• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

২০০ কোটির মাদকের হাট


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১৯, ১২:৩১ পিএম
২০০ কোটির মাদকের হাট

ঢাকা : দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা অন্তত দেড় কোটি। এর মধ্যে এক কোটি মাদকাসক্ত। এসব মাদকসেবী প্রতিদিন ২০ কোটি টাকার মাদক সেবন করে। সে হিসাবে মাসে ৬০০ কোটি টাকা। আবার সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ৩০ লাখ মাদক ব্যবসায়ী প্রতিদিন কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকার মাদক বেচাকেনা করে। যদিও বাস্তবে এর পরিমাণ আরো অনেক বেশি। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্রে আরো জানা গেছে, ২০১৮ সালে ১ লাখ ২৮ হাজার ৮৩১ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। রাজধানীসহ সারা দেশে দায়ের করা ৯৭ হাজার ৮৭০টি মামলায় তাদের গ্রেফতার করা হয়। এই সময়ে র্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ৩৫ কেজি হেরোইন, ৪ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯৫ লিটার মদ ও ৩ কোটি ১২ লাখ ৩২ হাজার ৯১১ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেন। ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় উল্লিখিত মামলায় গ্রেফতার ও মাদক উদ্ধার করা হয়।

সূত্র জানায়, মাদকের মধ্যে ইয়াবা সেবন দিন দিন মহামারি আকার ধারণ করছে। মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম হয়ে সড়ক, রেল ও আকাশপথে সারা দেশে ইয়াবা ছড়িয়ে পড়ছে। মাদকের ক্ষেত্রে ইয়াবার পরের অবস্থানে রয়েছে হেরোইন। অবশ্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া ইয়াবার ৮৫ শতাংশই  ভেজাল। এসব ইয়াবাসেবীর কিডনি ও মস্তিষ্ক বিকল হওয়া ছাড়াও ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ, লিভার, হূদরোগ ও স্মৃতিশক্তি নষ্ট হচ্ছে প্রতিদিন। অধিকাংশ ইয়াবাসেবীর মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। প্রাণঘাতী এই মাদকের প্রভাবে সমাজে বেড়ে যাচ্ছে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও খুনের মতো মারাত্মক অপরাধ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৮০ শতাংশ খুনের সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে মাদকসেবী জড়িত থাকার প্রমাণ মিলছে।

এ ছাড়া সারা দেশে অন্তত ৩০ লাখ মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় পাইকারি ও খুচরা মাদক বিক্রেতার সংখ্যাই অন্তত ১৫ লাখ। ১৫ লাখের মধ্যে ১০ লাখ ব্যবসায়ী চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের। বাকি ৫ লাখ ব্যবসায়ী দেশের বিভিন্ন জেলার। অধিকাংশ ব্যবসায়ীই ইয়াবা ও  হেরোইন ব্যবসায় জড়িত।

বছরজুড়ে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনার পরও থেমে নেই মাদক কারবারিদের দৌরাত্ম্য। নিত্যনতুন কৌশলে তারা মাদক পাচার ও বাজারজাত অব্যাহত রেখেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে চাহিদা ও অতিমুনাফা। মাদক নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একাধিকবার জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করে। গত ১ বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে প্রায় ২০০ মাদক ব্যবসায়ী নিহত হওয়ার পরও থেমে নেই মাদকের এই ভয়ানক ছোবল।

মাদক ব্যবসায়ীরা সড়কপথে সবজির ট্রাক, বাস, লরি, মাল আনা-নেওয়ার কার্গোভ্যান, বিলাসবহুল গাড়ি ও প্রাইভেটকার ব্যবহার করা ছাড়াও নারী ও শিশুদের জামা-কাপড়ে নানাভাবে লুকিয়ে ইয়াবা এনে থাকে। ইয়াবা বহন করার জন্য ভাড়ায় স্বামী-স্ত্রী, যুবক-যুবতী থেকে শুরু করে নানা বয়সি মানুষও পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে অভিনব কায়দায় ইয়াবা আনতে ধরা পড়ার ঘটনাটি ঘটে ২০১৭ সালে।

ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম থেকে সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনে এক যুবক ডান হাতে ক্র্যাচ, বাঁ হাতে এক্সরের ফাইল, মাথায় টুপি আর পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি, মুখে মাস্ক পরিহিত অবস্থায় কমলাপুর রেলস্টেশনে নামে। দেখলেই যে কারো মনে হবে সে অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে। তাকে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে স্টেশন পার হচ্ছিল ওই যুবক।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার জুয়েল রানার কাছে তথ্য ছিল ওই যুবক ইয়াবা নিয়ে আসছে। ওই যুবকের দেহ, ফাইলপত্র সবকিছুই তল্লাশি করে দেখা হলো। কোথাও ইয়াবা নেই। গোয়েন্দারা হতাশ।

অবশেষে যুবকের ক্র্যাচের ভেতর থেকে বিশেষ কায়দায় রাখা বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার হয়। আটক যুবক সালাহউদ্দিনের (৩০) বাড়ি কক্সবাজার জেলার চকরিয়া থানায়। ইতোপূর্বে সে এভাবে আরো কয়েকটি বড় চালান ঢাকায় পৌঁছে দিয়েছে বলে  গোয়েন্দা পুলিশ জানায়।

প্রতি পিস ১০০ টাকায় কিনে ঢাকার কমলাপুরে পান্না নামে এক নারীর কাছে প্রতি পিস ইয়াবা ৫০ টাকা লাভে বিক্রি করে দিত সালাহউদ্দিন। নারীরা গোপনাঙ্গে, বাচ্চাদের চিপসের প্যাকেটে, জুতোর তলায়, ম্যাচের বাক্স, সবজির ট্রাকে, নানা ফলমূলের  ভেতরে করে ইয়াবার চালান আনে। খুচরা বাজারে গিয়ে সেটার মূল্য হয়ে যায় ৩০০ টাকা।

এদিকে মাদকের এই ভয়ঙ্কর বিস্তার বন্ধে সরকার এবার ভিন্ন কৌশলে অগ্রসর হচ্ছে। এবারের পুলিশ সপ্তারও প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘পুলিশ জনতা ঐক্য করি, মাদক জঙ্গি নির্মূল করি।’ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদকের উৎসস্থলে রীতিমতো হামলে পড়েছে। এবারে ড্রাস্টিক প্লাস কৌশলী অ্যাকশনের মুখে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা আত্মসমর্পণ করা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে শতাধিক আত্মসমর্পণ করা মাদক কারবারিকে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে।

আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে এদের আত্মসমর্পণ করার কথা রয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, কক্সবাজারের মাদক মাফিয়াচক্রের সদস্যরা আত্মসমর্পণ করলে মাদকের প্রকোপ কিছুটা হলেও কমবে। এ ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মো. মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী মুঠোফোনে বাংলাদেশের খবরকে বলেন, মাদক নির্মূল করা কঠিন। এটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটা একটা বৈশ্বিক সমস্যা।

এ সমস্যা সমাধানে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নির্ভর করলে হবে না। পার্শ্ববর্তী দেশের সহায়তা লাগবে। দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক মতভেদ ভুলে মাদকের প্রশ্নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এটাকে জাতীয় সমস্যা ঘোষণা করে একযোগে মাঠে নামতে হবে সবাইকে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা আছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ না হওয়ার কোনো কারণ নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় দেশের মানুষ এখন নিরাপদে স্বস্তিতে আছে। জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি একধাপ তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একইভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণেও সক্ষম হব।

পুলিশ সদর দফতরের অ্যাডিশনাল ডিআইজি মনিরুজ্জামান বলেন, ‘সরকার মাদক নির্মূলে বদ্ধপরিকর। আমি মনে করি দেশ থেকে জঙ্গিবাদের মতোই মাদক নির্মূল করতে সক্ষম হব। আর সেদিকেই পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হচ্ছে দেশের পুলিশ প্রশাসন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!