ঢাকা: চলতি বছরের মাঝামাঝিতে সারা দেশের নিখোঁজ ব্যক্তিদের ‘তালিকাভুক্ত’ করে তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট র্যাব। এরপর পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও নিখোঁজ সেসব ব্যক্তির বিষয়ে কোনো হদিস দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এরই মধ্যে নিখোঁজদের তালিকা আরো দীর্ঘ হচ্ছে। গত দেড় সপ্তাহে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শিক্ষার্থীসহ আরো ৯/১০ জন ‘লাপাত্তা’ হয়েছেন। তাদের অনেকের পরিবারের অভিযোগ, তাদের সাদা পোশাকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে।
গুলশান ও শোলাকিয়া ট্র্যাজেডির পর সারা দেশে নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নিখোঁজদের তালিকা করে অনুসন্ধান শুরু করে তারা। কিন্তু দিন যত পেরিয়েছে, অনুসন্ধান ততই ঝিমিয়ে পড়েছে।
চলতি বছরের ২০ জুলাই সারা দেশে নিখোঁজ ২৬১ জনের তালিকা প্রকাশ করে র্যাব। পরে ২৫ জুলাই এই তালিকা সংশোধন করে ৬৮ জনের এবং সর্বশেষ ৯ আগস্ট নিখোঁজ ৭০ জনের তালিকা প্রকাশ করে র্যাব। তবে এখন পর্যন্ত ‘তালিকাভুক্ত’ কারোর-ই সন্ধান দিতে পারেনি আইন প্রয়োগকারী কোনো সংস্থা।
এ বিষয়ে র্যাবের সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) এএসপি মিজানুর রহমান ভূঁইয়া জানান, নিখোঁজদের সন্ধানে কাজ থেমে আছে বলা যাবে না। নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা ছাড়াও নিয়মিত অনেক কাজও করতে হয় র্যাবকে।
তবে র্যাবের এই ‘তালিকাভুক্ত’ নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজে পাওয়া না গেলেও গত কয়েকদিনের ব্যবধানে খোদ রাজধানী থেকেই ‘নিখোঁজ’ হয়েছেন ছয় তরুণ। তাদের মধ্যে গত ১ ডিসেম্বর বনানী থেকে নর্থ সাউথের দুই সহপাঠীসহ জায়েন হোসাইন খান পাভেল, সাফায়েত হোসেন, মেহেদী হাওলাদার ও মোহাম্মদ সুজন নামে চার তরুণ একসঙ্গে নিখোঁজ হয়েছেন।
আর ৫ ডিসেম্বর বনানী থেকে সাঈদ আনোয়ার খান নামে আরেক তরুণও নিখোঁজ হন। এর আগে গত ৩০ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মাটিকাটার বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফিরে আসেননি মোহাম্মদপুরের কেয়ার মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী ইমরান ফরহাদ।
গত ৩০ নভেম্বর নিখোঁজ হন পাবনা মেডিক্যাল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তানভীর আহম্মেদ তনয়। আবার একই মেডিক্যালের আরেক শিক্ষার্থী জাকির হোসেন নিখোঁজ হন গত ৩ ডিসেম্বর। আর গত ৩০ নভেম্বর রহস্যজনকভাবে ‘নিখোঁজ’ হন বরিশালের মাদরাসাছাত্র নেয়ামতুল্লাহ।
যদিও গতকাল শুক্রবার রাজধানীর গে-ারিয়ার একটি হোটেলে নেয়ামতকে খোঁজে পায় পুলিশ। বাবার কাছে টাকা চেয়ে না পাওয়ায় নেয়ামত স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন বলে পুলিশকে জানিয়েছেন তিনি। তাকে বাবা-মায়ের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে গত ১৪ অক্টোবর ভোরে রাজধানীর ধানমন্ডি সিটি কলেজের সামনে থেকে ডা. ইকবাল মাহমুদ নামে এক ব্যক্তিকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা। তার কোনো খোঁজ পাচ্ছে না পুলিশ। এরপর ২৪ অক্টোবর রাতে তারেক হোসেন (৩৫) নামের এক ব্যক্তিকে সাদা পোশাকের পুলিশ পরিচয়ে রাজধানীর উত্তরার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে তারও কোনো খোঁজ মেলেনি।
র্যাবের সর্বশেষ সংশোধিত তালিকার নিখোঁজ ৭০ জন হচ্ছেন মহিবুর রহমান, সাজ্জাদ রউফ ওরফে অর্ক, ডা. আরাফাত হোসেন তুষার, তাহমিদ রহমান সাফি, খান মো. মাহমুদুল আহসান রাতুল, ঝুন্নুন শিকদার, কাজী মইনউদ্দিন শরীফ, তাওসিফ হোসেন, জুবায়েদুর রহিম, ইব্রাহীম হাসান খান, জুনায়েদ হাসান খান, এ এস এম ফারহান হোসেন, মনোয়ার হোসেন সবুজ, আশরাফ মোহাম্মদ ইসলাম, বাদশা আলী, মো. সুমন, সাব্বির রহমান আশিক, নজিবুল্লাহ আনসারী, বাশারুজ্জামান ওরফে আবুল বাশার, শরিফুল ইসলাম, রাহাত বিন আবদুল্লাহ, বেলাল মোল্লা সোহেল, মাজেদুল হক, আমান উল্লাহ আমান, মো. কামরুজ্জামান, সাহারাত আলী, হাসানুর রহমান ওরফে আসানুর, ইকবাল হোসেন, তহিদুল ইসলাম, হাসান আলী, ফারুক হোসেন, সুমন হোসেন, রাশেদ হোসেন, মো. শাহজাহান, জুবায়ের হোসেন ফারুক, তাজুল ইসলাম চৌধুরী, তামিম আহমেদ চৌধুরী, জাকির হোসেন, আশরাফুজ্জামান, শাহরিয়ার খান ওরফে শাহজাহান, সাদমান হোসেন পাপন, আকরাম হোসেন, জুলহাস শেখ, মো. হাবিবুল্লাহ, জহিরুল ইসলাম চৌধুরী, মো. ইমরান, এটিএম তাজউদ্দিন, হাবিবুর রহমান, ইসমাইল হোসেন, মিন্টু রহমান ওরফে বৈরাগী মিন্টু, মারুজুক হায়দার ওরফে জাহিন, মহিদুল ইসলাম ওরফে মিশুক, রাকিবুল ইসলাম ওরফে রিয়েল, মিন্টু মিয়া ঈদু, রেজাউল করিম, ইকবাল হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, মকসুদ আলী, আবদুুল হামিদ, রিয়াজ উদ্দিন, জহিরুল ইসলাম, সাখাওয়াত হোসেন, মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ, জাকি ওরফে সুজিত দেবনাথ, ডা. রোকনুদ্দীন খন্দকার, নাঈমা আক্তার, রেজওয়ানা রোকন, রামিতা রোকন ও সাদ কায়েস।
র্যাবের এই তালিকাভুক্ত নিখোঁজদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জে কাউন্টার টেরোরিজমের (সিটি) অভিযানে মারা যান শীর্ষ জঙ্গি নেতা তামিম আহমেদ চৌধুরী। বাকিদের বিষয়ে এখনো কোনো খোঁজ মেলেনি। এই তালিকায় প্রতি সপ্তাহেই নতুন করে যুক্ত হচ্ছে ‘নিখোঁজ’। কিন্তু তাদের উদ্ধারে দৃশ্যত কোনো কার্যক্রম নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।
পুলিশের সন্দেহ, নিখোঁজ তরুণরা স্বেচ্ছায় কোনো ধর্মীয় উগ্রপন্থি সংগঠনের সঙ্গে যোগ দিয়ে থাকতে পারেন। কারণ গুলশান হামলার পর এ রকম অনেক ‘নিখোঁজ’ ঘটনায় দেখা গেছে, স্বেচ্ছায় পালিয়ে গিয়ে সেসব তরুণ জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে।
এ বিষয়ে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, উগ্র-জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যারা ঘর ছেড়েছেন, তাদের বেশির ভাগই মাসের শুরুতে অথবা শেষে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। বনানীর চার তরুণও গত ১ ডিসেম্বর নিখোঁজ হন। এ কারণে তাদের উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়ার সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। এমনকি নিখোঁজ হওয়ার আগের দৈনন্দিন কার্যক্রম সেই সন্দেহ আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
ওই কর্মকর্তা জানান, গুলশানসহ অন্যান্য জঙ্গি আস্তানায় নিহত জঙ্গিদের সবাই স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়ে পালিয়েছিলেন। গুলশান হামলায় নিহত তাওসিফ ও নিবরাস ৩ ফেব্রুয়ারি একসঙ্গে ঘর ছাড়েন। আর ২৯ ফেব্রুয়ারি ঘর ছেড়েছিলেন মীর সামিহ মোবাশ্বের। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর ঘর ছেড়েছিলেন রোহান ইমতিয়াজ।
এরপর সর্বশেষ তাদের দেখা মেলে ১ জুলাই গুলশানের আর্টিজান বেকারির জঙ্গি হামলায়। তারা সবাই যৌথ অভিযানে নিহত হন। এদিকে নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যরা বিশ্বাসই করতে পারছেন না, তারা স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে যেতে পারে কিংবা জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে। এ বিষয়ে তারা কোনো ধারণাও করতে পারছেন না।
সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি
আপনার মতামত লিখুন :