• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বড় ধাক্কায় বিএনপি


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ২৭, ২০১৯, ০৩:০৭ পিএম
বড় ধাক্কায় বিএনপি

ঢাকা : বিএনপিকে বড় ধরনের রাজনৈতিক ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে। দীর্ঘ ৪১ বছরে এমনটি হয়নি। এবার দলটির চেন অব কমান্ডের শৃঙ্খলায় টান পড়েছে। দলীয় প্রতীক, জেল-জুলুমে দগ্ধ নেতাকর্মীর শ্রম আর কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ব্যয় করে যাকে এমপি নির্বাচিত করেছেন তিনি পল্টি দিয়েছেন। দলীয় আদেশ অমান্য করে সংসদে যোগ দিয়েছেন। একই পথে হাঁটছেন বাকিরাও, যা দলের শেকড় ধরে টান দিচ্ছে। দলের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ পল্টিবাজদের ‘গণদুশমন’ আখ্যা দিয়েছেন। ওদের ব্যাপারে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিতে দলের নীতিনির্ধারকরা তাকিয়ে আছেন লন্ডনে তারেক রহমানের দিকে।

এদিকে একাদশ সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত ৬ সদস্যের শপথগ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘিরে বিএনপিতে চরম অস্থিরতা চলছে। শপথ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ঠাকুরগাঁও-৩ (পীরগঞ্জ-রানীশংকৈল) আসন থেকে নির্বাচিত এমপি জাহিদুর রহমান বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) শপথ নেওয়ায় দলের বিশৃঙ্খলা আরো বেড়েছে। অন্য ৫ জনের মধ্যে ৪ সদস্য শপথ নেওয়ার পক্ষে আছেন। তারাও অপেক্ষায়। শুধু দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের শপথের বিষয়টি অনিশ্চিত। শপথের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আগেই আরো সদস্যের শপথগ্রহণ এবং দল থেকে বহিষ্কার হতে পারেন এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অভাবনীয় ফল বিপর্যয়ের পর দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে বিএনপি। একদিকে নির্বাচিত এমপিদের অধিকাংশই শপথ নিয়ে সংসদে যোগ দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেন, অন্যদিকে নির্বাচনে পরাজিত সিনিয়র নেতাসহ অনেকেই সংসদে যোগ দেওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নেন।

বিশেষ করে ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক গণফোরাম থেকে নির্বাচিত এমপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদের পর অপর নেতা মোকাব্বির খান শপথ নেওয়ায় সংসদে যাওয়ার বিষয়ে আরো আগ্রহী হয়ে ওঠেন বিএনপির বিজয়ী এমপিরা। নির্বাচিতদের আগ্রহ দেখে দলের নীতিনির্ধারকরা স্থায়ী কমিটির বৈঠক করে শপথ না নেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। পাশাপাশি সিদ্ধান্ত অমান্য করলে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়।

কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত অমান্য করে বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিএনপি থেকে নির্বাচিত ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের সাংসদ জাহিদুর রহমান শপথ নিয়েছেন। জাহিদুর রহমানকে শপথ গ্রহণ করান স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। এর আগে সকালে জাহিদুর রহমান শপথ নেওয়ার বিষয়ে তার আগ্রহের কথা জানিয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি লেখেন।

তিনবার নির্বাচন করে পরাজিত হওয়ার পর এবারই প্রথম নির্বাচিত হওয়া জাহিদুর রহমান শপথগ্রহণ করে সাংবাদিকদের বলেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শপথ নিয়েছেন। দল এজন্য তাকে বহিষ্কার করলেও করতে পারে। এটি জেনেই শপথ নিয়েছেন। দল বহিষ্কার করলেও তিনি বিএনপিতে আছেন এবং থাকবেন। সংসদে তার প্রথম কাজ হবে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি চাওয়া। বিএনপির এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘এলাকার মানুষের প্রচণ্ড চাপ আছে। তাদের একটাই বক্তব্য- শপথ নিয়ে ঢাকা থেকে ফিরে আসেন। তাই দলের সিদ্ধান্তের বাইরেই শপথ নিয়েছেন।’

শপথের বিষয়ে দলের কোনো পর্যায়ে কথা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে কথা হলেও নতুন করে হয়নি। দল কোনো প্রকারের সম্মতি দেয়নি। শপথ না নেওয়ার বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধন্তে আছে দল।’ দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে মাঠে লড়াই করছেন। এবার নিয়ে চতুর্থবার নির্বাচন করেছেন। এই আসনটি বিএনপির ছিল না। স্বাধীনতার পর থেকে এ আসনটি আওয়ামী লীগের। এই প্রথম বিএনপি জয়ী হতে সক্ষম হয়েছে।

এদিকে জাহিদুর রহমানের শপথের বিষয়ে বিএনপিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতাকর্মীরা জাহিদকে বেইমান আখ্যা দিয়ে তাৎক্ষণিক বহিষ্কার দাবি করেছেন। এছাড়া এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা কী তা জানতে দুপুরের পর থেকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর কাছে গেছেন উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। তবে বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) সন্ধ্যা পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কোনো নির্দেশনা দেননি। তারেক রহমানের নির্দেশনা অনুযায়ী দলের নীতিনির্ধারকরা বসে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন বলে কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে নেতাকর্মীদের জানানো হয়েছে।

এদিকে জাহিদুরের শপথের এক ঘণ্টা পর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন কর্মসূচিতে এর প্রতিক্রিয়া জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, কে কোথায় শপথ নিল বা নিল না, সেটা বিষয় নয়। দলের সিদ্ধান্ত ছাড়া নেত্রীকে জেলে রেখে কেউ যদি শপথ নেয় তাহলে তারা জাতীয়তাবাদী শক্তির পক্ষে থাকতে পারে না। তারা হলো গণদুশমন এবং জনগণই সময়মতো তাদের বিচার করবে। মহাসচিব ছাড়া অন্য চার সদস্য দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে শপথ নেবেন বলে জাহিদুর আভাস দিলেও নির্বাচিতরা গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রকাশ্যে কিছু বলেননি।

জানা গেছে, বিএনপি থেকে নির্বাচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের আমিনুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের হারুন উর রশিদ, বগুড়া-৪ আসনের মোশাররফ হোসেন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উকিল আবদুস সাত্তার শপথ নেওয়ার পক্ষে তাদের অবস্থানের কথা একাধিকবার দলীয় ফোরামে জানিয়েছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তাই শেষ পর্যন্ত নিজেদের মতের পক্ষেই তারা অবস্থান নিতে পারেন। তবে বগুড়া-৩ আসন থেকে নির্বাচিত দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে শপথ নেবেন না। মহাসচিবের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রের দাবি, শপথের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দলের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য মহাসচিব চেষ্টা করবেন। সফল না হলে দলের সিদ্ধান্ত মেনে শপথ নেওয়া থেকে বিরত থাকবেন।

প্রসঙ্গত, সংবিধানের ৬৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, সংসদের প্রথম বৈঠকের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে শপথ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে সদস্যপদ বাতিল করে আসন শূন্য ঘোষণা করা হবে। একাদশ সংসদের প্রথম বৈঠক বসে এ বছরের ৩০ জানুয়ারি। এই হিসাবে ২৯ এপ্রিলের মধ্যেই নির্বাচিত সদস্যদের শপথগ্রহণ করতে হবে। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে যেসব সাংসদ শপথ গ্রহণ করেছেন, আইন অনুযায়ী তাদের সদস্যপদ থাকবে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক আছে।

এ বিষয়ে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো সাংসদ নির্বাচনের পর সাংসদ পদে থাকার অযোগ্য হবেন কিনা কিংবা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোনো সাংসদের আসন শূন্য হবে কিনা, এ সম্পর্কিত কোনো বিতর্ক দেখা দিলে বিষয়টির শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠানো হবে এবং এ ক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।

৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তবে সংসদে তার আসন শূন্য হবে।

এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সুলতান মনসুর, মোকাব্বির খান ও জাহিদুর রহমান দল থেকে পদত্যাগ করেননি। সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার সুযোগও তাদের নেই। তবে তারা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সংসদে যোগ দিলে এবং ওই অবস্থায় দল তাদের বহিষ্কার করলে পরিণতি কী হবে, সে বিষয়ে সংবিধানে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। কিন্তু গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বলা আছে, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে হলে দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থাকতে হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!