ঢাকা : স্বপ্নের পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ডিসেম্বরে। ২০০৯ সাল থেকে চলে আসা ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার প্রকল্পে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দের শতভাগ অর্থ ব্যয় হলেও নির্ধারিত মেয়াদে কাজ শেষ করতে ছয় মাস লাগবে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। বিপুল চাহিদা থাকলেও পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে ৫ হাজার ৩৭০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রকল্পটির মেয়াদ আরেক দফায় বাড়ানো অনিবার্য হয়ে পড়েছে।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের ইশতেহারে অবকাঠামো খাতে পদ্মা সেতুর মতো একগুচ্ছ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। মহাজোটকে নেতৃত্ব দিয়ে বিপুল সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসে প্রতিশ্রুত প্রকল্প আলোচনার টেবিলে আনতে দলটির চলে যায় কয়েক বছর। সরকারের গত দুই মেয়াদে মাঠপর্যায়ে কয়েকটি প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে হাতেগোনা কয়েকটির। এ অবস্থায় নতুন মেয়াদে অবকাঠামো উন্নয়নেই বিশেষ অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার। চলতি মেয়াদে বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য সরকারের রয়েছে। এ লক্ষ্য পূরণ করতে সরকারের প্রথম বাজেটে ফার্স্টট্র্যাক হিসেবে পরিচিত অগ্রাধিকার ১০ প্রকল্পে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগ সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত ২ লাখ ১৫ হাজার ১১৪ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) চলমান প্রকল্পগুলোর অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ১ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে বড় আকারের সাত প্রকল্পে বরাদ্দ থাকছে ৩৬ হাজার ২১৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। মোট এডিপি বরাদ্দের ১৯ শতাংশই পাচ্ছে সাতটি প্রকল্প। আগামী এডিপিতে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৯৮০ কোটি ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে। মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্প পাচ্ছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭ হাজার ২১২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। বরাদ্দের বিবেচনায় পদ্মা সেতুর অবস্থান তৃতীয়।
এর বাইরে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে আগামী এক বছরের জন্য ৩ হাজার ৯৯৫ কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ‘মাতারবাড়ি ২৬০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্ট’ শীর্ষক প্রকল্পে বরাদ্দ থাকবে ৩ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের নিকটবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে ১ হাজার ১০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। পায়রা বন্দর উন্নয়নে নেওয়া একটি প্রকল্পে ৫০০ কোটি টাকা ও অপর প্রকল্পে ২১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম এ বিষয়ে বলেন, আগামীতে দেশের গ্রামীণ উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। গ্রামেই শহরের সুবিধা পৌঁছতে চায় সরকার। এ জন্য প্রয়োজন অবকাঠামো ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন। নতুন এডিপিতে মেগা প্রকল্পের বাড়তি বরাদ্দ এ লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হবে বলে তিনি মনে করেন। তবে অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আনতে আরো উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, দেশের ইতিহাসে লাখ কোটি টাকা ছাড়ানো প্রথম প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে আগামী অর্থবছর বরাদ্দ থাকছে ১৪ হাজার ৯৮০ কোটি ৭ লাখ টাকা। ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা ব্যয় ধরে নেওয়া প্রকল্পটিতে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ব্যয় হয়েছে ১৬ হাজার ৬৬৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা। শতকরা হিসাবে প্রকল্পটির অগ্রগতি হয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চলতি অর্থবছর ১১ হাজার ৯৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ উঠে ১১ হাজার ৩১৩ কোটি ১৮ লাখ টাকায়। এ হিসাবে আগামীতে প্রকল্পটিতে বরাদ্দ বাড়ছে ৩ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা।
পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পে গত অর্থবছর ৪ হাজার ৩৯৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও সংশোধিত এডিপিতে তা নামিয়ে আনা হয় ২ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকায়। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে অন্যান্য অংশের স্থল যোগাযোগ বাড়াতে নেওয়া প্রকল্পটিতে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৫ হাজার ৩৭০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। সংশোধিত এডিপির তুলনায় আগামী বছর প্রকল্পটিতে বরাদ্দ বাড়ছে ২৭১৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপন করতে নেওয়া পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে আগামী বছর বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৩ হাজার ৯৯৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকার এ প্রকল্পে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ব্যয় হয়েছে ৯ হাজার ২৩০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছর এ প্রকল্পে ৫ হাজার ৩৩০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও পরে তা ৩ হাজার ২৯০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। সংশোধিত এডিপির তুলনায় এ প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়লেও কমছে মূল এডিপির তুলনায়।
পর্যটন নগরী কক্সবাজারকে রেল নেটওয়ার্কে আনতে নেওয়া ‘দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ (১ম সংশোধিত)’ প্রকল্পের এ বছর বরাদ্দ রয়েছে ৫২৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ক্রমপুঞ্জীভূত ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। আগামী বছর বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। বরাদ্দ বাড়ছে ৫৭৭ কোটি টাকা।
রাজধানীর যানজট নিরসনে নেওয়া দেশের প্রথম মেট্রোরেলের কাজ চলছে। এ লক্ষ্যে ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (এমআরটি-৬) প্রকল্পে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৭ হাজার ২১২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৭ লাখ টাকা টাকার এ প্রকল্পে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৮৬০ কোটি ১৯ লাখ টাকা। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রথম পর্যায়ে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১২ কিলোমিটারের কাজ এ বছরের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে।
ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে নেওয়া কলাভিক্তিক ‘মাতারবাড়ি ২৬০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্ট’-এ ব্যয় হচ্ছে ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে এ বছর বরাদ্দ রয়েছে ২ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ক্রমপুঞ্জীভূত ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ৬৯৬ কোটি ১০ লাখ টাকা। আগামী বছর বরাদ্দ বাড়িয়ে ৩ হাজার ৫৬ কোটি টাকা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে বহির্বিশ্বের দেশের সমুদ্রপথের বাণিজ্য আরো বাড়াতে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো/সুবিধাদির উন্নয়ন (১ম সংশোধিত) প্রকল্পের বরাদ্দ থাকছে ৫০০ কোটি টাকা। ৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকার প্রকল্পে এবার বরাদ্দ ছিল ৫৫২ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৬১০ কোটি টাকা। অন্যদিকে ৩ হাজার ৯৮২ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয় ধরে নেওয়া পায়রাবন্দরের প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ২১৩ কোটি টাকা।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :