• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অতি ব্যবহারে নাব্য হারাচ্ছে সুরমা


সিলেট ব্যুারো মার্চ ২৩, ২০২১, ০৪:৫২ পিএম
অতি ব্যবহারে নাব্য হারাচ্ছে সুরমা

সিলেট : মারাত্মক দূষণের কবলে পড়েছে সিলেটের সুরমা নদী। নিজেদের ইচ্ছেমতো সুরমাকে ব্যবহার করছেন দু পাড়ের মানুষ। ইচ্ছেমতো বর্জ্য ফেলছেন, বুক চিরে তুলছেন বালু। দু পাড়ের সবাই যেন সুরমাকে তিলে তিলে মেরে ফেলার মিশনে নেমেছেন।

দীর্ঘদিন ধরেই সুরমায় নদীর ব্যবস্থাপনায় এমন নৈরাজ্য চলছে। এতে এক পাড়ে অস্বাভাবিক চর জাগলেও অন্য পাড় বিলীন হচ্ছে ভাঙনে। কেউ কেউ আবার দুই পাড় দখল করে গড়ে তুলছেন স্থাপনা। সব মিলিয়ে দিন দিন নাব্য হারাচ্ছে সিলেটের গর্ব সুরমা। আর পানির গতি থমকে প্রতিদিনই কুৎসিত আকার ধারণ করে রূপও হারাচ্ছে একসময়ের স্রোতস্বিনী নদীটি।

অপরদিকে, পলিথিন-প্লাস্টিক ও অপচনশীল বর্জ্য অবাধে ফেলা হচ্ছে নদীতে। এতে পানি দূষণের পাশাপাশি নদীর পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে।

সরেজমিনে সুরমার পাড় ঘুরে দেখা গেছে দূষণের চিত্র। নদীর অবস্থা এতটাই খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জেগে উঠা চরে বালুর ওপর কয়েক স্তরে ময়লার স্তূপ তৈরি হয়েছে।

দুপাড়ের চিত্রই এক। পুরো শহরের ময়লা পানি গিয়ে পড়ছে সুরমায়। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে নগরের বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে খ্যাত কালিঘাট অংশটি। সুরমার উত্তরপাড়ের এ এলাকাটি মোগল আমল থেকেই পুরো সিলেটের বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। জেলার তেরোটি উপজেলারই পাইকারি বাজার এই কালিঘাট। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নানা প্রকার নিত্যপণ্য এসে পৌঁছায় বাজারটিতে। এসব পণ্যের কয়েক টন বর্জ্য প্রতিদিনই ফেলে দেওয়া হয় সুরমার বুকে।

কালিঘাটের ঠিক ওপাড়ে চিত্র আরো ভয়াবহ। চাঁদনিঘাট হিসেবেই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে সুরমার দক্ষিণপাড়ের এই অংশটি। এখানে গড়ে উঠেছে সিলেটের গাড়ি ভাঙ্গা শিল্প। সুরমা দেশের অন্যতম প্রধান নদী। উত্তর-দক্ষিণ দুভাগে সিলেট নগরকে বিভক্ত করে মহাকাল ধরে বয়ে চলেছে সুরমা। ভারতের বরাক নদী আসাম থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় জকিগঞ্জের আমলসিধ নামক স্থানে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়। এর একটি সুরমা আর অপরটি কুশিয়ারা।

২৪৯ কিলোমিটার বা ১৫৫ মাইল দৈর্ঘ্যের সুরমা নদীটি সুনামগঞ্জ জেলার বাউলাই নদীর মোহনায় গিয়ে মিশেছে। একসময় এই সুরমা ছিল দেশের উত্তর-পূর্ব জনপদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। বড় বড় জলযানও তখন ঘুরে বেড়াতো সুরমার বুকে। ব্রিটিশ আর পাকিস্তান পরবর্তী বাংলাদেশ সড়ক যোগাযোগে ব্যাপক উন্নতি হওয়ায় অবহেলায় পড়ে সুরমাও। কয়েক দশক আগেও যে নদীতে বড় বড় জলযান প্রবেশ করত, এখন শুষ্ক মৌসুমে ইঞ্জিনচালিত নৌকা যাতায়াত করতেই বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। যত্রতত্র বর্জ্য ফেলার কারণে নাব্য হারিয়ে মরতে বসেছে নদীটি। বর্জ্য ফেলার দূষণ শুষ্ক মৌসুমে যেমন দৃশ্যমান থাকে তেমনি তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষাতেও সুরমা ফুলে নগরে তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। পাশাপাশি দূষণে ব্যাহত হচ্ছে পানির ব্যবহারও।

পরিবেশবাদীদের মতে, সুরমা নদী সিলেট অংশে তার নাব্য হারাচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে ফেলা নগরের আবর্জনায়। বর্জ্যের স্তূপ আর পলিথিনে জমে ভরে গেছে নদীর তলদেশ। নদীটির সিলেট জেলার বিভিন্ন অংশে এখন পলিমাটি জমে চর গজিয়েছে।

জানা গেছে, সিলেট নগর সংলগ্ন সুরমার উপর শাহজালাল (র.) ১ম, ২য় ও তৃতীয় সেতুর পিলারে পানির স্রোতকে বাধাগ্রস্ত করে জমে উঠেছে চর। তার চেয়েও ভয়াবহ নদীদূষণ হচ্ছে অসচেতনভাবে নগরের বর্জ্য ফেলে। নগরের হাজারো টন পলিথিন সুরমার মৃত্যঘণ্টা বাজিয়ে বিপন্ন করে তুলেছে পরিবেশ। এ নিয়ে খোদ প্রকৌশলী ও পরিবেশবিদরাও হতাশা প্রকাশ করেছেন।

