এবার কী হবে বদির?

  • নিয়ন মতিয়ুল | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ৩, ২০১৭, ০২:৩৪ পিএম
এবার কী হবে বদির?

ঢাকা: এটা বাংলা ছবির একটা কমন ডায়ালগ। ভিলেন আর নায়কের মধ্যে এমন কথা প্রায়ই শোনা যায়। তবে এবার বাস্তবেই শোনা গেল এমন ডায়ালগ। কোনো ভিলেন যখন জনগণের প্রাণ অতিষ্ট করে তুলতে থাকেন, তখন জনগণ চুপ করে থাকেন। অপেক্ষা করেন ভোরের আলোর। একদিন সকালে সত্যি শুনতে পান নায়কের হাতে ধোলাই খেয়েছেন ভিলেন। তখন ভিলেনের করুণ অবস্থা দেখে কারো মুখে চলে আসে এই ডায়ালগ- এখন কী হবে রে বদি?

বলা উচিত, বদি নামটা উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়। স্রেফ সিনেমার ডায়ালগ মাত্র। তবে বললে কি হবে, কাকতালীয়ভাবে এ ডায়ালগের বদির সঙ্গে যে মিলে গেল কক্সবাজারের প্রভাবশালী এমপি আব্দুর রহমান বদির নাম। কি আর করা? মিলে যখন গেছেই তখন শানে নুযুলটা বলাই ভালো।

দলের ভেতর থেকে ‘কাউয়া আর ফার্মের মুরগিদের’ বিতাড়িত করার কঠিন ব্রত নিয়েছেন দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবশালী সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যে আইনের ঊর্ধ্বে নন, তার ভূমিকায় বার বার এ সত্যের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। আরো একটি বার্তা পাওয়া গেল তার কাছ থেকে। 

সম্প্রতি উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোরায়’ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে অংশ নিতে ওবায়দুল কাদের ১ জুন বিকেলে গিয়েছিলেন কক্সবাজারে।

পরদিন ২ জুন তিনি কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের দলীয় এমপি আব্দুর রহমান বদির নির্বাচনী এলাকায় টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ সড়ক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। সড়কটি দীর্ঘদিন ধরে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে। সড়কের বেহাল দশায় এমপি বদির ওপর ভীষণভাবে চটে গেলেন ওবায়দুল কাদের। 

কেন্দ্রীয় নেতা ও সাংবাদিকদের সামনেই ক্ষোভ প্রকাশ করে এমপিকে বললেন, ‘দুই দুইবার এমপি হইলা। কিন্তু এটুকু সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ঠিক করতে পারলা না। জনগণের এই ভোগান্তির জন্য তোমার শিক্ষা পাওয়া উচিত। তোমাকে আগামীবার নমিনেশন দেয়া হবে না।’

স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকাগুলোতে এ খবর ফলাও করে প্রকাশ করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের এই ঘোষণা বহুল আলোচিত-সমালোচিত-বিতর্কিত এমপি বদির জন্য কঠিনবার্তা বলেই মনে করছেন দলের নেতাদের পাশাপাশি স্থানীয়রা। তাই কক্সবাজারের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করেছেন, ‘এবার কী হবে রে বদি?’

বলা ভালো, গেল ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মত আওয়ামী লীগের টিকেটে এমপি নির্বাচিত হন আব্দুর রহমান বদি। ক্ষমতায় থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠতে থাকে। বিশেষ করে ইয়াবা পাচারের হোতা হিসেবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় তার নাম উঠে আসে।

তবে অবাক করা ঘটনা হচ্ছে, বদির বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ ওঠার পরও ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবারো মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত (?) হন। যদিও দুর্নীতির এক মামলায় গেল বছর (২০১৬) ক্ষমতাসীন দলের এই এমপিকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার একটি আদালত। সেই মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্টে বিচারাধীন।

তাহলে কি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর আর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছেই ভিলেন বনে গেছেন এমপি বদি? নাকি তার বিরুদ্ধে জনগণের কাছেও আছে আরো তথ্য প্রমাণ? 

গেল বছরের ৩০ জুলাইয়ের একটি ঘটনা সবার মনে আছে। ওইদিন টেকনাফের রোহিঙ্গা জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা। অভিযান চলাকালে হঠাৎ বাধা হয়ে দাঁড়ান এমপি বদি আর তার সহযোগিরা। তবে বিজিবিও অনড় অবস্থানে থাকে। এর একপর্যায়ে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে বাঁচেন এমপি বদিসহ টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ, ভাইস চেয়ারম্যান মৌলভী রফিক উদ্দিন এবং বাহারছড়ার চেয়ারম্যান মৌলভী আজিজ উদ্দিন। 

ওইদিনের অভিযানে জঙ্গি সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারেটি অরগানাইজেশনের (আরএসও) আলোচিত নেতা হাফেজ ছালাউল ইসলাম, মৌলভী ছৈয়দ করিম, মওলানা মো. ইব্রাহিম এবং একজন সৌদি নাগরিককে আটক করেছিল বিজিবি।

