ডাকসু নির্বাচন

দ্বার খুলবে শিক্ষিত নেতৃত্বের

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৭, ২০১৯, ১১:৪৩ এএম
দ্বার খুলবে শিক্ষিত নেতৃত্বের

ঢাকা : অবশেষে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের (ডাকসু) নির্বাচন। নানা চড়াই উতরাই শেষে দীর্ঘ ২৮ বছর পর আয়োজন চলছে শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্টদের বহু আকাঙ্ক্ষিত এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের। দেশের রাজনীতিতে শিক্ষিত নেতৃত্ব গড়ে তুলতে প্রায় তিন দশক ধরেই দাবি ছিল ডাকসু নির্বাচনের।

রাষ্ট্রপতির আহ্বান, বিশেষজ্ঞদের দাবি, উচ্চ আদালতের নির্দেশ ও ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাদের বিভিন্ন আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে আগামী ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সেই নির্বাচন।

সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসছে, ডাকসু নির্বাচনের পর দেশের স্বায়ত্তশাসিত অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধ থাকা নির্বাচনগুলোর আয়োজন হবে কি? ডাকসু নির্বাচনের প্রভাব অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়বে কি? নেতৃত্ব সৃষ্টির বন্ধ থাকা জানালাগুলো কি সত্যিই খুলবে এই নির্বাচনের পথ ধরে?

কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ সচল থাকাকালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মুখর ছিল। প্রায় প্রতিদিনই হল সংসদে কোনো না কোনো অনুষ্ঠান থাকত। ছাত্রসংসদ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আগের মতো নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এ সুকুমারবৃত্তির চর্চা নেই বললেই চলে। হাতেগোনা কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নামেমাত্র সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হলেও বেশির ভাগেই এ কর্মকাণ্ড একেবারেই দূরে সরে আছে। সুস্থ সাংস্কৃতিক আয়োজনের শূন্য জায়গা কোথাও কোথাও দখল করে নিচ্ছে ধর্মীয় মৌলবাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও পা দিচ্ছে তাদের পাতা ফাঁদে। ছাত্রসংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সংস্কৃতি চর্চা নিয়মিত হবে কি— এ প্রশ্নও উঠে এসেছে সামনে।

‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রসংসদের নির্বাচন না হলে নেতৃত্বের শূন্যতা সৃষ্টি হবে’- বিশেষজ্ঞদের এ আশঙ্কা দেশে গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও বার বার উপেক্ষিত হয়েছে। বাংলাদেশের জন্মের আগে পাকিস্তান, এমনকি সামরিক শাসনামলেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ছাত্রসংসদ নির্বাচন হতো। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী হল সংসদসহ ঢাবির কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের নির্বাচন প্রতিবছর হওয়ার কথা থাকলেও স্বাধীনতার পর মাত্র সাতবার হয়েছে এ নির্বাচন।

১৯৯০ সালের ৬ জুন সবশেষ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গত শতকের নয়ের দশকের শুরুতে গণতন্ত্রে উত্তরণের সঙ্গে ডাকসুর দরজা বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের দাবি, ’৯০-এর পর থেকে ঢাবির দায়িত্বে আসা সব উপাচার্যই প্রতিশ্রুতি দেন ডাকসু নির্বাচনের। কিন্তু নির্বাচন আর হয়নি, কেউ কথা রাখেননি, হয়তোবা রাখতে পারেননি। কেন নির্বাচন হয়নি বা হচ্ছে না- এ নিয়ে আছে ছাত্র ও শিক্ষকদের ভিন্নমত। ছাত্রসংগঠনের নেতাদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একমুখী কর্তৃত্ব কমে যাওয়ার শঙ্কা থেকেই ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।

ডাকসুর সাবেক ভিপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) প্রধান প্রধান মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতেও নির্বাচনের বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখতেই ডাকসুকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। নেতৃত্ব না থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন নেতিবাচক কাজেও জড়িয়ে পড়ছে।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, ডাকসু নির্বাচনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের স্বায়ত্তশাসিত অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও। কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ছাত্র সংসদের কোনো বিধানই এখন পর্যন্ত যোগ করা হয়নি। ডাকসু নির্বাচন হয়ে গেলে একই আদলে গঠনতন্ত্র তৈরির চিন্তা-ভাবনা করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ সবার নির্বাচন হলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (জকসু) নির্বাচন হয় না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘অনেক বছর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোয় কোনো সংসদ ছিল না। নির্বাচনের প্রক্রিয়াও অনেক বিস্তৃত। ডাকসু নির্বাচনটা কেমন হয়, কী ধরনের সমস্যা হয়- সবকিছু বুঝেশুনে ওই আদলেই ছাত্রসংসদ নীতিমালা করব। ডাকসু নির্বাচন হয়ে গেলে একই আদলে গঠনতন্ত্র তৈরি করে একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটে পাস করে তা অনুমোদনের জন্য জাতীয় সংসদে পাঠাব।’

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) গত দুই দশক ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (বাকসু) নির্বাচন বন্ধ থাকলেও এখন উপাচার্য বলছেন, ‘বাকসু নির্বাচনের বিষয়ে ভাবছেন তারা।’ বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের মতে, বাকসু নির্বাচন এখন সময়ের দাবি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ডাকসুর আসন্ন নির্বাচনের হাওয়া লেগেছে বাকসুতেও।

বাকৃবি উপাচার্য ড. মোহাম্মদ আলী আকবর জানান, ‘প্রশাসন কখনোই বাকসু নির্বাচনের বিরোধী নয়। শিক্ষার্থীরা চাইলে অবশ্যই নির্বাচনের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বাকসু নির্বাচন হলে ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন ইস্যু সহজেই সমাধান করা সম্ভব হবে।’

নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্র রাজনীতির মধ্যে নেতৃত্বে শূন্যতা দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন বাকসুর সাবেক নেতা অধ্যাপক সাজ্জাত হোসেন সেলিম। তিনি বলেন, ‘বাকসু নির্বাচন দেওয়ার মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির একটি সহাবস্থান তৈরি হবে। এ ছাড়া তারা জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করবে।’

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ১৯৬১ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর নিয়মিতই হতো কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ নির্বাচন। সবশেষ ১৯৯৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় বাকসু নির্বাচন। কিন্তু গত দুই দশকে নির্বাচন না হওয়ার পরও ছাত্রসংসদ খাত দেখিয়ে প্রতিবছর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি নেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন না হওয়ায় একদিকে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটছে না, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের পথও নিশ্চিত হচ্ছে না। নির্বাচন বন্ধ থাকায় গণতন্ত্রের যে চর্চা হওয়া দরকার, সেটি হচ্ছে না। নির্বাচন না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের দাবি দাওয়া আদায়ের নির্দিষ্ট সংগঠন বা প্লাটফর্মও নেই।

ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনের মতো নতুন প্রেরণা ও উদ্যমে আলোচনার উত্তাপ ছড়াচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়ও। ডাকসুর আদলে ছাত্রসংসদের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের শীর্ষ কর্মকর্তারা (ইউজিসি)। ডাকসুর আদলে ছাত্র সংসদ চালু করে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি নির্বাচন ও রাজনীতিতে দক্ষ নেতা সৃষ্টির বিষয়ে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার প্রাথমিক পরিকল্পনাও করছে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়।

দেশে এখন অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা শতাধিক। সেসব প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি নিষিদ্ধ ও ছাত্রসংসদ না থাকায় নানা সঙ্কট নিয়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই, এমন অভিযোগ শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকও করে থাকেন। ২০১০ ও ২০১৫ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফির ওপর অযৌক্তিক ভ্যাট আরোপের প্রতিবাদে রাজপথে নেমে সফল আন্দোলন করেন সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। নিজস্ব দাবি আদায়ও করেন তারা। পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারসহ জাতীয় নানা ইস্যুতেও তাদের সরব উপস্থিতি ছিল রাজপথে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আন্দোলন চলাকালে দুর্বৃত্তদের হামলারও শিকার হন।

শেষ পর্যন্ত তারা আন্দোলনে সাফল্য পেলেও সেসব ধরে রেখে এখন পর্যন্ত কোনো শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন দাঁড় করাতে পারেননি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এর পেছনে মূল কারণ বিশ্ববিদ্যালয়েগুলোয় রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা ও ছাত্র সংসদের প্রয়োজনীয়তাকে এড়িয়ে যাওয়া। শিক্ষার্থীরা মনে করেন, তাদের নিজস্ব দাবি দাওয়া সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরতে ছাত্রসংসদ দরকার।

ছাত্রসংসদের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার না করলেও বিষয়টি পুরোপুরি শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষার ওপর নির্ভর করছে বলে মনে করেন ‘ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ’র (ইউল্যাব) উপাচার্য এইচ এম জহিরুল হক। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভবিষ্যতে কখনো ছাত্রসংসদ করলে তা খুব ভালো মানের হবেও যার দ্বারা আমাদের শিক্ষার্থী ও দেশ লাভবান হবে।’

এ বিষয়ে ইউজিসি কোনো সিদ্ধান্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর চাপিয়ে দিতে চায় না বলে জানান, প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, ‘ছাত্রসংসদ যেন ছাত্রদের মঙ্গলের জন্য হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমন কোনো কাজ তারা করবে না বলে আশা করি।’

শিক্ষা খাতে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনের নেতা সালাহ্ উদ্দিন মিঠু বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক বিভিন্ন দাবি থাকেই। দাবিগুলো সম্পর্কে বলার মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রতিনিধি নেই। সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রদায়িকতা ভর করছে। সাম্প্রদায়িকতা থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে আনতে চাইলে অবশ্যই ছাত্র সংসদ দরকার।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই

সোনালী বিশেষ বিভাগের সাম্প্রতিক খবর

Link copied!