সিলেট নগরসংলগ্ন কুশিঘাট, কুশিটুক, শ্রীরামপুর, কাজিরবাজার, শহরতলীর মেন্দিবাগে নদীগর্ভে চর জেগে খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। গড়ে উঠা এসব মাঠে প্রতিদিন খেলাধুলা করছেন স্থানীয় শিশু-কিশোররা। আর  সেই মাঠ থেকে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বিক্রি হচ্ছে মাটিও।

নদীতীরের কৃষকরা জানান, শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি কমে যাওয়ায় তীরবর্তী গ্রামের কৃষকরা ধান ও সবজি চাষে আগ্রহ ক্রমে হারিয়ে ফেলছেন। এ কারণে আবাদি জমিগুলোও এখন অনাবাদি হয়ে পড়ছে। পাঁচ বছর আগে নদীর যে অংশে শুষ্ক মৌসুমেও পানির উত্তাল প্রবাহ ছিল, এখন সেখানে যত দূর চোখ যায় কেবল ধু ধু বালুচর। গত কয়েক বছরে ধীরে ধীরে এই পরিবর্তন হলেও দুই বছর ধরে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে বলে জানান কৃষকরা। অন্যবারের তুলনায় এবার নদীতে বেশি জায়গাজুড়ে চর জেগেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তরা বলছেন, সুরমার অন্তত ২৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার অংশ বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত এলাকায়। ফলে ভারতের সম্মতি না পাওয়ায় খননের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তবে, ২০১৮ সালে সিলেট সদর ও বিশ্বনাথ এলাকার নদীর কিছু চর খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, প্রায় ২৪৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সুরমার ১১০ কিলোমিটারই পড়েছে সিলেটে। গত দুই দশকে এই ১১০ কিলোমিটারের ৪০-৪৫ শতাংশে চর পড়েছে। যেখানে চর পড়েনি, সেখানে নদীর তলদেশ ভরাট হয়েছে।

নদী বিশেষজ্ঞরা সুরমার দূষণের নানা পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। নদীকে বাঁচানোর জন্য বিশ্লেষণে পথ দেখিয়েছেন তারা।

তাদের মতে, আকস্মিক বন্যা এবং এর ভয়াবহতা প্রশমন তথা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখার প্রয়োজনে নিয়মিত নদী খনন কার্যক্রম জোরদার করা জরুরি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নদীর তীর সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অবৈধভাবে নদীর দুপাশের জায়গা দখল শক্তভাবে প্রতিহত করতে হবে। ভূ-উপরস্থ পানির দূষণের জন্য মানুষই সবচেয়ে দায়ী, আর তাই জনসচেতনতার মাধ্যমে দূষণরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

কেবল পানির জন্য নয়, পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য নদীকে দূষণমুক্ত রাখতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত নদীর গুণগতমান পরীক্ষা করার পদক্ষেপ নিতে হবে। বিভিন্ন নৌযান থেকে পানিকে দূষিত করে এমন পদার্থ এবং তেল নিঃসৃত হচ্ছে কি না সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। সিটি করপোরেশন বা অন্যান্য এলাকার বর্জ্য নিক্ষেপণ স্থানকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, যেন বৃষ্টির দিনে এ থেকে পানি দূষণ রোধ করা যায়। নালাসমূহকে প্রয়োজনে ছাঁকন পদ্ধতির আওতায় নিয়ে আসতে হবে, যা কিনা নদীর পানি দূষণ রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নদীর তীরে গড়ে উঠা সব ধরনের ছোট-বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার প্রভৃতিতে সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পরিবেশ ও পানি দূষণের সাথে সংশ্লিষ্ট বিদ্যমান আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দূষিত পদার্থ উৎপাদন ও নদীর পানিতে নিক্ষেপণের জন্য সময়োপযোগী এবং কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। ভূ-উপরস্থ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে সমন্বয় সাধন করতে হবে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, নানা অব্যবস্থাপনায় সুরমা নদী দূষিত হচ্ছে। তিনি বলেন, অনেকেই সুরমায় বর্জ্য ফেলছেন। দূষণের প্রধান একটি কারণ এটি। আমরা নগরকে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে এসেছি। নগরীর তিনটি স্থানে (টিলাগড়, শাহী ঈদগাহ, রিকাবী বাজার) অত্যাধুনিক ডাস্ট সাব স্টেশন তৈরি করা হয়েছে। এর পরও নদীতে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন মেয়র আরিফ।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শহীদুজ্জামান সরকার জানান, বরাক উপত্যাকায় সুরমার উৎসমুখ খননে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। এ নিয়ে সচিব পর্যায়ে আলোচনাও হয়েছে। সুরমার নাব্যতা বাড়াতে কানাইঘাট থেকে ছাতক পর্যন্ত ১২৫ কিলোমিটার বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ) খননের উদ্যোগ নিয়েছে। আর ভাঙনরোধে পাউবো সিলেটের সদর উপজেলায় ৮৫০ মিটার ও বিশ্বনাথ উপজেলার রাজাপুর পর্গনাবাজার পর্যন্ত ৮০০ মিটার এলাকায় কাজ চলতেছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!