• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মামলা থাকলে কি চাকরি হয়?


মতিন সরকার মিশুক এপ্রিল ১৫, ২০১৯, ০৫:১৩ পিএম
মামলা থাকলে কি চাকরি হয়?

ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংলিশে অনার্স-মাস্টার্স করে ভাল একটা সরকারি চাকরির স্বপ্নবুকে এতদিন প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছেন আলী আহমদ রোমান ভাই। কিছুদিন আগে জনতা ব্যাংক এর সিনিয়র সহকারী আফিসার পদে পরীক্ষা দিয়ে ভাইবা উত্তীর্ণ হয়েছেন সফলভাবে।

স্বপ্ন পুরণের আগ মূহূর্তে বাঁধ সাধলো ২০১৩ সালে তার নামে দায়ের হওয়া সন্ত্রাস দমন আইনের একটি মামলা। রোমান ভাই প্রায়ই আমার সঙ্গে পরামর্শ করতে আসেন, চোখে-মুখে সে কি হাহাকার, ধিক্কার এবং অসহায়ত্ব! ভাষায় ব্যক্ত করার মত নয়। রোমান ভাইয়ের মত এমন অসংখ্য লোকের একই প্রশ্ন “স্যার, মামলা থাকলে কি চাকরি হবে?”

বর্তমানে, সরকারি, আধা-সরকারিসহ বিভিন্ন ব্যাংকের চাকরিতে চূড়ান্ত নিয়োগের পূর্বে শক্ত-পোক্ত পুলিশ ভেরিফিকেশন করা হয়। কোনো কোনো সরকারি চাকরিতে ৩ স্তর বিশিষ্ট ভেরিফিকেশন করা হয় পুলিশ, এসবি এবং এনএসআই এর স্বমন্বয়ে। দুর্ভাগ্য বশতঃ আপনি যদি কোনো ফৌজদারী মামলায় অভিযুক্ত হয়ে থাকেন সে ক্ষেত্রে হাতে পেয়েও হাত ছাড়া হতে পারে চাকরি নামের সোনার হরিণ।

তবে, মামলা থাকলেই চাকরি হবেনা এটা একটা ভুল ধারণা। চাকরিতে প্রবেশে মামলা কোন বাধা কিনা সেটা প্রথমত মামলার ধরনের উপর নির্ভর করে।

কোন মামলা চাকরির পথে বাঁধা নয়?
আপনার নামে যদি কোন দেওয়ানী মামলা থাকে তবে চাকরিতে এর কোন প্রভাব পড়বে না। দেওয়ানী মামলা বলতে সহজে বুঝি সেসব মামলাকে যেখানে কোন অধিকার, পদ-পদবী বা জমি-জমার বিষয় জড়িত থাকে। তবে টর্ট এর মামলা দেওয়ানী ও ফৌজদারী উভয় প্রকৃতির। যেমন, মানহানির মামলা। কিছু কিছু চাকরিতে দেওয়ানী আদালত কর্তৃক দেওলীয়া বা ঋণখেলাপী হিসাবে চিহ্নিত হইলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

যে মামলায় চাকরি হয়না :
মুলত ফৌজদারী প্রকৃতির মামলাই হচ্ছে চাকরির জন্য অভিশপ্ত মামলা। ফৌজদারী মামলা বলতে এক কথায় বুঝি সেসব মামলাকে যে মামলা দায়ের হয় অপরাধবৃত্তির বিচারের স্বার্থে। যেমন, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, রাহাজানি, অপহরণ, ধর্ষণসহ বিভিন্ন গণশান্তি বিরোধী অপরাধ সমূহ।
এসব মামলার পরিধি এতই বিস্তৃত যে লিখে শেষ করা যাবে না। প্রতিনিয়ত এই তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন সব অপরাধ! ফোজদারী মামলার গর্ভধারিণী বলা হয় ১৮৬০ সনের বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনকে। তথ্য প্রযুক্তি আইন, সন্ত্রাস দমন আইন, মাদক আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ইত্যাদি আইন সমূহ ফৌজদারী অপরাধকে দিন দিন নতুনত্ব দিচ্ছে।

অনেক আইন বিশারদ সহজে বলেন যে, যেসব অপরাধের জন্য বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৫৩ ধারায় ফৌজদারী আদালত সাজা দিতে পারে তাই ফৌজদারি মামলা। এসব অপরাধে বর্ণিত ধারায় ৫ প্রকার শাস্তির বিধান আছে।
যেমন:
১। মৃত্যুদন্ড
২। যাবজ্জীবন কারাবাস
৩। কারাবাস (সশ্রম/ বিনাশ্রম)
৪। সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ
৫। অর্থদন্ড

চলমান বা বিচারাধীন মামলার ক্ষেত্রে চাকরি:
আইন আদালত যে সূত্রের উপর নির্ভর করে চলে তার একটা হচ্ছে “ All person are innocent unless proven guilty” অর্থাৎ স্বাক্ষ্য প্রমাণে দোষী ঘোষিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সব আসামীই নির্দোষ। সুতরাং, আইনসম্মত ভাবেই স্বাক্ষ্য প্রমাণে দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগে চাকরিতে মামলার কোন প্রভাব পড়বেনা।

কিন্তু বর্তমান বাস্তবতার প্রতিফলন ভিন্ন দেখতে পাই। মামলার PCPR ডিজিটাল হওয়ায় কারো বিরুদ্ধে কোন মামলা থাকলে সহজেই তা ট্র্যাক করে ফেলে পুলিশ। ভেরফিকেশন রিপোর্টে মামলা আছে মর্মে পুলিশ কর্তৃক রিপোর্ট প্রদান করা হলে, কর্তৃপক্ষ মামলা ও অপরাধের ধরণ, অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রস্বার্থ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিয়োগদানের জটিলতা ও শূণ্যপদে পুণঃ নিয়োগ এবং আর্থিক অপচয় রোধের কথা চিন্তা করে মামলা জড়িত ত্রুটিপূর্ণ প্রার্থী নিয়োগে অনীহা প্রকাশ করে।

নিষ্পত্তিকৃত মামলায় চাকরি:
ফৌজদারী মামলা মূলত ২ ভাবে নিষ্পত্তি হয়ে থাকে যেমন,

১। অব্যহতির মাধ্যমে:
পুলিশ চার্জশিট দাখিলের সময় যদি আপনাকে নির্দোষ মর্মে রিপোর্ট দাখিল করে এবং আদালত সে রিপোর্ট গ্রহণ করে তাহলে আপনার বিরুদ্ধে মামলা এখানেই শেষ। আবার বাদী কর্তৃক যদি মামলা প্রত্যাহার করা হয় তাহলেও আসামী অব্যহতি পাবে। অব্যহতি যে ভাবেই হোক, অব্যহতি পেলে চাকরিতে কোন সমস্যই হবেনা।

২। রায়ের মাধ্যমে :
যখন আদালত স্বাক্ষ্য প্রমাণ বিবেচনা করে কোন আসামীকে রায়ে খালাস প্রদাণ করেন তখন ধরে নেয়া হয়, যেন তাহার নামে অতীতে কোন মামলাই ছিলোনা। খালাস প্রাপ্ত হলে চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই।

যদি রায়ে আপনার সাজা হয় তাহলে চিন্তার রাজ্যে আপনিও রাজা হবেন নিশ্চিত! তবুও আশার বাণী আছে, কিছু কিছু চাকরিতে উল্লেখ থাকে যে “আদালত কতৃর্ক সাজা প্রাপ্ত হলে এবং সাজার পর ১ বছর/২বছর/৩ বছর অতিবাহিত না হলে”। সেক্ষেত্রে প্রাপ্ত সাজা এবং পরবর্তী নির্দিষ্ট সময় পর আপনার সাজার বিষয়টা চাকরিতে আর প্রভাব ফেলবেনা।

অব্যহতি ও খালাসের পর করণীয়:
কারো নামে মামলা হলে তাহার স্থায়ী ঠিকানার থানাতে ঠিকানা যাচাইয়ের জন্য অবশ্যই মামলার একটা নোট যায় আদালত হইতে। থানায় ওই রেকর্ড আজীবন সংরক্ষিত থাকে। যেহেতু পুলিশ ভেরিফকেশনও সংশ্লিষ্ট থানাতে হাওলা হয়ে থাকে তাই, আপনাকে আপনার নামে থাকা মামলার রেকর্ড ক্লিয়ার করতে অব্যহতি বা খালাস প্রাপ্তির পর আপনার আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতের ওই আদেশের সার্টিফাইড কপি সংগ্রহ করে থানায় জমা দিতে হবে। থানাকে আপনার মামলার অগ্রগতি জানানো আপনারই দ্বায়িত্ব, কেননা পুলিশ ভেরিফিকেশনে থানার এই রেকর্ডই হাইলাইট হয়।

# মিথ্যা রিপোর্টে চাকরি না পেলে প্রতিকার:
যদি আপনার বিরুদ্ধে মামলা না থাকার পরও মামলা জড়িত উল্লেখ করে রিপোর্ট দেয়া হয় অথবা খালাস বা অব্যহতি পাওয়ার পরেও আপনাকে অভিযুক্ত উল্লেখ করা হয় তাহলে আপনার জন্য আইনগত ৩টি প্রতিকার রয়েছে।

যেমনঃ
১। ভিন্ন সংস্থাকে দিয়ে পুণ: ভেরিফিকেশনের আবেদন করা।
২। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন।
৩। মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশনে রিট পিটিশন দায়ের করতে পারবেন।

উপরোক্ত বিষয়ে পুলিশ কর্তৃক কোন হয়রানির শিকার হলে দন্ডিবিধির ১৬১ ধারার অধীন ঘুষ, মিথ্য অভিযোগ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য সরাসরি স্পেশাল জজ আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন।

লেখক, মতিন সরকার মিশুক, অ্যাড

সোনালীনিউজ/এমএইচএম

Wordbridge School
Link copied!