• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভেঙে পড়ছে ব্যাংকের মূলধন কাঠামো


বিশেষ প্রতিনিধি জুন ৩০, ২০১৯, ১০:০৮ পিএম
ভেঙে পড়ছে ব্যাংকের মূলধন কাঠামো

ঢাকা : তফসিলি ব্যাংকগুলোর মূলধন কাঠামো ভেঙে পড়ছে। ধারাবাহিকভাবে দুর্বল হচ্ছে ব্যাংকের মূলধন ভিত্তি। এতে সামনের দিনগুলোয় ব্যাংকগুলোর টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। কিন্তু অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি আর দক্ষতার অভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আ হ ম মুস্তফা কামাল ঘোষণা দেন, খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না। কিন্তু তার ঘোষণার কার্যকারিতা মেলেনি।

সর্বশেষ হিসাবমতে, খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা, যা এ যাবৎকালের রেকর্ড। খেলাপি ঋণের উচ্চ হারের কারণে দেশের ব্যাংক খাতে বড় অঙ্কের প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) রাখতে হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রভিশন সংরক্ষণের হার বেড়েছে।

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের সঙ্গে প্রভিশন ঘাটতি আরো বেড়েছে। গত মার্চ শেষে সরকারি-বেসরকারি খাতের ১৪টি ব্যাংক ১১ হাজার ৬৫২ কোটি টাকার ঘাটতিতে পড়েছে। তিন মাস আগে এসব ব্যাংকের ঘাটতি ছিল ৯ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতি রেখে সাধারণভাবে কোনো ব্যাংক লভ্যাংশ দিতে পারে না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্র্রীয় ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদন নিয়ে লভ্যাংশ দিয়ে যাচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংক।

আমানতকারীদের সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে ঋণের শ্রেণিমান বিবেচনায় ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত হারে প্রভিশন রাখতে হয়। সাধারণ ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে শুরু করে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখার নিয়ম রয়েছে। আর যথাসময়ে আদায় না হওয়া নিম্নমান, সন্দেহজনক এবং মন্দ বা ক্ষতিমানে শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে যথক্রমে ২০, ৫০ ও ১০০ ভাগ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। ব্যাংকগুলোর মুনাফা থেকে এ অর্থ রাখতে হয়।

সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি প্রভিশন ঘাটতি কীভাবে ব্যাংকের মূলধন কাঠামোকে ভেঙে দিচ্ছে, তা জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে চিঠি দিয়েছে।

জানা যায়, যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বাড়ে, প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তত বেড়ে যায়। গত ডিসেম্বরের তুলনায় মার্চে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা বেড়ে এক লাখ ১০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকায় উঠেছে। গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা।

প্রভিশন ঘাটতি থাকলে ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্য খরচ বেড়ে যায়। দেশের বাইরে ‘নস্ট্রো’ অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রেও সমস্যায় পড়তে হয়। এ বিবেচনায় কয়েক ধাপে প্রভিশন রাখার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে ঘাটতি থাকা অবস্থায় লভ্যাংশ দেওয়ার সুযোগদানের ফলে দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে ৬৭ হাজার ৭০ কোটি টাকা প্রভিশন রাখার প্রয়োজন ছিল। তবে সংরক্ষণ করতে পেরেছে ৫৮ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। এতে ব্যাংক খাতে প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা। এ সময়ে ১৪টি ব্যাংকে বিপুল অঙ্কের ঘাটতি থাকলেও অনেক ব্যাংকে আবার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি প্রভিশন রেখেছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি এ পর্যায়ে এসেছে। তিন মাস আগে গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর ঘাটতি ছিল ৬ হাজার ৬১৪ কেটি টাকা।

মার্চ শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ৮৭৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যা তাদের বিতরণ করা ঋণের ৩২ দশমিক ২০ শতাংশ। এর আগের প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৪৮ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের বিতরণ করা ঋণের ২৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ১১ হাজার ৮১০ কোটি টাকা বেড়ে মার্চ শেষে ৪৯ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা হয়েছে। এসব ব্যাংকের মোট ঋণ ৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে এসব ব্যাংকের ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ ছিল খেলাপি।

মার্চ শেষে বিদেশি ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ২৫৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ৬ দশমিক ২০ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে ছিল ২ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা, যা ছিল ৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ চার হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা অপরিবর্তিত রয়েছে। ব্যাংক দুটির বিতরণ করা ঋণের ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ খেলাপি।

প্রভিশন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে বরাবরের মতো সর্বোচ্চ ঘাটতি রয়েছে ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে আলোচিত বেসিক ব্যাংকের। ব্যাংকটির ঘাটতি সামান্য বেড়ে তিন হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের ঘাটতি ২৫৩ কোটি টাকা বেড়ে তিন হাজার ৩৪১ কোটি টাকা হয়েছে। অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি ৫৯৩ কোটি টাকা থেকে এক হাজার ৩৫২ কোটি টাকায় ঠেকেছে। রূপালী ব্যাংকে ৮৩৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৪৫ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘাটতি কয়েক গুণ বেড়ে ৬৮৮ কোটি টাকা হয়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে ছিল মাত্র ১৯১ কোটি টাকা। পর্যায়ক্রমে ঢাকা ব্যাংকের ৩৫৩ কোটি, ট্রাস্ট ব্যাংকের ৩৬১ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক-এসআইবিএল ২৭৫ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ২৭০ কোটি, এবি ব্যাংক ১৮৬ কোটি, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক ১২৫ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ১০৩ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ৭৫ কোটি ও প্রিমিয়ার ব্যাংকে ৮০ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, এসব ব্যাংক খেলাপি ঋণের উচ্চ হারের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে পারেনি। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে চলতি বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৮ সাল শেষে ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমে অর্ধেক দাঁড়িয়েছে। যে পরিস্থিতি চলছে এর থেকে উত্তরণ না হলে জুন মাস শেষে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা মুনাফায় বড় ধরনের ধাক্কা আসবে।

সূত্রমতে, দেশে বর্তমানে ৫৯টি তফসিলি ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে বেসরকারি বাণিজ্যিক, রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিদেশি খাতের ব্যাংক রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে উদ্যোক্তারা মূলধন জোগান দেওয়ার কথা। সেটি না করে উল্টো তারা মুনাফা তুলে নিতে ব্যস্ত থাকেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন জোগান দিয়ে থাকে সরকার। তবে বিদেশি ব্যাংকগুলো শক্ত মূলধন কাঠামোর আওতায় পরিচালিত হচ্ছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিতভাবেই ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম নিয়ে প্রতিবেদন করে থাকে। যেসব ক্ষেত্রে সরকারকে জানানোর দরকার সেসব ক্ষেত্রে জানানো হয়ে থাকে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!