কক্সবাজার : ইয়াবা ট্যাবলেট পাচারের পাশাপাশি স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত। তবে সব বাহিনী মাদক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় স্বর্ণ চোরাচালান অব্যাহত গতিতে চালাচ্ছে পাচারকারীরা।
এতে বেশিরভাগই ব্যবহূত হচ্ছে স্বর্ণ চোরাচালান মামলা থেকে জামিনে আসা পাচারকারী ও রোহিঙ্গারা। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পাচার প্রতিরোধে তেমন তৎপর না হওয়ায় দেদার চলছে স্বর্ণ পাচার।
জানা যায়, গত ১০ আগস্ট রাতে কোস্টগার্ড সদস্যরা লেদা রোহিঙ্গা বস্তির একটি ভাড়া বাসায় অভিযান চালিয়ে বালিশের ভেতর থেকে ৩০ ভরি স্বর্ণালংকার ও ১০ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে।
এসময় ঘরের মালিক রোহিঙ্গা মো. রফিককেও আটক করা হয়। এর আগে গত বছরের জুন মাসে ধরা পড়ে মাত্র একটি চালান। তাও কোস্টগার্ড সদস্যদের অভিযানে।
এর আগে ২০১৫-২০১৬ সালে ধরা পড়ে ১২টি চালান। মিয়ানমার থেকে আনা এসব স্বর্ণ বাংলাদেশ হয়ে ভারতে পাচার হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কর্মকর্তারা।
গত ৭ আগস্ট বেনাপোল সীমান্তের দুর্গাপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি মোটরসাইকেলের সাইলেন্সার পাইপের মধ্যে ফিটিং অবস্থায় ২.৮ কেজি ওজনের ৩২টি স্বর্ণের বার জব্দ করেছে বিজিবি। এর আগে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বেনাপোল বন্দর থানার ধান্যখোলা সীমান্ত থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ২০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে।
ওই অভিযানের বিজিবি কমান্ডার সুবেদার শফিকুল ইসলাম বলেন, বেনাপোল ধান্যখোলা সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণের একটি বড় চালান ভারতে পাচার হবে এমন সংবাদে বিজিবি টহল দল এ অভিযান পরিচালনা করে। তবে দুটি অভিযানেই পাচারকারী কাউকে আটক করতে পারেনি বিজিবি।
যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. সেলিম রেজা জানান, দীর্ঘদিন ধরে হুন্ডি, মাদক, চোরাচালান ও স্বর্ণ আটকের নিমিত্তে নিজস্ব গোয়েন্দা তৎপরতার ধারাবাহিকতায় ইন্টেলিজেন্স দল গত ৭ আগস্ট দুপুরে দুর্গাপুর এলাকায় অভিযান চালায়।
এ সময় বিজিবি টহল দলের উপস্থিতি বুঝতে পেরে চালক মোটরসাইকেলটি ফেলে দৌড়ে পালিয়ে যায়। পরে তল্লাশি করে মোটরসাইকেলের সাইলেন্সার পাইপের সঙ্গে ফিটিং অবস্থায় ৩২টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। যার মূল্য প্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ ২০ হাজার টাকা।
২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর ও ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের জাতিগত দুটি ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রোহিঙ্গ পুনর্বাসন ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বেশি ব্যয় ও ইয়াবাসহ মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করায় স্বর্ণ পাচারকারী সিন্ডিকেট দিব্ব্যি আরামে পাচার কাজ চালিয়ে আসছে বলে একাধিক সূত্রে জানা যায়।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার বৈধ ট্রানজিট যাতায়াত বন্ধ থাকায় এখন স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেট শাহপরীর দ্বীপ গবাধি পশুর করিডোর ও টেকনাফ স্থলবন্দর ও এর আশপাশ এলাকাকে বেচে নিয়েছে।
গত ২০১৮ সালের ২০ জুন রাতে টেকনাফে ৪টি স্বর্ণের বারসহ টেকনাফ পৌরসভার খায়ুকখালী পাড়া এলাকার মৃত নুর মোহাম্মদের ছেলে মো. আব্দুল্লাহকে (২৮) আটক করে কোস্টগার্ড সদস্যরা। বরইতলী এলাকা (টেকনাফ স্থলবন্দরের পার্শ্বে) থেকে বিশেষ অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়।
এ ছাড়া বছর দুয়েক স্বর্ণ পাচার রোধের তেমন অভিযান চালাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে বিভিন্ন সময়ে আটক পাচারকারীরা জামিনে এসে ফের স্বর্ণ চোরাচালানে নেমে পড়ে। এর ফলে স্বর্ণ ও হুন্ডি চক্র তাদের জাল বিস্তার অব্যাহত রাখছে।
একটি সূত্র বলছে, স্থল সীমান্ত দিয়ে আনা কিছু চালান আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ধরা পড়লেও অধিকাংশ চালান পাচার হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া নির্ধারিত স্থানে নির্বিঘ্নে পৌঁছে যাচ্ছে জলপথে ট্রলার মারফত চালানগুলো।
এদিকে কারাগার থেকে বের হয়ে এসে অনেকে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। স্বর্ণ, ইয়াবা ট্যাবলেট ও হুন্ডি ব্যবসা পরিচালনার জন্য গড়ে তোলে কয়েকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
এর মধ্যে জেল থেকে জামিনে এসে সাইফুলের সিন্ডিকেটে সংযুক্ত করা হয়েছে তার ভাই মাহামুদুল, সাবরাং মগপাড়ার আজিজুর রহমান ও মো. ইসমাইল, সাইফুলের ফুফাতো ভাই সাবরাং চান্ডলীপাড়ার মহিউদ্দিন, সাবরাং মগপাড়ার ছৈয়দ হোসাইন, দিল মোহাম্মদ।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম, টেকনাফ ও মিয়ানমারকেন্দ্রিক স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেট নীরবে সক্রিয় রয়েছে। বর্তমানে টেকনাফ জালিয়াপাড়ার জিয়াবুল, আয়াজ, ওসমান, ইসহাক, ইয়াছিন, আবদুর রহিম, উপরের বাজারের সুজিত, সবুজ ধর, নির্মল ধর, বিমল ধর, বদি আলম, পল্লান পাড়ার ফারুক, কেকেপাড়ার জাহাঙ্গীর, স্বর্ণকার মনথকিং, মমসে, মিয়ানমারের হারিপাড়ার মোস্তাক, হারেজ, আমান উল্লাহ, রশিদ, বমুপাড়ার হাজী ইউনুচ, উকিলপাড়ার সিঅ্যান্ডএফ আইয়ুব, আবদুল্লাহ, মংগনিপাড়ার হাজি সলিম, ইয়াঙ্গুনের ফয়েজ, বকসুপাড়ার হাজি অলি আহমদ, ফয়েজিপাড়ার কামাল, চট্টগ্রামে ফরিদ কমিশনার, কোলালপাড়ার শওকত, আবদুল্লাহ, শাহপরীর দ্বীপের মনজুর, ডেইলপাড়ার আবদুল করিম, বার্মায়া সায়িদ করিম স্বর্ণ চোরাচালানে সক্রিয় রয়েছে বলে একাধিক সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্রে জানা যায়, মিয়ানমার, টেকনাফ, চট্টগ্রাম ও ভারতভিত্তিক একাধিক সিন্ডিকেট স্বর্ণ চোরাচালানে যুক্ত। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং বাজারপাড়া, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, চৌধুরীপাড়া, টেকনাফ-মিয়ানমার ট্রানজিট ঘাট, নাইট্যংপাড়া, টেকনাফ স্থলবন্দর, জাদিমোরা, আলীখালী ও চৌধুরীপাড়া দিয়ে স্বর্ণের চালান আসে। তবে বেশিরভাগ চালান সমুদ্রপথে পাচার হয় বলে ধরা সম্ভব হয় না।
টেকনাফ শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের সুপার মাইনুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমারের স্বর্ণের গুণগত মান ভালো বলে চোরাচালানিরা সেদিকে ঝুঁকছে। তবে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান আমার দায়িত্বকালে নজরে আসেনি বলেও জানান তিনি।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :