• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচলিত তরিকাসমূহের বর্ণনা


আমীন শাহ হামিদী ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২০, ১১:১৭ এএম
প্রচলিত তরিকাসমূহের বর্ণনা

ঢাকা : তরিকা শব্দটি আরবি তারিক শব্দ হইতে পরিগৃহিত হয়েছে, এর বাংলা অর্থ হলো পথ, রাস্তা ইত্যাদি। কিন্তু অবশ্যই বুঝতে হবে যে, এই পথ কোনো সাধারণ পথ নয় বরং মহান আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করার নিমিত্তে যে পথ অতিক্রম করা হয়ে থাকে মূলত সেই পথকেই তরিকা বলা হয়ে থাকে। ইসলামী আধ্যাত্মিক পরিভাষায় তরিকা হলো বেলায়েতের জ্ঞান অর্জন করতে আল্লাহর অলিগণের প্রবর্তিত বিভিন্ন সাধন পদ্ধতি, আর সে পথটির সিলসিলা বুঝতে হলে জানতে হবে যে, পবিত্র কোরআনের দিক নির্দেশনা এবং রাসুল (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বায়াতদের দিক-নির্দেশনার আনুগত্য করাই হচ্ছে মহান আল্লাহর নৈকট্য হাসিল অর্থাৎ পরিপূর্ণতায় পৌঁছানোর পথ। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘লাকাদ কানা লাকুম ফি রাসুলিল্লাহ্ উসওয়াতুন হাসানাহ...।’ অর্থাৎ আল্লাহর রাসুলের মধ্যেই রয়েছে তোমাদের জন্য সকল সুন্দরের আদর্শ।

রাসুল (সা.) কর্তৃক মদিনায় তৌহিদ বা মারেফাত অর্জনের যে শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার পথ চলা শুরু হয়েছিল পবিত্র কোরআন ও রাসুল (সা.)-কে আনুগত্যের মাধ্যমে। হজরত আলী (রা.) যেহেতু রাসুল (সা.)-এর একনিষ্ঠ বিশ্বস্ত এবং গোপন ভেদের আমিন ছিলেন তাই তাঁর পরে তিনিই দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি এই শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। তিনি স্বীয় জীবদ্দশায় বহু শিষ্য তৈরি করেছিলেন এবং রাসুল (সা.)-এর পরে তাঁর সকল শিষ্যই হজরত আলী (রা.)-এর শিষ্যে পরিণত হয়েছিলেন। হজরত  মোহাম্মদ  মুস্তাফা  (সা.)-কে  সুফিগণ প্রথম ও শ্রেষ্ঠ পীর বলে অভিহিত করেন এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানের মূল উৎস বলে মনে করেন। তাই বলা যায়, হজরত রাসুলে কারিম (সা.) হতেই সমস্ত তরিকার উদ্ভব।

হজরত নবী করিম (সা.) তাঁর বিশেষ কিছু সাহাবিকে মিনহাজ বা তাসাওউফ বা তত্ত্ব দর্শন শিক্ষা দান করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.), হজরত ওমর ফারুক (রা.), হজরত আলী (রা.), হজরত সালমান ফারসী (রা.), হজরত আবুজর গিফারী (রা.), হজরত আবু হোরায়রা (রা.), হজরত আবু আইয়ুব আনসারী (রা.), হজরত মিকদাদ (রা.), হজরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.), হজরত মাআ’জ (রা.) প্রমুখ। হজরত আবু বকর (রা.)-এর মাধ্যমে বর্তমানেও দুটি তরিকার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এই তরিকা দুটি হলো : নকশবন্দিয়া ও মুজাদ্দেদিয়া। হজরত ওমর (রা.)-এর মাধ্যমে প্রচারিত তরিকার বর্তমানে কোনো অস্তিত্ব নেই। হজরত সালমান ফারসী (রা.) ইয়ামেন অঞ্চলে তরিকত প্রচার করতেন। নকশবন্দিয়া ও মোজাদ্দেদিয়া তরিকার শাজারা মোবারকেও তাঁর নাম রয়েছে। হজরত আলী (রা.)-এর মাধ্যমে প্রচারিত তরিকার ওপর ভিত্তি করেই কাদেরিয়া ও চিশতিয়া তরিকাসহ বিভিন্ন তরিকা ও উপ-তরিকা বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে। তাঁর প্রচারিত তরিকা প্রধানত তাঁর পুত্রদ্বয় হজরত ইমাম হাসান (রা.) ও হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এবং বিশিষ্ট তাবেইন হজরত হাসান বসরী (রহ.)-এর মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। অন্যদের মাধ্যমে প্রচারিত কোনো তরিকার সন্ধান বর্তমানে তেমন পাওয়া যায় না। অবশ্য বিশিষ্ট তাবেইন হজরত ওয়াইস করনী (রহ.)-এর মাধ্যমে প্রচারিত ওয়াইসিয়া তরিকা বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে।

বিভিন্ন তরিকার নিয়মকানুন, আধ্যাত্মিক সুলুক ও তালিম সুসংগঠিত ও সুসংবদ্ধ হয় খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর দিকে। এর পূর্বে সুফিগণের আধ্যাত্মিক অনুশীলন মুখে মুখে চলে আসছিল। এ সময় (১০ম শতাব্দীতে) আধ্যাত্মিক সাধনার সুবিখ্যাত কুতুব ও প্রোজ্জ্বল পীর-মোর্শেদগণ বিভিন্ন তরিকা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সকল সুফি-পীর স্বীয় তরিকার ইমাম ও কুতুব হিসেবে পরিগণিত। কাল-কালান্তরে হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.), হজরত আলী (রা.) ও হজরত ওয়াইস করনী (রহ.)-এর তরিকার ওপর ভিত্তি করেই উল্লেখযোগ্য সুফি-সাধকগণের মাধ্যমে অনেক তরিকা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁদের সাধন পদ্ধতির পার্থক্যের কারণেই তরিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তরিকাসমূহের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলা দুষ্কর। কারো মতে, তিন হাজার বা ততোধিক। এ সকল তরিকার মধ্যে বহুসংখ্যক তরিকা অবলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে প্রায় চারশ তরিকার সন্ধান পাওয়া যায়।

ভারতবর্ষে তিন শতাধিক তরিকার মধ্যে বহুল পরিচিত তরিকাগুলি হলো— কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া ও মোজাদ্দেদিয়া। নিম্নে এই ৪ তরিকার সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো :

কাদেরিয়া তরিকা : কুতুবে রব্বানী গাউসে ছামদানী বড়পীর হজরত সৈয়দ মহিউদ্দিন আবু মুহাম্মদ আবদুল কাদির জিলানী (রহ.) এই তরিকার প্রবর্তক। হজরত বড়পীর (রহ.)-এর নামানুসারে তাঁর উদ্ভাবিত ও প্রচারিত তরিকার নাম— কাদেরিয়া তরিকা। রাসুলুল্লাহ (সা.) হতে শুরু করে তরিকাতে খেলাফত প্রাপ্ত চতুর্দশ পুরুষ হলেন গাউসুল আজম হজরত বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী (রহ.)। কালেমা তাইয়্যেবা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ যথা : লাম, আলিফ, আলিফ, লাম, হা, আলিফ, লাম, আলিফ, আলিফ, লাম, লাম, হা নোক্তাবিহীন এই ১২টি বর্ণের তালিম কাদেরিয়া তরিকার খাস তালিম। এই নোক্তাবিহীন ১২টি হরফের মধ্যে দুনিয়ার সমস্ত রহস্য লুকায়িত রয়েছে। এই ১২টি হরফই বিশ্ব জগতের মূল কারণ ও উৎস। তৌহিদের প্রকৃত রূপও এই কালেমা। নোক্তাশূন্য বর্ণ দিয়ে কেন কালেমার সৃষ্টি, তা গভীর রহস্যে নিমজ্জিত। এই কালেমাকে জানলে, চিনলে ও সঠিকভাবে গবেষণা করে পড়লে তার নিকট সকল রহস্যের দ্বার উন্মোচিত হয়ে যায়। এই কালেমা বিশ্ব মহীরুহের মূল ও নূরে মুহাম্মদীর মূল উৎস। এই তালিম না পাওয়া পর্যন্ত কেউ কাদেরিয়া তরিকার সুফি-সাধক ও পীর হওয়ার যোগ্য হন না। যিনি এই কালেমার রহস্য জানেন তিনি আরেফ বিল্লাহ ও অলিয়ে কামেল-এর মর্যাদায় আসীন হন। এইরূপ জ্ঞানী সম্পর্কেই বলা হইয়াছ : ‘মান কলা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুখলিছান দাখালাল জান্নাতা’। অর্থাৎ ‘যে তাহকিক (গবেষণা) করে জীবনে একটি বারের জন্যও কালেমা পাঠ করেছে, তার জন্য দোজখের আগুন হারাম।’

এই কালেমা শরিফ প্রথমত দুই ভাগে বিভক্ত। এর এক ভাগ ফানা ও এক ভাগ বাকা। ফানাকে নুজুল (অবরোহ) ও বাকাকে উরুজ (আরোহ)ও বলা হয়। কীভাবে এই কালেমার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, কালেমা সাবেত করতে হবে— তা সুফি-সাধক ও পীর-মোর্শেদগণ ব্যতীত সাধারণ শুষ্ক আলেমগণ (আরবি ভাষায় বিদ্বান) বলতে পারেন না।

হজরত নবী কারিম (সা.) এ কালেমার বিশেষ তালিম হজরত আলী (রা.)-কে প্রদান করেছিলেন। তিনি এই তালিম তাঁর খলিফা হজরত হাসান বসরী (রহ.)-কে দান করেন। তাঁর নিকট হতে গাউসুল আজম হজরত আবদুল কাদির জিলানী (রহ.)-এর নিকট আসে। এ কালেমার রহস্য তাঁর নিকট আসার পূর্ব পর্যন্ত এর তালিম সিনা-ব-সিনা আসত। কিন্তু তিনি এই তালিমকে সুবিন্যস্ত করে লিখিত আকারে গুপ্তভাবে বিশেষ মুরিদানকে দান করেন। এতদ্ব্যতীত এই তরিকার অন্যান্য পদ্ধতিও তিনি সুসংবদ্ধ করেন।

তরিকার নিয়মানুসারে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পরে অজিফা পাঠ, বিশেষ দরুদ শরিফ, নফি-এসবাতের জিকির ও মোশাহাদা করতে হয়। মুরিদের মনের অবস্থা ও পরিবেশ বা পারিপার্শ্বিকতা ভঙ্গ করে জিকিরে জলি বা জিকিরে খফি উভয় প্রকার জিকির করার নিয়ম এ তরিকায় রয়েছে। কাদেরিয়া তরিকাভুক্ত অনেক উপ-তরিকা রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান ও আদি নয়টি উপ-তরিকা রয়েছে- যথা : হাবিবিয়া, তারফুরিয়া, কারখিয়া, সকতিয়া, জুনায়দিয়া, গাজর দিদিনিয়া, তুরতুসিয়া, কারতুসিয়া ও সোহরাওয়ার্দিয়া। এ তরিকাভুক্ত জুনায়েদিয়া উপ-তরিকা মতে সামারও প্রচলন রয়েছে।

