং মানুষের পক্ষে তার কোনো সংজ্ঞা দান অসম্ভব। এটি করার যেকোনো চেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। তাই শরিয়াহ আল্লাহর অসীম সত্তার ব্যাপারে যেকোনো ত্রুটিপূর্ণ ধারণা রোধের লক্ষ্যে তার সত্তা সম্পর্কে কোনো ধরনের আলোচনা করাকে নিরুৎসাহিত করেছে।

আল্লাহর সুন্দর নামগুলোর অর্থ যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে, ঠিক সেভাবেই তা গ্রহণ করতে হবে। এগুলো আক্ষরিক অর্থে আল্লাহর গুণাবলি প্রকাশ করেছে। অবশ্য কোরআনের কিছু আয়াতে মানবসত্তার কিছু দৃষ্টান্ত দেখা যায় (আল্লাহর চোখ, ১১ : ৩৭, তাঁর মুখ ৪ : ২৭, ইত্যাদি)। যা ধর্ম শাস্ত্র আলোচনার ক্ষেত্রে বিতর্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আশারিয়া, মুতাজিলা ও মাতুরদিয়া গ্রুপ, এ বিতর্কের যে মূল বিষয় উত্থাপন করেছে তা হলো— এ গুণের বাস্তবতা এবং আল্লাহর সত্তার সঙ্গে তার সম্পর্ক।

এ বিষয়ে আলেমরা যে বিতর্কিত গোষ্ঠীকে তীব্র নিন্দা করেছেন, সেটি হলো : ‘আহমিয়া। এ গোষ্ঠীটি হলো মুতাজিলা সম্প্রদায়ের একটি উপদল। এ দলটির শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব জাহম ইবনে সাফওয়ানের নাম অনুসারে এদেরকে জাহমিয়া নামকরণ করা হয়েছে। মূলত তিনি ছিলেন খোরাসানের অধিবাসী, বাস করতেন কুফা নগরীতে। তিনি উমাইয়া গভর্নর আল হারিস ইবনে গুরাইয়ার প্রধান খতিব ছিলেন। পরবর্তীকালে তাদের উভয়কে বিদ্রোহ করার অপরাধে ১২৮ হিজরিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে ‘আলেমরা’ এ মতকে কঠোর ভাষায় নিন্দা ও খণ্ডন করেছেন। তারা এ মত ব্যক্ত করেন যে, কোরআনে আল্লাহর যে গুণের বর্ণনা রয়েছে, তা আক্ষরিক অর্থে উপলব্ধি করতে হবে এবং এসবের যেকোনো দূরবর্তী বা প্রতীকী ব্যাখ্যা প্রদান অবশ্যই পরিহার করতে হবে।

কোরআনে আভাস দেওয়া হয়েছে— আল্লাহ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান হচ্ছে সরাসরি তার সৃষ্টি সম্পর্কিত জ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত কোরআনের অসংখ্য আয়াতে (২:২১৯, ৭:১১৭ ইত্যাদি)। আল্লাহর সৃষ্টির নিদর্শনের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে আল্লাহর অসীম জ্ঞান ও সর্বব্যাপকতার নিদর্শন ও সাক্ষ্য প্রতিফলিত হয়েছে। এভাবে আমাদের চারপাশের বিশ্ব সম্পর্কে অনুসন্ধান এবং সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে জ্ঞানার্জনে উৎসাহিত করা হয়েছে। এছাড়া এর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর গুণাবলি ও তার গুণবাচক নামগুলোর ব্যাপারে আমাদের উপলব্ধিকেও বৃদ্ধি করতে পারব।

যেহেতু মহাজগৎ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান অসম্পূর্ণ; তাই মহাজগতের স্রষ্টা সম্পর্কে জ্ঞান অবশ্যই একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং এ সম্পর্কে পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব নয়। আল্লাহর সত্তা সম্পর্কে ‘অনুসন্ধান’-এর প্রচেষ্টাকে অলস ও বিপজ্জনক এবং (আবাস ওয়া মুহলিকাহ) অসীম পাথারে তল খোঁজার চেষ্টা বলে উল্লেখ করে আবদুল্লাহ বলেন, এটি করা মানব সাধ্যের অতীত, এটি করা বিপজ্জনক; কেননা এতে ঈমানের ক্ষেত্রে ত্রুটির পথ প্রশস্ত হয়। আল্লাহর সত্তাকে সুনির্দিষ্ট করার চেষ্টা হচ্ছে— অসীমকে সীমার মাধ্যমে বাঁধার প্রয়াস, যা মূলত মহান আল্লাহতায়ালার সত্তাকে খর্ব করার শামিল।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

Wordbridge School
Link copied!