• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জল ঘোলা করেই স্বীকার করল ওয়াসা


বিশেষ প্রতিনিধি মে ১৮, ২০১৯, ০১:৩০ এএম
জল ঘোলা করেই স্বীকার করল ওয়াসা

ঢাকা : অবশেষে রাজধানী ঢাকার ৫৯টি এলাকায় নিজেদের সরবরাহ করা পানি দূষিত বলে স্বীকার করেছে ঢাকা ওয়াসা। এই প্রথম ওয়াসার দূষিত পানির বিষয়টি স্বীকার করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ঢাকার পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি। ঢাকার ৫৯টি এলাকার ওয়াসার পানি বেশি দূষিত বলে আদালতে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) হাইকোর্টের বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। বিষয়টি নিশ্চিত করে তিনি বলেন, ওয়াসার দেওয়া প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে ঢাকার ১০টি জোনে ৫৯ এলাকায় ওয়াসার পানি বেশি দূষিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এর আগে ১৫ মে বুধবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর ওয়াসার পানির ১০৬৫টি নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করতে ৭৫ লাখ ৬১ হাজার টাকা দরকার। এ ছাড়া ১৩ মে সোমবার ঢাকা ওয়াসার কোন কোন এলাকার পানি সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ, তা পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দাখিল না করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ঢাকা ওয়াসার পানি পরীক্ষায় যে অর্থ খরচ হবে, তা নির্ধারণ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে ১৫ মে বুধবারের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন আদালত।

অন্যদিকে ১৩ মে সোমবার ঢাকা ওয়াসার অনিরাপদ পানি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য ছিল। কিন্তু ওয়াসার পক্ষ থেকে বলা হয়, পানি পরীক্ষায় প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। তখন আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এ ছাড়া পানি পরীক্ষায় যে অর্থ খরচ হবে, তা প্রতিবেদন আকারে দাখিলের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। তখন ওয়াসার পক্ষ থেকে খরচ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিলে সাত দিন সময় চাওয়া হয়। কিন্তু এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন ১৫ মে বুধবারের মধ্যে দাখিলের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

এদিকে ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর বিশ্বব্যাংক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ অনিরাপদ উৎসের পানি পান করে। ৪১ শতাংশ পানির নিরাপদ উৎসগুলোতে রয়েছে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া। ১৩ শতাংশ পানিতে রয়েছে আর্সেনিক। পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করা পানিতে এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৮২ শতাংশ।

কিন্তু এসবের কিছুই মানছিল না ঢাকার পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াসা। একেক সময়ে এ নিয়ে তুঘলকি কাণ্ডও হয়েছে। অবশেষে জল ঘোলা করেই জলের নিরাপত্তা থাকা না থাকার বিষয়টি মানল প্রতিষ্ঠানটি। যদিও একেক সময় এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকাণ্ড হাসির খোরাক হয়েছে।

সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গবেষণা উপস্থাপন করে জানায়, ঢাকা ওয়াসার পানির নিম্নমানের কারণে ৯৩ শতাংশ গ্রাহক বিভিন্ন পদ্ধতিতে পানি পানের উপযোগী করে। এর মধ্যে ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে পান করে। গৃহস্থালি পর্যায়ে পানি ফুটিয়ে পানের উপযোগী করতে প্রতি বছর আনুমানিক ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাসের অপচয় হয়।

টিআইবির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সাড়ে ৫১ শতাংশ ব্যবহারকারী জানিয়েছেন, সরবরাহ করা পানি নোংরা। ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ ব্যবহারকারী জানিয়েছেন, এ পানিতে ভয়াবহ দুর্গন্ধ। সাড়ে ৩৪ শতাংশ ব্যবহারকারী জানিয়েছেন, সারা বছর ধরে ওয়াসার পানি নিম্নমানের। ৬২ দশমিক ১ শতাংশ ব্যবহারকারী জানিয়েছেন, গরমে পানির মান সবচেয়ে খারাপ হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দশকের পর দশক ধরে একই লাইনে পানি সরবরাহ করছে ওয়াসা। কোথাও এসব লাইন ক্ষয় হয়ে গেছে। ফুটো হয়ে পানি সরবরাহ লাইন পয়ঃনিষ্কাশন লাইন একাকার হয়েছে। টিআইবির সমীক্ষায় জানানো হয়, রাজধানীর ডায়রিয়া রোগীদের ৬৩ শতাংশ, জন্ডিস রোগীদের ৩৪ শতাংশ, চর্মরোগীদের ৩৭ শতাংশ, টাইফয়েড রোগীদের ১৯ শতাংশ ও কলেরা রোগীদের ১৩ শতাংশের জন্য দায়ী ওয়াসার পানি।

টিআইবির প্রতিবেদনে জানা যায়, সরকারি অন্যান্য বিভাগের মতো এখানেও দুর্নীতি রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন, মিটার রিডিং ও ক্রয়প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে অন্যান্য বিভাগের মতো স্বাভাবিকভাবে দুর্নীতি চলছে। সেবা নিতে গিয়ে গ্রাহকরা ২০০ টাকা থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিয়েছেন। পানির সংযোগ নিতে ২০০ থেকে ৩০ হাজার টাকা, পয়ঃনালা পরিষ্কার করতে ৩০০ থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা, গাড়ির মাধ্যমে পানি পেতে ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকা, এভাবে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ওয়াসার বিভিন্ন পর্যায়ে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দেওয়ার নজির পায় জরিপকারীরা।

অথচ গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রত্যাখ্যান করেছিল ঢাকা ওয়াসা। সংবাদ সম্মেলন করে তা প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেয় ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান। তিনি বলেন, ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয়।

এ ছাড়াও জানানো হয়, ওয়াসার বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা ২৫৫ কোটি লিটার। আর চাহিদা রয়েছে ২৫০ কোটি লিটার পানির। সুপেয় প্রসঙ্গেও মজার মজার কাণ্ড হয়েছে। সম্প্রতি ওয়াসার পানি দিয়ে শরবত বানিয়ে ওয়াসার এমডিকে খাওয়ানোর উদ্যোগ নেন জুরাইনের এক যুবক। এ বিষয়ে তিনি তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি স্ট্যাটাস দেন। ওই স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, ওয়াসার এমডির জন্য জুরাইনের ওয়াসার পানি দিয়ে লেবুর শরবত বানাইয়া ওনার অফিসে যাওয়ার প্রস্তাব রাখছি জুরাইনবাসীর কাছে...।

এমন হাস্যরসের জন্ম দেওয়া ওয়াসা পুরো এশিয়ার মধ্যে সেরা পানি পরিষেবা সংস্থা হতে চায়। নিজ ভিশনে এমনটাই লেখা আছে। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে লেখা রয়েছে, বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো ভারত-পাকিস্তানসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঢাকা ওয়াসাকে ‘রোল মডেল’ হিসেবে উপস্থাপন করছে। বাস্তবে ঢাকা ওয়াসার পানি পাওয়া এবং এর মান নিয়ে গ্রাহকের রয়েছে হাজারো অভিযোগ।

যদিও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ সুপেয় পানি পাওয়াকে মানুষের অধিকার হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০-এ ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে এটি রয়েছে ৬ নম্বরে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!