কাদেরিয়া তরিকার সাধনা কোনো লতিফার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। বরং খোদাপ্রেমিকের যে স্থানে আল্লাহ শব্দের প্রভাব পড়বে, সেখানেই জিকির জারি হয়। সেখান হতে তা সমস্ত শরীরে শিহরিত হয়। অতঃপর সেখানে বিশেষ অবস্থা ও নূরসমূহ বিচ্ছুরিত হওয়ার পর তাজাল্লী বা আলোক প্রভার বিকিরণ এবং ঊর্ধ্ব জগতের ভ্রমণ সংঘটিত হয়। ফলে এমন আবেগের উত্থান এবং অবস্থার পর্যায়ক্রমিক উন্নতি সাধিত হয়, যা বলা বা লেখা যায় না। মোর্শেদের তাওয়াজ্জুহ ব্যতীত সালেকের এই পথে সফল হওয়া খুবই কঠিন। যখনই এই সকল বিশেষ অবস্থার উন্নতি সাধিত হয়, তখনই মোর্শেদ তাকে নিজের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বলে উন্নততর মনজিলে পৌঁঁছার পথ নির্দেশ করেন। প্রকৃত মকসুদে পৌঁছার পথ বাতলে দেন। সালেক চলার পথে যখনই ধীরে ধীরে নুরানি জগতে অগ্রসর হয় এবং বিশাল বিশাল ভয়ানক সমুদ্র অতিক্রম করবার পর জাতি তথা মূল নুরের প্রভাবে ফানার মাকামের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তখনই মূল সত্তার দরিয়ায় ডুবে যায়। সমুদ্রের মতো যার কিনারায় মূলের মূল, শাখার শাখা বিভিন্ন পর্যায়ে ওয়াহ্দাতুল ওজুদ বা অস্তিত্বের একত্বের অলি-গলিতে ঘুরিতে থাকে। এরই মধ্যে শাহে লা-তায়াইউন বা অসীম অমূর্ত বা নির্বস্তুক জগতের আবির্ভাব ঘটে, যার কূল-কিনারা নাই।

চিশতিয়া তরিকা : চিশতিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা ইমাম সুলতানুল হিন্দ খাজায়ে খাজেগান গরিবে নেওয়াজ হজরত খাজা মঈন উদ্দিন হাসান চিশতী সানজরী (রহ.)। কাদেরিয়া ও চিশতিয়া এই উভয় তরিকারই উদ্ভব ঘটেছে হজরত আলী (রা.) হতে। চিশতিয়া তরিকার শাজারা অনুযায়ী রাসুলুল্লাহ (সা.) হতে শুরু করে হজরত আলী (রা.) হতে হজরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী  (রহ.) খেলাফত প্রাপ্তির সপ্তদশ খলিফা। খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (রহ.) শরিয়তের সকল বিধি-নিষেধ পালনের প্রতি সর্বদা সজাগ থাকতেন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই শরিয়তের কোনো ব্যত্যয় তিনি সহ্য করতেন না। তিনি ভক্ত-অনুসারীদিগকে শরিয়তে পাবন্দ থাকার জন্য কঠোর নির্দেশ দিতেন। এমনকি চিশতিয়া তরিকার অনুসারীগণ যেন কখনো শরিয়তের বরখেলাপ না করতে পারে, সেই জন্য আহলে চিশতের পরিপালনীয় একটি অজিফা রচনা করে হজরত খাজা কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রহ.)-কে প্রদান করেছিলেন; যা হজরত কাকী (রহ.)-এর স্ব-রচিত ‘দলিলুল আরেফীন’ গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়ে বিধৃত হয়েছে।

আহলে চিশতের জন্য প্রদত্ত এই অজিফা দানকালে তিনি বলেন, ‘বুজুর্গানে দিন হতে আমি যে অজিফা লাভ করেছি, তা পালনে সুদৃঢ় রয়েছি। মনে রেখো, রাসুল (সা.) বলেছেন : ‘তারিকুল বিরদি মালউন অর্থাৎ অজিফা ত্যাগকারী অভিশপ্ত।’

