• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের টালবাহানা

ভিন্ন কৌশলে সরকার


বিশেষ প্রতিনিধি সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৯, ০৩:১০ পিএম
ভিন্ন কৌশলে সরকার

ঢাকা : রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের উপায় খুঁজতে ও তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরানোর বিষয়ে ‘ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসি’ বা অনানুষ্ঠানিক কূটনীতিতে নামছে আওয়ামী লীগ।

দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরাতে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়ার কথা বিদেশে গিয়েও অনানুষ্ঠানিক কূটনীতির মাধ্যমে তুলে ধরবে ক্ষমতাসীন দলের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল। তুলে ধরা হবে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে দুই দফায় বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের নাটকের কথাও।

রোহিঙ্গাদের ফেরাতে নতুন যেসব কৌশলের পরিকল্পনা ও রূপরেখা প্রণয়ন করছে সরকার, সেগুলোর বাস্তবায়নে সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করবে আওয়ামী লীগ। প্রয়োজনে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সরকারের পরামর্শে প্রভাবশালী কয়েকটি দেশে ও জাতিসংঘ সফর করে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি করে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করবে প্রতিনিধিদল।

ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশে প্রতিনিধিদলের সফরের পরিকল্পনা চলছে।

ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গেও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে সরকার মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের জন্য যা যা করেছে এবং বর্তমান পরিস্থিতি বৈঠকে তুলে ধরে তাদের মিয়ানমারে ফেরাতে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর আরো জোরালো সমর্থন চাওয়া হবে বৈঠকে। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি কর্মপরিকল্পনাও চূড়ান্ত করা হচ্ছে বলে জানায় সূত্র।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বসংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, প্রত্যাবাসনের দুই দফায় তারিখ নির্ধারিত হলেও একজন রোহিঙ্গাও নিজ দেশে ফিরে যায়নি। গত ২২ আগস্ট দ্বিতীয়বারের মতো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ঝুলে যায়। একজনও মিয়ানমারে ফিরে না যাওয়ায় সরকারের কারো কারো মধ্যে কিছু উদ্বেগের জন্ম হচ্ছে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগও রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরো সতর্ক।

আরো জোরদার ও নতুন কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে তাদের দেশে ফেরানোর যেসব প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার, সেগুলোতে সরকারকে সহায়তা করতে অনানুষ্ঠানিক কূটনীতি করছে আওয়ামী লীগ।

এর অংশ হিসেবে দলের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল গত ৪ সেপ্টেম্বর আট দিনের সফরে চীনে গেছে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) আমন্ত্রণে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবদুল মতিন খসরুর নেতৃত্বে দলের ২০ সদস্যের প্রতিনিধিদল দেশটিতে সফর করছেন।

চীন সফরের আগে আবদুল মতিন খসরু এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এই সফরকালে প্রতিনিধিদল সিপিসি নেতাদের সঙ্গে দেখা করে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করবে। আলোচনায় রোহিঙ্গা সংকট ও মিয়ানমারে তাদের প্রত্যাবাসন ইস্যুও থাকবে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, ‘ট্র্যাক টু বা সেকেন্ড ট্র্যাক কূটনীতি হলো কোনো দেশের সরকারি উদ্যোগকে সহায়তা করতে বেসরকারি পর্যায়ে রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের কার্যক্রম। অনানুষ্ঠানিক কূটনৈতিক তৎপরতা এ দেশে প্রায় সময়ই চলে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এটা করে থাকে নানা সময়ে। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে বিদেশিদের সঙ্গে নানা রকম দেন-দরবার শুরু হয় রাজনৈতিক দলগুলোর। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় তা নতুন কিছু নয়।’

তিনি বলেন, ‘অনানুষ্ঠানিক কূটনীতির ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গটি ভিন্ন। মানবিক বিবেচনায় তাদের সরকার দেশে আশ্রয় দিলেও মিয়ানমারে তাদের ফেরানোর বিষয়টি জটিল হয়ে ওঠার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। এসব বিষয়ে সরকারকে দেশে ও বিদেশে সহায়তা করতে আওয়ামী লীগ ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসি করছে।’

দলীয় সূত্র জানায়, অনানুষ্ঠানিক কূটনীতির পাশাপাশি একাদশ জাতীয় সংসদে যেসব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব আছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সেসব দলকে নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি গঠনের পরিকল্পনা চলছে। এতে সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মহাজোট ও ১৪ দলীয় জোটের শরিকরাও থাকবে।

সরকারবিরোধী প্রধান দল বিএনপি সংসদে থাকলেও দলটি সর্বদলীয় কমিটিতে থাকবে কি না, এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের অনেকের সংশয় আছে। বিএনপির বিষয়ে সন্দিহান হলেও দলটির নেতৃত্বের ঐক্যফ্রন্টের শরিক গণফোরামের দুই সংসদ সদস্য সর্বদলীয় কমিটিতে থাকতে পারেন বলে কেউ কেউ আশাবাদী।

সংসদে না থাকলেও আওয়ামী লীগের আদর্শিক মিত্র ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিকে কমিটিতে রাখা যায় কি না, এমন পরিকল্পনাও করছেন কমিটি গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কেউ কেউ।

রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) থেকে অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদের চতুর্থ অধিবেশন চলাকালে এ কমিটি গঠন হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি গঠন প্রসঙ্গে চলতি বছরের শুরুর দিকে সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়েও পরিকল্পনা ছিল। বিষয়টি নিয়ে একাদশ সংসদের এক অধিবেশনে আলোচনাও হয়। সংসদে এমন কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।

আওয়ামী লীগের অভিযোগ, শুধু বিদেশিরা নন, দেশের ভেতরে অনেকেই রোহিঙ্গাদের নানাভাবে মদদ দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করছে তারা। মিয়ানমারে ফিরে না যেতে রোহিঙ্গাদের বিভ্রান্ত করছে। বিষয়গুলোর দিকে সরকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগও নজর রাখছে।

অপরাজনীতির জবাব দিতে ও রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য বোঝাতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঠে থাকতে দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শিগগিরই নির্দেশ দেওয়া হবে। একই সঙ্গে দলের নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি গঠন হলে রোহিঙ্গাদের নিয়ে সরকারবিরোধী পক্ষের অপরাজনীতি ঠেকাতে মাঠে থাকবেন কমিটির সদস্যরাও।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরাতে প্রথমে তাদের মাঝিদের (দলনেতা) রাখাইনের পরিস্থিতি দেখিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যেতে উৎসাহী হবে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছে। তাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ কোনো বার্গেনিং এজেন্ট না। তাদের নিজ দেশে গিয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে হবে।’

তথ্যমতে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থি রাখাইনদের নিষ্ঠুর নির্যাতনের মুখে দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা।

সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর ওই রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ। আগের পালিয়ে আসাসহ বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন ১১ লাখের বেশি।

২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা-ঢলের শুরু থেকে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত খোলা রাখে সরকার। মিয়ানমারের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাসস্থানের জন্য বনভূমিসহ প্রায় ছয় হাজার একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়।

শুরুতে কারো মুখাপেক্ষী না হয়ে সরকার এসব রোহিঙ্গার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের পাশাপাশি খাবার, ওষুধ ও পানিসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণ করে আসছে। পরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা নেয় সরকার। পাহাড়ের ওপরে ঝুঁকিতে থাকা রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নিতে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ভাসানচরে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!