• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিন্নি : যোদ্ধা থেকে আসামি


আফরোজা পারভীন আগস্ট ৪, ২০১৯, ০২:৩৯ পিএম
মিন্নি : যোদ্ধা থেকে আসামি

ঢাকা : মিন্নিকে নিয়ে কেন এত আলোচনা? এদেশে কি এর আগে কোনো মেয়ে একাধিক প্রেম করেনি? একাধিক বিয়ে করেনি? (বিয়ের ব্যাপারটা সত্যিকার প্রমাণসাপেক্ষ।) মিন্নি চরিত্রহীন, এদেশে কি আর কোনো চরিত্রহীন মেয়ে নেই! দেশবাসী কি এই প্রথম ঘুম ভেঙে একটি চরিত্রহীন মেয়ে দেখল?  আর তা যদি দেখেও থাকে, এতদিন যদি তাদের চোখে ঠুলি থেকে থাকে, তারা কি শুধু মিন্নিকেই দেখল, আর মেয়েদের দেখল না? এদেশে পুরুষরা একাধিক প্রেম করে না? একাধিক বিয়ে করে না? এদেশে সব পুরুষই কি চরিত্রবান? ধোয়া তুলসীপাতা? সার্টিফিকেট দিয়েই যদি চরিত্রের বিচার করতে চান, তাহলে অবশ্য অধিকাংশ নারী-পুরুষই চরিত্রবান। কারণ প্রত্যেকেরই একটা করে ক্যারেকটার সার্টিফিকেট আছে। চাকরি-বাকরি ব্যবসাপাতি, টেন্ডারবাজি করতে ওই সার্টিফিকেট লাগে। আর ওসব সার্টিফিকেট বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে বিকোয় তা আপনার-আমার কারোরই অজানা নয়।

সোশ্যাল মিডিয়ায় একের পর এক আপলোড হচ্ছে মিন্নিকে নিয়ে নানান ভিডিও। কেউ বলছে ফইরনি, কেউ বলছে সিন্নি। মেয়েদের কি মানসম্মান নেই? একজন আসামির কি মান-সম্মান নেই? বিড়াল কুকুরকেও তো মানুষ এভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে না। যারা বলছেন, তারা কারা? তারাই তো মিন্নিদের চরিত্রহীন বানান। একটা মেয়ে তো একা একা চরিত্রহীন হয় না, হওয়ার পথ নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়ন্ত্রণ নেই কেন? কিছু হওয়ার আগেই ভিডিও ব্যবসায়ীরা মেয়েদের নিয়ে হামলে পড়ে কেন? তাছাড়া  লাইভ সেক্স ভিডিও থেকে শুরু করে অশ্লীল বিকৃত জিনিস ভেসে বেড়ায় কেন? নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ কি নেই? নাকি তারা নিয়ন্ত্রণ করতে চান না?

যে মেয়েটি দুদিন আগে স্বামী রিফাতকে বাঁচানোর জন্য প্রাণপণ যুদ্ধ করল, যে ছিল মামলার ১ নং সাক্ষী। সে হঠাৎ আসামি হয়ে গেল কোন কারিশমায়? শুধু তা-ই নয়, তাকে অ্যারেস্ট করে ১০ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। কোর্টে তুললে পাঁচদিনের রিমান্ডও হয়ে গেল। সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এ দেশ! মিন্নির পক্ষে একজন আইনজীবীও পাওয়া গেল না। যে দেশে চোর-ডাকাত-বাটপাড়, খুনি-ধর্ষক, স্বাধীনতাবিরোধীদের মামলায় আইনজীবীদের লাইন পড়ে যায়, সে দেশে চরিত্রহীন মিন্নির জন্য আইনজীবী পাওয়া গেল না। তারা দাঁড়ালো না, নাকি তাদের দাঁড়াতে দেওয়া হলো না? যদি তা-ই হয়, তাদের মধ্যে কি একজনও সাহসী আইনজীবী নেই?  মিন্নি যে নিজের হাতে খুন করেছে তা প্রমাণ হয়নি। মিন্নি খুনের পরিকল্পনা করেছে এমন অভিযোগ উঠেছে। প্রমাণ হয়নি। সে খুনি কি খুনি না, পরিকল্পনায় ছিল কি ছিল না, সে প্রমাণের দায়িত্ব তো আইনজীবীদের। তারা সবাই নিশ্চুপ থেকে মিন্নিকে খুনি বানানোর পথটা প্রশস্ত করে দিলেন। যে মেয়েটিকে দুদিন আগে মানুষ প্রশংসা করেছেন, যোদ্ধা বলেছেন, লড়াকু বলেছেন, এমন কথাও বলেছেন যে ‘মিন্নির মতো মেয়ে যেন ঘরে ঘরে জন্মায়’- সেই মেয়েটি ঘটনার সময় কখন কাকে কীভাবে জড়িয়ে ধরেছেন, রিফাতকে কেন জড়িয়ে ধরেনি এসব প্রশ্ন উঠছে। যান না সাহসী ভাইয়েরা, বোনেরা ধারালো চাপাতির সামনে একবার মিন্নির মতো দাঁড়ান। দেখব কত বড় বুকের পাটা আপনাদের। বলার সময় বলতে সবাই পারে, শতমুখে নিন্দাও করতে পারে, কাজের সময় নীরব। খুনিদের কললিস্টে মিন্নির নাম্বার পাওয়া গেছে। এটা কি খুব অস্বাভাবিক? একই এলাকার মানুষ, চেনা-জানা। খুনের আগে যোগাযোগ থাকতে পারে। আর খুনের পরে মানুষ অনেক সময় আবেগে, রেগে গিয়ে বুদ্ধিহীনের মতো অনেক কাজ করতে পারে। সেটা মিন্নি করেছে কিনা আমার জানা নেই। তবে জানি, আজকাল কললিস্ট শুধু নয়, টেলিফোন কথোপকথন পুরোটাই উদ্ধার করা যায়। সেটা করলেই তো অনেক সমস্যার সুরাহা হয়ে যাবে।

পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়েছে, মিন্নি স্বীকারোক্তি দিয়েছে। কাগজে পড়েছি, মিন্নি বলেছে সে নির্দোষ? কোনটা সত্যি? নিজে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম। স্বীকারোক্তিই যে শেষ কথা নয়, সেটা আমি বেশ জানি।

নয়নের মা বলেছেন মিন্নি ‘মহারাজ সাপ’। এডালে ওডালে বসে। কিন্তু তিনিই মিন্নির বাসায় ছেলের নিয়মিত যাতায়াত সমর্থন করেছেন মিন্নি রিফাতের বউ জেনেও। তার ভাষ্য অনুযায়ী মিন্নি একসঙ্গে দুই স্বামী রাখত জেনেও। তিনি এ বিষয়ে রিফাত বা তার বাবা-মাকে কখনো কিছু বলেছেন একথা তার ভাষ্যে আসেনি। অর্থাৎ বলেননি। কেন বলেননি? ছেলে না হয় তার কথা শুনত না। কিন্তু মিন্নির শ্বশুরবাড়িতে কেন জানাননি? দিনের পর দিন নিজের ঘরের মধ্যে অন্যায় হচ্ছে দেখেও কেন চুপ করে ছিলেন? এখন বলছেন মিন্নি দুই স্বামীর কাছ থেকেই টাকা-পয়সা জিনিসপত্র নিত। সেটা কেন তিনি মেনে নিয়েছেন?

একজন হুজুর বলেছেন, মিন্নি ছয় মাস আগে গর্ভপাত ঘটিয়েছে। এ সন্তান কার, এ প্রশ্ন তিনি তুলেছেন। তিনি এটাও বলেছেন, মিন্নির বাবা সুদখোর। আজ যখন মিন্নি বিপাকে, তখন তিনি একথা বলছেন কেন? এতদিন কোথায় ছিলেন তিনি? তিনি কেন আগে তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করেননি? গর্ভপাত ঘটিয়ে দুই স্বামী নিয়ে মিন্নি স্বচ্ছন্দে সবার চোখের সামনে দিয়ে বীরদর্পে সেজেগুজে চলাফেরা করল বরগুনার মতো ছোট্ট একটা জায়গায়, এটা কতটা বাস্তবসম্মত?

সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনা ঘটিয়েছেন রিফাতের বাবা, যিনি পুত্রবধূকে বিশ্বাসভাজন প্রত্যক্ষদর্শী মেনে মামলার এক নম্বর সাক্ষী বানালেন, তিনিই আবার ঘটনার ১৮ দিন পর সেই পুত্রবধূকে আসামি বানিয়ে দিলেন। মিন্নি বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তার শ্বশুরকে চাপ দিয়ে এটা করা হয়েছে। তিনি ছেলের শোকে কাতর। তাছাড়া অসুস্থ। চাপে পড়ে তিনি এটা করেছেন। এর পেছনে আছে ক্ষমতা, অর্থ আর প্রভাবশালী একটি মহল। তারাই চাপ দিয়ে রিফাতের বাবাকে দিয়ে এসব করাচ্ছে। আসল ঘটনা কী তা জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, মিন্নিকে যদি আসামিই করবেন, মামলা করার সময় করলেন না কেন? ১৮ দিন পরে কেন? ঘটনাটা কি প্রশ্নের উদ্রেক ঘটায় না?

রাজনৈতিক প্রভাবের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে এ ঘটনায়। ঘটনায় নাম উঠে এসেছে একজন এমপি-পুত্র আর একজন সাবেক সংসদ সদস্যের। ঘটনাক্রমে মামলার অন্যতম আসামি রিফাত ফরাজী সংসদ সদস্যের আপন ভাগনে। এমপি-পুত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দিয়ে বলেছেন, রিফাত তার কাছের ছোটভাই। এ ঘটনায় ‘মিন্নি জড়িত থাকলেও থাকতে পারে’। ‘জড়িত থাকলেও থাকতে পারে’ বলে কোনো কথা নেই। হয় জড়িত অথবা জড়িত নয়। মামলায় কোনো মধ্যপন্থা নেই। রিফাত ফরাজীর বিরুদ্ধে অতীতের অনেক বড় বড় অভিযোগ আর মামার কাছে বিচার দিয়েও বিচার না পাওয়ার কথা এমপি-পুত্রের  লেখায় উঠে এসেছে। রিফাত খুন হওয়ার পর তাকে ছাত্রলীগের কর্মীও বলা হয়েছিল। যদিও পরে সেটি নিয়ে দ্বিমত এসেছে।

বন্ড ০০৭ গ্রুপটির জন্ম হলো কীভাবে? নয়নের তো একটা পিতৃপ্রদত্ত নাম আছে। সে নামের সঙ্গে বন্ড যুক্ত নেই। জেমস বন্ডকে ভালোবেসে নয়ন হয়েছে নয়ন বন্ড। আর চালিয়েছে খুন-জখম, হত্যা, লুট ও মাদকের ব্যবসা। গড়ে তুলেছে নিজস্ব দল। রাজনৈতিক ছত্রছায়া ছাড়া এসব ব্যক্তি বা দল বেশিদিন টিকতে পারে না। কারা এদের গডফাদার? কাদের মদতে এরা চলত, সে প্রশ্নের জবাব জানা প্রয়োজন। নয়নকে মেরে ফেলা হলো কেন? নয়নকে গ্রেফতার করা হবে, তার বিচার হবে, বিচারের রায়ে তার যে সাজা প্রাপ্য হয় বা না হয় সেটা সে পাবে— এটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু কেন তাকে মেরে ফেলা হলো। কোনো কথা চাপা দেওয়ার জন্য? কাকে আড়াল করার জন্য?

মিন্নি এখন রিমান্ডে। এদেশে  মেয়ে জন্ম নেওয়া যে কতটা ভালনারেবল, সেটা আবারো বুঝলাম মিন্নিকে দিয়ে। একজন আইনজীবীও তার পক্ষে দাঁড়ালো না। যেমন নুসরাত হত্যার সময় একজন সোচ্চার নারীবাদীর কণ্ঠও আমরা পাইনি সে মাদরাসার ছাত্রী বলে। বরগুনায় কি কোনো নারী আইনজীবী ছিলেন না? তারা দাঁড়ালেন না কোনো ভয় বা লজ্জায়?

ঢাকা থেকে এক প্যানেল আইনজীবী মিন্নির পক্ষে লড়বেন বলে বরগুনা গিয়েছেন বলে শুনেছি। আমরা আশান্বিত। মিন্নি অন্তত তার ন্যায্য অধিকারটুকু পাক। আমরা দেশের সাধারণ সচেতন জনগণ। কারো পক্ষে বা বিপক্ষে নই। আমরা চাই সুষ্ঠু এবং নিয়মমাফিক বিচার। সে বিচারে যেন প্রকৃত অপরাধী শাস্তি পায়, এটাই আমাদের চাওয়া। নারী এবং কমজোর বলেই যেন কাউকে অন্যায়ভাবে হেনস্তা হতে না হয়, সাজা পেতে না হয়— এটুকুই প্রত্যাশা।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাবেক যুগ্ম সচিব

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!