এই ঘটনা ঘটার আগেই জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা হিসেবে এমপি বদির নাম আলোচনায় উঠে আসে। শুধু তাই নয়, জানা যায়, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও নাগরিকত্ব দেয়া, ভোটার তালিকায় তাদের নাম তোলা, জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সে সময় এমপি বদির বিরুদ্ধে একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে সে ঘটনাকে মোটেই পাত্তা দেননি বদি। গণমাধ্যমের জেরার মুখে এমপি দাবি করেছিলেন তার বিরুদ্ধে এসবই ষড়যন্ত্র। 

আমরা জানি, মিয়ানমারের মুসলিম অধ্যুষিত আরাকান রাজ্যে জঙ্গি কার্যক্রমে যুক্ত থাকার অভিযোগে মিয়ানমার সরকার আরএসওকে নিষিদ্ধ করে। তাই সরকারের তাড়া খেয়ে ওই সংগঠনের নেতাকর্মীরা ঢুকে পড়ে কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে। পরে আত্মগোপনে থাকা সেসব জঙ্গিকে মদদ দেয়ার অভিযোগ ওঠে স্থানীয় জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে। তবে সে অভিযোগে অভিযুক্ত হন এমপি বদি ও তার সহযোগীরাও। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তার উঠে আসে।

স্থানীয় তথ্যমতে, বছর দুয়েক আগে এক ঈদ-উল আজহায় নিষিদ্ধ সংগঠন আরএসওসহ আরো দুটি জঙ্গি ইসলামী রোহিঙ্গা সংগঠনের পক্ষে ১৬৭০টি কোরবানির গরু বিতরণ করা হয় ক্যাম্পে। এসব গরু বিতরণের সময় আবদুর রহমান বদির পক্ষ থেকে তার ভাই ও ঘনিষ্ঠজনরা উপস্থিতি ছিলেন। 

এমপি বদির রোহিঙ্গা এবং আরএসও প্রীতির নেপথ্যের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দরা। তারা তথ্য দিয়েছেন, আবদুর রহমান বদিরাও ছিলেন জাতিতে রোহিঙ্গা। তার বাবা এজহার কম্পানি স্বাধীনতার আগেই মিয়ানমারের আরাকান থেকে কক্সবাজারে এসে বসবাস শুরু করেন। আর সে কারণেই রোহিঙ্গাদের প্রতি দুর্বল বদি। স্থানীয়দের অভিযোগ, পরিকল্পনা করেই ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের নাম তুলে বাংলাদেশের নাগরিক হতে সহায়তা করছেন।

স্থানীয়দের দেয়া তথ্যমতে, শুধু ইসলামী জঙ্গিদের মদদদাতা হিসেবেই নন, বদি ও তার পরিবারের অন্তত দশজন সদস্য ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত। অভিযোগ আছে, মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী আসনের এই প্রভাবশালী এমপি ও তার পরিবারের হাত ধরে ইয়াবার সবচেয়ে বড় চালানগুলো কক্সবাজার থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। আর এসব অপকর্মেই আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। 

গেল বছরে আলোচনা চলছিল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর দেয়া ইয়াবা ব্যবসায়ীদের একটি তালিকায় এমপি বদির নাম ইয়াবার গডফাদার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সে তালিকায় তার ভাই ও নিকটাত্মীয়-স্বজনদের নামও রয়েছে। 

গেল ২০১৫ সালে জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় আবদুর রহমান বদিকে কারাগারে পাঠানো হয়। কিছুদিন জামিনে মুক্ত হন। একই বছরে মানবপাচারে জড়িতদের নামের তালিকা নিয়েও দেশব্যাপী হৈচৈ পড়ে যায়। পুলিশ মানবপাচারে জড়িত অভিযোগে ১৭৬ জনের যে তালিকা করেছিল তার মধ্যে টেকনাফেরই ছিল ৭৯ জন। যাদের সবার ওপরের স্থান দখলে ছিল এমপি বদির।

শুধু কি এটুকুই? সরকারি কর্মকর্তাদেরও বেশ কয়েকবার পিটিয়ে সংবাদ মাধ্যমে আলোচিত সমালোচিত আর বিতর্কিত হন। স্থানীয়দের দাবি, প্রতিমন্ত্রী, প্রিসাইডিং অফিসার, ব্যাংক কর্মকর্তা, প্রকৌশলী কেউ-ই রক্ষা পাননি তার ‘শাসন ও শাস্তি’ থেকে। সর্বশেষ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তার অবৈধ সম্পদের বিষয়টি নিয়ে শুরু হয় আলোচনা।

এমপি বদির বিরুদ্ধে এমন সব স্পর্শকাতর অভিযোগ সরকারের কানে যে পৌঁছেনি তা কিন্তু নয়। বিশেষ করে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখন সরকার দলীয় এই এমপির বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠে তখন প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তা বড় ইস্যু হয়ে যায়। যে ইস্যুতে সরকারকে পড়তে হয় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে।

কক্সবাজারের বিতর্কিত স্বদলীয় প্রভাবশালী এমপি আব্দুর রহমান বদিকে নিয়ে ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য একদিকে সরকারদলীয় এমপিদের লাগামছাড়া কর্মকাণ্ডের জন্য যেমন সতর্কবার্তা, তেমনি সাধারণ মানুষের জন্যও স্বস্তির খবর।

সোনালীনিউজ/এন

সোনালী বিশেষ বিভাগের সাম্প্রতিক খবর

Link copied!