ঢাকা : ঢাকার জোড়া সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে দুই অংশের সব ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের ‘একক প্রার্থী’ নিশ্চিত করতে কেন্দ্রের ‘কঠোর নির্দেশ’ ও ‘নানা উদ্যোগের’ পুরোপুরি প্রতিফলন নেই ভোটের মাঠে।
কেন্দ্রীয় নির্দেশ বাস্তবায়নে ‘বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের’ কয়েক দফা চিঠি দেওয়া এবং ঢাকা মহানগরের দুই অংশের নেতাদের একাধিক বৈঠকেও তেমন কাজ হয়নি।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বেশিরভাগ ওয়ার্ডে দলের ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ সক্রিয়। ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় কয়েক নেতা ও ঢাকার বিভিন্ন সংসদীয় আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ‘মদদে’ দলের মূল প্রার্থীর বিরুদ্ধে মাঠে ‘বিদ্রোহীরা’ রয়েছেন। এতে দলের ভেতরের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে উঠছে বলে অভিযোগ তৃণমূলের নেতাকর্মীদের।
দলীয় সূত্র বলছে, আগামী ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ হলে ‘কঠোর সাংগঠনিক’ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয় দলের পক্ষ থেকে। কেউ দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ‘বিদ্রোহী’ হলে তাকে দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়েও দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েক নেতা অনানুষ্ঠানিকভাবে জানান দুই অংশের ‘বিদ্রোহী প্রার্থীদের’।
দুই সিটি করপোরেশনের সব ওয়ার্ডে ‘একক প্রার্থী’ নিশ্চিত করতে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্দেশও আসে। এরপরও দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে দলের ‘বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী’ হিসেবে অন্তত ১১৫ নেতা এখনো সক্রিয়।
ডিএসসিসির ৭৫টি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে ৪২টিতে আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ আছেন ৭২ জন। ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৫টিতে ৩৯ জন ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ আছেন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ১২৯ ওয়ার্ডের মধ্যে ৭৭টিতেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের ‘বিদ্রোহী’ মোকাবেলা করতে হতে পারে ভোটের দিন।
‘বিদ্রোহীদের’ প্রায় সবাই নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে মাঠে প্রচার ও জনসংযোগে করছেন। একই সঙ্গে দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে নানা বিষোদ্গার করছেন।
প্রথমে তিন শতাধিক ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ থাকলেও গত ৯ জানুয়ারি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে অন্তত দুইশ জন প্রার্থিতা স্থগিত করেন। বাকিদের মধ্যে বেশিরভাগই কোনো কেন্দ্রীয় নেতা, না হয় সংসদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তর এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কোনো কোনো শীর্ষ নেতার ‘প্রশ্রয়েই’ মাঠে রয়ে গেছেন বলে তৃণমূলের ধারণা।
‘বিদ্রোহীদের’ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। দলের অন্যদের সঙ্গে কথা বলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ‘ক্যাসিনো সাঈদ’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ও নানা অভিযোগে অপসারিত কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে ডিএসসিসির ৯ নম্বর ওয়ার্ডে এবার ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’।
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলাকালে বিদেশে আত্মগোপনে থাকা সাঈদ এক মন্ত্রীর ইশারায় দেশে ফেরেন বলে নেতাকর্মীদের মধ্যে আলোচনা আছে। সরকারি দল থেকে মনোনয়ন না পেয়ে তার ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ হওয়ার পেছনেও ওই মন্ত্রীর ‘মদদ’ রয়েছে ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) যুবলীগের কয়েক নেতাকর্মীর অভিযোগ।
গত বছরের প্রায় শুরুতে ঢাকার মতিঝিলের একটি টাওয়ারে অবস্থিত ক্যাসিনোতে অভিযান চালায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি দল। ওই ক্যাসিনোর মালিক ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ওই দলকে সম্রাটের বাহিনী ঘিরে ধরে। এ সময় সেখানে সম্রাটের সহযোগী সাঈদও ছিলেন।
সরকারের প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী সেদিন উল্টো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দলটিকে জেরা করতে শুরু করে। একজন মন্ত্রী ‘ক্ষুব্ধ’ সম্রাটকে শান্ত করেন। ওই মন্ত্রীর সম্রাট ও সাঈদকে ‘প্রশ্রয়’ দেওয়ার বিষয়টি দল ও সরকারের অনেকের জানা আছে বলে নেতাকর্মীরা মনে করেন। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ ডিএসসিসি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে প্রথমবারের মতো কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন সাঈদ।
ঢাকা-৭ আসনের আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য হাজি মো. সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমও এবার ডিএসসিসির ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে ‘বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী’। এ ওয়ার্ডে একসময় হাজি সেলিম কমিশনার ছিলেন। বাবার ওয়ার্ডে দলের মনোনয়ন না পেয়ে ইরফান ‘বিদ্রোহী’ হওয়ায় নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা ক্ষোভ আছে।
কেন্দ্রের নির্দেশে হাজি সেলিম যেখানে দলের ‘একক প্রার্থী’ নিশ্চিতে কাজ করার কথা, সেখানে তার ছেলে ‘বিদ্রোহী’ হওয়ায় নানা আলোচনা চলছে নেতাকর্মীদের মধ্যে। এবার ওই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর মোহাম্মদ হাসান, যিনি হাজি সেলিমের ভাগিনা।
মোহাম্মদ হাসান বলেন, ‘নির্বাচন থেকে সরে যেতে ইরফানকে একাধিক চিঠি দিয়েছে দল। কিন্তু তিনি তা আমলে নিচ্ছেন না।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদে সদ্য ঠাঁই পাওয়া এক নেতা ও কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য হওয়া কয়েক নেতার মধ্যে রাজধানীতে দলীয় রাজনীতিতে যে কোন্দল ছিল, এর রেশ ধরেও কয়েক ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির বিভিন্ন ওয়ার্ডে সক্রিয়।
সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্যের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ডিএনসিসির ২৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোকছেদ আলী মোল্লা ওই ওয়ার্ডে দলের ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’। একই সঙ্গে ডিএনসিসির ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে দলের ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ মাসুদ রানাও আওয়ামী লীগের ওই কেন্দ্রীয় নেতার অনুসারী।
সূত্রমতে, গত ৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি এবং উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ মুলতবি সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে যারা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে প্রার্থী হয়েছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করার।
এরপর ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
তাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকনেতাসহ ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা ছিলেন। তাদের উদ্যোগে চলা ‘বিদ্রোহীদের’ সঙ্গে আলোচনা, সলাপরামর্শ ও বৈঠকের পরও কেন্দ্রীয় কয়েক নেতার ‘মদদেই বিদ্রোহীরা’ মাঠে আছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
অন্যদিকে এবারের নির্বাচনে দলের ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ হলে তার বিরুদ্ধে ‘কঠোর সাংগঠনিক’ ব্যবস্থা কী হতে পারে, তাকে একটা ‘নির্দিষ্ট সময়’, নাকি ‘আজীবনের জন্য’ দল থেকে বহিষ্কার করা হবে- এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শিগগিরই আসবে বলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক সূত্র জানায়।
গত সময়ে জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকারের কয়েকটি নির্বাচনে ‘বিদ্রোহীদের’ শাস্তি না হওয়ায় এবারও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে প্রার্থী হলে কিছু হবে না, এমনটা কোনো প্রার্থীর মনে করার সুযোগ এবার কোনোভাবেই রাখতে চায় না দল। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ‘বিদ্রোহী’ হওয়ায় দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়েও শিগগিরই ঘোষণার কথাও ভাবছেন নীতিনির্ধারকরা।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :