যশোর: যশোরে রেললাইনের পাশ দিয়ে মেয়ের হাত ধরে হাঁটছিলেন এক নারী। বিপরীত দিক থেকে আসছিলো ট্রেন। ট্রেনটি কাছে আসতেই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে রেললাইনের উপর দাঁড়ালে ঘটনাস্থলেই মারা যান মা ও মেয়ে।
সোমবার (২৫ মার্চ) দুপুর আড়াইটার দিকে যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি পোলতাডাঙ্গা শ্মশানঘাট সংলগ্ন রেললাইনে ঘটে ওই ঘটনা। বেনাপোল থেকে যশোর হয়ে ঢাকাগামী ‘বেনাপোল এক্সপ্রেস’ ট্রেনে ওই ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে আত্মহত্যা করা নারীর পরনে ছিল কালো বোরকা। তার নাম লাকী বেগম (৩৫)। সেলোয়ার কামিজ পড়া মেয়ের নাম সামিয়া আক্তার মিম (১২)। লাকী উপজেলার বড় হৈবতপুর গ্রামের মকছেদ আলীর মেয়ে। মা-মেয়ে স্থানীয় সাতমাইল বাজারে একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। আর মিম স্থানীয় বড় হৈবতপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী।
স্থানীয় মসজিদের ইমাম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ফাঁকা মাঠের মধ্যে রেল লাইনের পাশে বসে মা-মেয়ে জন্মদিনের কেক খাচ্ছিলেন। কেক খাওয়ার মধ্যে ট্রেন চলে আসে। কালো বোরকা পড়া ওই নারী তার মেয়ের হাত ধরে ট্রেন লাইনের ওপরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু বারবার মেয়েটি তার মায়ের হাত জোর করে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু মা তার মেয়েটিকে নিয়ে জোর করে ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই মা-মেয়ে মারা যান। তিনি আরও বলেন, বাঁচার জন্য মেয়েটি তার মায়ের হাত অনেকবার ছাড়ানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু মা তার মেয়েটির হাত ছাড়েনি।
ঘটনার পর সেখানে গিয়ে দেখা যায়, যশোর ঢাকা রুটের রেললাইনের সদরের চুড়ামনকাটি পোলতাডাঙ্গা শ্মশানঘাট এলাকায় রেললাইনের উপরেই মা-মেয়ের মরদেহ পড়ে রয়েছে। যেখানে মরদেহটি পড়ে রয়েছে তার থেকে ৫০ গজ দূরে লাইনের পাশে অর্ধেক খাওয়া একটি জন্মদিনের কেক ও কোমল পানীয় পড়ে রয়েছে। পাশের কেক কাটার ছুরিটি রয়েছে। একটু দূরে মা মেয়ের দুই জুড়া জুতা ও দুটি ভ্যানিটি ব্যাগ পড়ে রয়েছে। এক সঙ্গে মা-মেয়ের এমন আত্মহননের খবর শুনতে পেরে দূরদূরান্ত থেকে বিভিন্ন বয়সী মানুষেরা ভিড় করতে দেখা গেছে।
রেললাইনের পাশেই একটি বড় মেহগনি গাছের নিছে কান্না করছেন নিহত লাকী বেগমের ছোট বোন রোজিনা বেগম। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, বছর ১২ আগে পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার কবিরুলের সঙ্গে বিয়ে হয় লাকীর। সেই ঘরের সন্তান হলো মিম। মিম হওয়ার বছর চারেক পর লাকীকে ডির্ভোস দেয় কবিরুল। এরপর তিনি বাবার বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন। এরমধ্যে বড় হৈবতপুর গ্রামের এজাজুল ইসলামের সঙ্গে লাকী সম্পর্ক করে বিয়ে করেন। এই বিয়ের বছর দেড়েক পর এজাজুলও লাকীকে ডির্ভোস দেয়। ডির্ভোসের পর মেয়েকে নিয়ে লাকী স্থানীয় সাতমাইল বাজারে ভাড়া থাকতে শুরু করে। মাস তিনেক আগে আবারও এজাজুল লাকীকে বিয়ের করার প্রতিশ্রুতি দেয়। মাঝে মধ্যে এজাজুল লাকীর বাসাতে যাতায়াত শুরু করে। তিন মাসের মধ্যে এজাজুল লাকীকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিলেও এজাজুল বিয়ে না করার তালবাহানা করে। এতে মেয়েকে নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন লাকী।
লাকীর বোন রোজিনা বেগম আরও বলেন, এজাজুল বিয়ে না করার তালবাহানা শুরু করাতে বিভিন্ন সময়ে আমার বোন আত্মহত্যার হুমকি দিতো। সোমবার সকালে ডাক্তার দেখানোর নাম করে আমার বোন ও তার মেয়ে মিমকে নিয়ে শহরে যান। আত্মহত্যার আগে মেয়েকে ভুলিয়ে রাখতে কিনেছিলেন জন্মদিনের কেক ও কোমল পানীয়। এরপর মিমের প্রিয় কেক নিয়ে তারা রেল লাইনের কাছে যায়। কিন্তু সেগুলো খেতে খেতেই মেয়েকে জোরপূর্বক টেনে হিঁচড়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেন লাকী।
তিনি অভিযোগ করেন, এজাজুল বারবার বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিয়ে না করায় তার বোন মানসিকভাবে হতাশা গ্রস্ত হয়ে পড়ে। সেই হতাশার জায়গা থেকে তার বোন আত্মহত্যা করতে পারে বলে জানান তিনি।
লাকীর ভগ্নীপতি জুম্মান আলী বলেন, একাকীত্ব ও অভাবের মধ্যেই লাকির সংসার পরিচালিত হচ্ছিল। লাকি হাতের কাজ করলেও সংসার ঠিকভাবে চলতো না। আমি বাজার করে দিলে তা দিয়েই চলতো। আমার মনে হয় অভাবের কারণে তিনি এই পথ বেছে নিয়েছেন।
ঘটনার পরেই ঘটনা স্থলে যায় জেলা ডিবি পুলিশের একটি টিম। জেলা ডিবি পুলিশের উপ-পরিদর্শক মফিজুল ইসলাম বলেন, ঘটনাস্থল থেকে এলাকাবাসী ৯৯৯ নাম্বারে ফোন করে দুর্ঘটনার খবর জানায়। এরপর আমরা এসে দেখি ট্রেন লাইনের উপরে দুইজনের মরদেহ পড়ে রয়েছে। কাছে থাকা মোবাইল ফোন থেকে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ওই নারী মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তবে কি কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন তা এখনও জানা যায়নি। মরদেহের পাশ থেকে একটি বড় আকারের কেক, একটি মোবাইল ফোন ও দুটি ভ্যানিটি ব্যাগ পাওয়া গেছে। রেলওয়ে পুলিশ লাশ উদ্ধার করেছে।
এমএস
আপনার মতামত লিখুন :