এভাবেই তিনি তাঁদেরকে সুফি দর্শনের গূঢ় রহস্যপূর্ণ বিষয়গুলি সম্পর্কেও দীক্ষা প্রদান করতেন। চিশতিয়া তরিকায় নিজকে জানার বা দেহ তত্ত্বের তালিম গ্রহণের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এ তালিমের চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত কেউ এ তরিকায় কামালিয়ত অর্জন করতে পারে না বা তার পক্ষে সুফি-দরবেশ পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। দেহ তত্ত্বের প্রধান সাধনা হলো আনাসির-এ-খামসা বা পঞ্চভূত (পঞ্চ উপাদান)। এ সাধনার গুরু হজরত মোহাম্মদ (সা.)। তাঁর নিকট হতে হজরত আলী (রা.), হজরত আলী (রা.) হতে হজরত হাসান বসরী (রহ.) এ তালিম লাভ করেন। সিনা-ব-সিনা চলিয়া আসা এ তালিম হজরত ওসমান হারুনী (রহ.)ও লাভ করেন। এই তালিমগুলি লিপিবদ্ধ ছিল না। হজরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী (রহ.) তালিমগুলো সুশৃঙ্খলভাবে লিপিবদ্ধ করেন।

চিশতিয়া তরিকা মতে আব, আতশ, খাক, বাদ ও নুর যথাক্রমে পানি, আগুন, মাটি, বায়ু এবং নুরকে আনাসির-এ-খামসা বা পঞ্চ উপাদান নামে অভিহিত করা হয়। সমুদয় সৃষ্টি জগতের মূল উৎস এ পঞ্চ উপাদান। সমুদয় জড় বস্তু ও প্রাণী দেহে ‘আনাসিরে আরবায়া’ বা চার উপাদান যেমন পানি, আগুন, মাটি ও বায়ুর সংমিশ্রণ ঘটিয়াছে। আর চার উপাদানের মূলে রয়েছে নুর বা এক জ্যোতির্ময় সত্তা। প্রত্যেক উপাদানে রয়েছে পাঁচটি গুণ বা সিফাত। এটি আবার তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। যথা:

১. আহাদিয়াত : এ স্তরে মহিমান্বিত আল্লাহ আপনাতেই বিদ্যমান এবং অতি সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম দরিয়া রূপে রয়েছেন। এ পর্যায়ে তিনি একক ও অদ্বৈত।

২. ওয়াহিদাত : এ স্তরে তিনি তাঁর ইরাদা বা আকাঙ্ক্ষা বা এশক (প্রেম) হতে নুরে মুহাম্মদী (সা.) সৃষ্টি করেন।

৩. ওয়াহেদিয়াত : এ স্তরে নুরে মোহাম্মদী (সা.) হতে তিনি নিজেকে বিশ্ব চরাচর সৃষ্টির সঙ্গে ‘আহমদ’ রূপে প্রকাশ করেন। এ কারণেই কোরআনের পূর্বে সকল ধর্মগ্রন্থে হজরত মোহাম্মদ (সা.)-কে ‘আহমদ’ উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ‘আহাদ’ এবং ‘আহমাদ’-এর মধ্যে ‘মীম’-এর পার্থক্য কেবল হামদ্ ও নাতের জন্য।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য পিক্ততে সেই সুরই ধ্বনিত হয়েছে এই ভাবে—

আহমদের ঐ মীমের পর্দা উঠিয়ে দেখ মন

আহাদ সেথায় বিরাজ করে হেরে গুণীজন\

যে চিনতে পারে রয় না ঘরে হয় সে উদাসী

সে সকল ত্যাজি ভজে শুধু নবীজীর চরণ\

এ তালিমকে ‘মান আরাফা নাফসাহু’-এর তালিমও বলা হয়। এ তালিম রপ্ত না করা পর্যন্ত কেউ প্রকৃত সুফি বা চিশতিয়া তরিকার পীর হওয়ার যোগ্য নন।

চিশতিয়া তরিকায় সামা প্রচলিত রয়েছে। মাঝে মাঝে এ তরিকাপন্থিগণ সামার অনুষ্ঠান করেন। এতে তারা জজবার হালতে পৌঁছেন। সামার দ্বারা আল্লাহর প্রেম বর্ধিত হয়। তাই চিশতিয়া তরিকার মাশায়েখগণ সামাকে ‘রুহানী গেজা বা আত্মার খোরাক’ বলেন। একইভাবে চিশতিয়া তরিকায়ও কালেমা তাইয়্যেবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ যথা : লাম, আলিফ, আলিফ, লাম, হা, আলিফ, লাম, আলিফ, আলিফ, লাম, লাম, হা নোক্তাবিহীন এই বারোটি বর্ণের খাস তালিমের বিধান রয়েছে। এ তরিকার প্রধান দুটি উপ-তরিকা হলো: প্রধান খলিফা সুলতানুল মাশায়েখ হজরত নিজাম  উদ্দিন  (রহ.)-এর  নামানুসারে  ‘নিজামিয়া’  ও  অন্যতম  খলিফা  হজরত মখদুম আলী কালিয়ারী (রহ.)-এর নামানুসারে ‘সাবেরিয়া’ পৃথিবীতে অদ্যাবধি রয়েছে।

নকশবন্দিয়া তরিকা : নকশবন্দিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা হজরত শেখ খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দ আল-বোখারী (রহ.)। এ তরিকা মূলত হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) কর্তৃক উদ্ভাবিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) গোপনভাবে হজরত আবু বকর (রা.)-কে ইলমে মারেফাতের যে খেলাফত দান করেছিলেন, তা অদ্যাবধি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন তরিকা, উপ-তরিকার মাধ্যমে জারি রয়েছে। নক্শবন্দিয়া তরিকা এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর গোপন তালিম হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর মাধ্যমে পীর বা খলিফা পরম্পরায় সিনা-ব-সিনায় ইমামে তরিকত শামসুল আরেফিন হজরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.) পর্যন্ত খেলাফত প্রাপ্তির ষোড়শ স্তর পৌঁছেছে।

নকশবন্দিয়া তরিকার গুরুত্বপূর্ণ তালিম হলো ছয় লতিফা এবং চার উপাদান তথা আব, আতশ, খাক, বাদ অর্থাৎ পানি, আগুন, মাটি ও বাতাস প্রভৃতির ওপর মোরাকাবা করা। ছয় লতিফা : কালব, রুহ, ছের, খফী, আখফা, নফস প্রভৃতির ওপর সাধনার প্রতিক্রিয়া পরিচালিত হয়। এ ছাড়াও পঞ্চ হাযরা তথা সায়ের ইলাল্লাহ, সায়ের ফিল্লাহ, সায়ের আনিল্লাহ, আলম-এ-মিসাল, আলম-এ-শাহাদাত প্রভৃতির ওপর মোরাকাবা করবার নিয়ম-পদ্ধতি এই তরিকায় বিদ্যমান রয়েছে। নকশবন্দিয়ার তালিম রাসুলুল্লাহ (সা.) হতে সিনা-ব-সিনায় হজরত বাহাউদ্দিন নক্শবন্দিয়া (রহ.)-এর নিকট পৌঁছলেও পূর্বে তা লিপিবদ্ধ আকারে ছিল না। হজরত বাহাউদ্দিন নক্শবন্দ (রহ.) তা সুশৃঙ্খলভাবে লিপিবদ্ধ করেন।

নক্শবন্দিয়া সাধকগণ আহাদিয়াত, ওয়াহিদাত ও ওয়াহেদিয়াতের স্তরে পরিভ্রমণ করেন। ওয়াহিদাত ও ওয়াহেদিয়াত স্তর দুটি উপনীত হচ্ছে সায়ের ইলাল্লাহতে। আলমে আমর ও আলমে খালক একই স্তরে অবস্থিত। আহাদিয়াতের স্তর কেবলই সায়ের ফিল্লায় অবস্থিত।

নকশবন্দিয়া তরিকা মতে ৮টি বিষয়ের ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়, যথা :

১. হুঁশদম : শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রতি খেয়াল রাখা। ২. নেগাহ্ বর কদম : পীরের পদাঙ্কানুসরণ করা। ৩. সফর দার ওয়াতন : দেহ রাজ্যে পরিভ্রমণ করা। ৪. খিলওয়াত দার আঞ্জুমান : চুপি চুপি বাক্যালাপ। ৫. ইয়াদ কার্দান : সার্বক্ষণিক জিকিরে মশগুল থাকা। ৬.  বাজগশত : আল্লাহর প্রতি ধাবিত হওয়া। ৭. নেগাহ দাশ্ত : আল্লাহতে অন্তর্দৃষ্টি নিবন্ধ রাখা। ৮. ইয়াদ দাশ্ত বা খোদগোজাশ্ত : নিজকে নিঃশেষ করে আল্লাহতে চির জাগ্রত রাখা। এ তরিকা মতে নিচু স্বরে জিকির স্বীকৃত। এই তরিকার কোনো কোনো উপ-তরিকায় সামা জাতীয় গজলের প্রচলনও রয়েছে।

উল্লেখ্য, নকশবন্দিয়া তরিকার শাজারা মোবারকে ১৬তম পুরুষ ইমামুত তরিকত হজরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.)। কিন্তু ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম এই পবিত্র তরিকা প্রচার-প্রসার শুরু করেন হজরত খাজা রাজি উদ্দিন মুহাম্মদ বাকি বিল্লাহ (রহ.)। তিনি এই তরিকার ২২তম পুরুষ। তিনি স্বীয় পীর-মোর্শেদ হজরত মাওলানা খাজাগী আমাকনগী (রহ.)-এর নির্দেশে এই তরিকার প্রচার-প্রসারের উদ্দেশ্যেই ভারতবর্ষে আগমন করেছিলেন। তখন তাঁর সফর সঙ্গী ছিলেন তাঁর স্ত্রী ও মহীয়সী মাতা। হজরত বাকি বিল্লাহ (রহ.)-এর পবিত্র মাজার শরিফ নতুন দিল্লি রেল স্টেশনের নিকটে নবী কারিম সড়কের একটি টিলার ওপর অবস্থিত।

মোজাদ্দেদিয়া তরিকা : মোজাদ্দেদিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা হজরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী ইমামে রব্বানী কাইয়ুমে জামান শায়েখ আহমদ সেরহিন্দী (রহ.)। এই তরিকা মূলত নক্শবন্দিয়া তরিকা হইতে উদ্ভূত। তাই উভয় তরিকার সাধন-ভজন প্রায় একই রকম। উভয় তরিকাই রাসুলুল্লাহ (সা.) হতে হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত সালমান ফারসী (রা.)-এর মাধ্যমে আগত। হজরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী (রহ.) খেলাফত প্রাপ্তির ২৩তম খলিফা।

মোজাদ্দেদিয়া তরিকা মতে ছয় লতিফা, চতুর্ভুজ এবং পাঁচ হাজার মোরাকাবা বা অনুশীলন অত্যাবশ্যক। হজরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী (রহ.) পঞ্চ হাযরাকে নতুন নিয়মে সাজান। নক্শবন্দিয়া তরিকা মতে সায়ের ইলাল্লাহ, সায়ের ফিল্লাহ এবং আনিল্লাহর স্থলে হজরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী (রহ.) কিছুটা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেন। তিনি সায়ের ইলাল্লাহকে বেলায়েতে সোগরা বা ক্ষুদ্রতম বেলায়েত এবং সায়ের ফিল্লাহকে বেলায়েতে কুবরা বা বৃহত্তম বেলায়েত নামকরণ করেছেন। আহাদিয়াতের স্তরকে তিনি পূর্বেকার স্তর হতে ২০/২২টি ঊর্ধ্বস্থিত স্তর বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বেলায়েতে উলিয়া বা ঊর্ধ্বস্থিত বেলায়েতকে তিনি নবুয়তের পর্যায়ভুক্ত বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সালেক এই ২০/২২টি মাকামের মধ্য দিয়া আহাদিয়াতের স্তর অতিক্রম করে বাকাবিল্লাহ বা কাইয়ুমিয়াত লাভ করেন।

লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

Wordbridge School
Link copied!