• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
৩ জঙ্গির স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ

স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে কেমন আছে তারা!


ঘোড়াঘাট (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানুয়ারি ১৫, ২০২১, ০৩:১২ পিএম
স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে কেমন আছে তারা!

দিনাজপুর : ২০১৫ থেকে ১৮ সাল পর্যন্ত বেশ তৎপর হয়ে উঠেছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুর মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। তবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান এবং নিয়মিত অভিযানের ফলে কোন পরিকল্পনাতেই সফল হতে পারেনি জেএমবি। ঠিক সেই সময় সরকারের আন্তরিকতায় এবং র‌্যাব-১৩ ব্যাটালিয়নের উদ্দ্যেগে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার অঙ্গীকারে ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে রংপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন জেএমবির তিন জন সক্রিয় সদস্য।

আত্মসমর্পণকারী সেই তিনজন জেএমবির সদস্যরা ছিলেন, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার লোহারবন গ্রামের মনদেল হোসেনের হাফেজ মো. মাসুদ রানা (২২), বিন্যাগাড়ী গ্রামের জিল্লুর রহমানের ছেলে হাফিজুর রহমান (১৯) এবং অপরজন একই উপজেলার জয়রামপুর গ্রামের সারোয়ার হোসেনের ছেলে আখতারুজ্জামান ওরফে আক্তারুল (২০)।

স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণের পর ওই তিন জঙ্গির পুনর্বাসনের জন্য র‌্যারের পক্ষ তাদের হাতে ৫ লক্ষ টাকার চেক হস্তান্তর করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। আত্মসমর্পণের চার বছর পর কেমন আছে তারা! কিংবা সামাজিক সমাজে তাদেরকে গ্রহণ করতে পেরেছে কি তাদের প্রতিবেশী ও সমাজের অন্যান্য সদস্যরা!

সরেজমিনে খোঁজখবর নিতে গেলে হাফেজ মাসুদ রানার মা ফাতেমা বেগম জানান, ছোট বেলা থেকেই স্থানীয় কওমী মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেছে মাসুদ। মাদ্রাসা থেকে হাফেজ হয়ে বাড়ির পাশের দাখিল মাদ্রাসাতে ৮ম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিল মাসুদ। তবে কখন ভুল পথে পা দিয়েছিল মাসুদ তা পরিবারের কেও জানেনা। ছেলেকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে র‌্যাবে কর্মরত এক ভাগ্নী জামাইকে জানান। পরে সে র‌্যাব কর্মকর্তা আত্মসমর্পণ করার পরামর্শ দেন। তাই আত্মসমর্পণের ১৫ দিন আগে র‌্যাবের হাতে মাসুদকে তুলে দেন তার বাবা।
আত্মসমর্পণের পর ৬২টি দিন র‌্যাবের হেফাজতে থেকে বাড়িতে ফিরেছে মাসুদ। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে শিক্ষা জীবনে ফিরে গিয়েছে সে। ঢাকায় একটি মাদ্রাসা থেকে দাখিল এবং বগুড়া সরকারী শাহ সুলতান কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে রাজশাহীর একটি কোচিং সেন্টারে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন মাসুদ রানা। গরিব কৃষক ঘরের সন্তান মাসুদ। দুই ভাইয়ের মধ্যে মাসুদ ছোট। মাসুদের বড় ভাই পড়াশুনা শেষ করে একটি ঔষধ কোম্পানীতে চাকুরি করছে।

স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণকারী আরেকজন হাফিজুর রহমান বলেন, পুরনো দিনের সেই সব স্মৃতি আর মনে করতে চাই না। আত্মসমর্পণের আগে যে ভয় মনে ঢুকে ছিল। তা আজও আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। অপরিচিত কাউকে দেখলে এখনও ভয় লাগে। মনের অজান্তে ভুল পথে চলে গিয়েছিলাম। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে অনেক ভালো আছি।

হাফিজুরের বাবা জিল্লুর রহমান জানান, সপ্তম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় তিন বন্ধু সহ তার ছেলে আত্মসমর্পণ করেছিল। বাড়ি ফিরে পড়াশুনায় মনোনিবেশ করেছে সে। এলাকার স্কুল থেকে জেএসসি ও এসএসসি শেষ করে জয়পুরহাটের একটি সরকারী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশুনা করছে সে। করোনার প্রাদুর্ভাবে কলেজ বন্ধ থাকায় বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখাশুনা করছে হাফিজুর। দুই ভাই বোনের মধ্যে হাফিজুর ছোট। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে পুরনো দিনের সব স্মৃতি ভুলে নতুন জীবন শুরু করতে বেশি গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে হাফিজুরের প্রতিবেশীরা। মনোবল শক্ত রাখতে প্রতিবেশীরা সব সময় পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে।

স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণকারী অপর আকেজন আক্তারুল পুরনো দিনের স্মৃতির বিবরণ দিয়ে বলেন, আমরা তিনজন বন্ধু ছিলাম। কলাবাড়ি দাখিল মাদ্রাসাতে আমি ও হাফিজুর সপ্তম শ্রেণীতে এবং মাসুদ অষ্টম শ্রেণীতে পড়াশুনা করতাম। আমাদের মাদ্রাসার পিয়ন ছিল আরিফুল ইসলাম। তার বাড়ি রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলায়। সে নিয়মিত আমাদের তিনজনের খোঁজখবর রাখত এবং বিভিন্ন বই পড়তে দিত। মাঝে মাঝে সে আমাদের তিনজনকে নিয়ে গল্প করতে বসত এবং বিভিন্ন উসকানীমূলক গল্প শোনাতো। তার মাধ্যমেই আমরা ভুল পথের দিকে যাচ্ছিলাম। এর মাঝে একটি হত্যা মামলায় আরিফুলকে প্রশাসন গ্রেপ্তার করে।

তার কিছুদিন পরে একটি পত্রিকায় জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় জড়িত আছে এমন কয়েকজনের নাম আসে নিউজে। সেখানে আমাদের তিনজনের নাম ছিল। নিউজে আমাদের নাম দেখে আমরা ভয় পেয়ে চাই এবং র‌্যাবের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করি। আত্মসমর্পণের পর ৬২ দিন আমরা র‌্যাব হেডকোয়ার্টারে ছিলাম। এ সময় র‌্যাবের অফিসাররা নিয়মিত আমাদের খোঁজখবর রাখত। কয়েকদিন পর আমাদের বাড়ি থেকে বাবা-মা আমাদেরকে দেখতে যেত। ৬২ দিন পর র‌্যাব আমাদের বাবা-মাকে ডেকে আমাদেরকে তাদের হাতে তুলে দেয় এবং আমরা বাড়িতে ফিরে আসি। বর্তমানে আমি আমাদের উপজেলার একটি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশুনা করছি। ভুল পথে পা দিয়ে আমরা অনেক বড় ভুল করেছিলাম। এখন আমরা তা উপলব্দি করতে পারছি। স্বাভাবিক জীবনে এসে আমার অনেক ভালো আছি। র‌্যাবের অফিসাররা নিয়মিত আমাদের খোঁজ খবর নেন।

আত্মসমর্পনকারী তিন জনের বাবা-মা আরো জানায়, স্বেচ্ছায় আত্মসমপর্ণের পর নগদ ১ লক্ষ টাকা তাদের হাতে তুলে দিয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বাকি ৪ লক্ষ টাকা আত্মসমর্পণকারী ৩জন ও র‌্যাবের নামে খোলা পৃথক তিনটি যৌথ একাউন্টে এফডিআর করে দিয়েছে র‌্যাব। সেই একাউন্ট থেকে প্রতি তিন মাস পর পর ১০ হাজার ৮৮৮ টাকা করে লভ্যাংশ তুলে নিয়ে আসে তারা। আর এই লভ্যাংশের টাকা দিয়েই চলছে তাদের পড়ালেখার কার্যক্রম। র‌্যাব সহ প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিয়মিত তাদের সার্বিক খোঁজখবর নেন।

এ দিকে র‌্যাব-১৩ (রংপুর) ব্যাটালিয়নের মিডিয়া অফিসার এএসপি খন্দকার গোলাম মর্তুজা বলেন, সক্রিয় জঙ্গি সদস্যের প্ররোচনায় এই তিন যুবক খুব অল্প বয়সে ভুল পথে পা দিয়েছিল। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার প্রাথমিক পর্যায়ে থাকা অবস্থায় তাদের সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। পরে তারা তাদের ভুল গুলো শুধরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। পরে র‌্যাব হেডকোয়ার্টারের সিন্ধান্ত অনুযায়ী এবং র‌্যাব-১৩ ব্যাটালিয়নের আয়োজনে এই তিনজন আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে শিক্ষা জীবনে ফিরে গিয়েছে। লোকাল কোম্পানী, ব্যাটালিয়ন সদর এবং র‌্যাব হেডকোয়ার্টার নিয়মিত তাদেরকে মনিটরিং করছে। আমরা নিয়মিত তাদের সার্বিক বিষয়ের খোঁজখবর রাখছি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!