• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সুন্দরবনে ১৪ বছরে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে ২৪টি


নিজস্ব প্রতিবেদক এপ্রিল ১৮, ২০১৬, ০৮:১১ পিএম
সুন্দরবনে ১৪ বছরে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে ২৪টি

সোনালীনিউজ ডেস্ক

গত ১৪ বছরে সুন্দরবনে মোট ২৪টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। বার বার অগ্নিকান্ড আর জাহাজ ডুবির এসব ঘটনায় ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সুন্দরবন। মাত্র চার দিনের ব্যবধানে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধান সাগর স্টেশনের নাংলি ফরেস্ট ক্যাম্প এলাকায় দ্বিতীয় দফা আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।

সোমবার সকাল ৯টার দিকে এ আগুনের সূত্রপাত হয়। এর আগে ২৭ মার্চ একই এলাকায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে অগ্নিকান্ড প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া ও দোষীরা শাস্তি না হওয়ায় পূর্ব সুন্দরবনের অরণ্যে ১৪ বছরে সরকারি-বেসরকারি হিসাবে ২৪টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ ও বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সালের ২২ মার্চ সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জে কটকা অভায়ারণ্য প্রথম অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। পুড়ে যায় ১ একর বন। এরপর ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলী ক্যাম্পের মাদ্রাসার ছিলা এলাকার ৩ একর বন পুড়ে যায়। ২৭ মার্চ আড়িয়ার খাল এলাকায় বনের ভিতর অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে।

একই বছরের ২৭ ডিসেম্বর আড়ুয়াবেড় এলাকায় আগুনে পুড়ে যায় প্রায় ৯ শতক বন। ২০০৫ সালের ৮ এপ্রিল ধানসাগর স্টেশনের অধীন কদলতেজী এলাকায় পুড়ে যায় আড়াই একর বন। এর ৫ দিন পর ১৩ এপ্রিল একই রেঞ্জের তুলাতলা এলাকায় পুড়ে যায় সাড়ে ৪ একর বন। এর পরের বছর ৩ মার্চ চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের ২৫ নম্বর কম্পামেনেটের আড়াই একর বন পুড়ে যায়। ১৯ মার্চ শরণখোলা রেঞ্জের তেরাবেঁকা এলাকায় পুড়ে যায় প্রায় দেড় একর বনভূমি। ২০০৬ সালের ১১ এপ্রিল চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া টহল ফাঁড়ি এলাকায় পুড়ে যায় প্রায় ৫০ শতক বন। এর একদিন পর কলমতেজির টহলফাড়ির খুটাবাড়িয়া এলাকার দেড় একর, পহেলা মে নাংলীর পচাকুড়ালিয়া এলাকার ৫০শতক, এর ৩ দিন পর ৪ মে ধানসাগর স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় অগ্নিকান্ডে আড়াই একর বনভূমি পুড়ে যায়।

২০০৭ সুন্দরবনে ৩টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ১৫ জানুয়ারি শরনখোলার ডুমুরিয়া ক্যাম্প এলাকায় ৫ একর, ১৯ মার্চ চাদপাই রেঞ্জের নাংলী এলাকার ২ একর ও ২৮ মার্চ একই এলাকার ৮ একর বনভুমি পুড়ে যায়। ২০১০ সালের ২০ মার্চ ধানসাগর স্টেশনের গুলিশাখালী এলাকায় প্রায় ৫ একর বন পুড়ে যায়। এর পরের বছর ২০১১ সালে মার্চ মাসে তিন দফা অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ১ মার্চ নাংলী এলাকার ২ একর ও ৮ মার্চ একই এলাকার ২৫ নম্বর কম্পামেন্টে টানা ৩দিনের অগ্নিকান্ডে প্রায় সাড়ে ৩ একর বন পুড়ে যায়।

এ আগুন নেভাতে না নেভাতেই ৯ মার্চ ভোলা নদী থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে গহীন বনে হঠাৎ আগুন জ্বলে ওঠে। ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ টানা ৩ দিনের অগ্নিকান্ডে পুড়ে যায় প্রায় ১০ একর বনভুমি। ২১ মে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের ৬৫ ছিলায় আগুনে সাড়ে ৩ একর বন পুড়ে যায়। ২০১৬ সালের ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলি ফরেস্ট ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকার আগুন লাগে। এতে পুড়ে যায় ১০ একর বনভূমি। ১৩ এপ্রিল বুধবার সকালে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাদঁপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী ক্যাম্পের আব্দুল্লারছিলায় আবার আগুন লাগে। মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে সবশেষ ১৮ এপ্রিল সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধান সাগর স্টেশনের নাংলি ফরেস্ট ক্যাম্প এলাকায় তৃতীয় দফা আগুন লাগার ঘটনা ঘটে।
পরিবেশবিদদের অভিযোগ, সুন্দরবনে যেকোন বিপর্যের পর প্রতিবার লোক দেখানো তদন্ত কমিটি হয়, কিন্তু সেই কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে না। শাস্তি পায় না জড়িত কোনো অপশক্তি। এ কারণে বার বার সুন্দরন হুমকির মুখে পড়ছে। তারা বলেন, সুন্দরবন বিশ্ববাসীর কাছে ঐতিহ্যমন্ডিত একটি স্থান (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ)। এটি আমাদের জন্য শুধু গর্বেরই নয়, ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছাস উপকূলীয় জনপদের কোটি মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় এই বন বর্মের ন্যায় কাজ করে। অনুসন্ধানীতে জানা যায়, সুন্দরবনে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় জেলে ও বনজীবীরা জড়িত থাকলেও অনেক সময় সুন্দরবনের অসাধু কর্তাব্যক্তিরাও জড়িত থাকেন।

এসব অসাধু কর্তাব্যক্তিরা কাঠ, হরিণ ও রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বন্যপ্রাণি পাচারকারীসহ দেশী ও আর্ন্তজাতিক চোরাকারবারীদের পণ্য নিরাপদ রুট ব্যবহারের জন্য অন্যত্র দৃষ্টি ফেরাতে পরিকল্পিতভাবে সুন্দরবনে আগুন লাগিয়ে দেয়। এছাড়া অনেকেরই ধারণা সুন্দরবনের মাটির নিচে থাকা গ্যাস থেকে কখনও কখনও অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত ঘটে। বনের মধ্যে পঁচা পাতা থেকে তৈরি হওয়া মিথেন গ্যাসের স্তর জমে গেলে বনজীবীদের ফেলা বিড়ি-সিগারেট থেকেও আগুনের সূত্রপাত হয়। মৌয়ালরা মধু আহরণ করতে বনে আসে। চাক ভাঙার সময় তারা আগুন ব্যবহার করেন। সেখান থেকেও বনে আগুন ছড়িয়ে থাকতে পারে।

তবে বন কর্মকর্তা বলছেন, দুষ্কৃতিকারীদের নাশকতা, বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ থেকেই অধিকাংশ সময় সুন্দরবনে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। কেননা সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার অধিকাংশ মানুষের জীবন- জীবিকা এ বনের ওপর নির্ভরশীল। তারা বনের ভিতর প্রবেশ করলে অনেকেই শুকনো ডাল-পালা কিংবা গোল পাতার উপর বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ ফেলে।

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনে বিভিন্ন সময় নানা কারণে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে সোমবারের অগ্নিকান্ড পরিকল্পিতভাবে নাশকতাকারীরা ঘটিয়েছেন।

তিনি জানান, ১৩ এপ্রিল আগুন লাগার ঘটনায় মামলা দায়েরের পর রোববার আদালত ছয় জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এর প্রেক্ষিতে নাশকতার উদ্দেশে পরিকল্পিতভাবে বন সংলগ্ন এলাকায় দুর্বৃত্তরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। বন বিভাগ এ বিষয়ে সতর্ক থাকায় অগ্নিকান্ডে এবার তেমন কিছু পোড়েনি। আগুন ধরার সাথে সাথে নিভিয়ে ফেলা হয়েছে।

মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, অপরাধীদের কঠোর হস্তে দমনের জন্য সোমবার ৫টি বিশেষ টহল টিম গঠন করা হয়েছে। যারা সার্বক্ষণিক বনের সম্পদ পাহাড়া দেবে। সুন্দরবন একাডেমির পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, যে কোন বিপর্যের পর প্রতিবার লোক দেখানো তদন্ত কমিটি হয়।

সেই কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে না। এ কারণে শাস্তি পায় না জড়িতরা। তিনি জানান, বনদস্যু ও অবৈধ্য অনুপ্রবেশকারীদের জন্য সুন্দরবনে বেশির ভাগ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে। সুন্দরবন বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক অধ্যাপক আব্দুল মান্না ও সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মোল্লা মাসুম রশিদের মতে, রাষ্ট্রের উদাসীনতা ও নীতিমালাহীনতা, রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সীমাহীন লুটেরা মনোবৃত্তি, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অবাধে বনের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ লুন্ঠন, অভ্যন্তরের নদ-নদী দিয়ে বিশালাকৃতির নৌযানের যাতায়াত-সুন্দরবনের প্রতিবেশ-পরিবেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বার বার জাহাজ ডুবিতে পরিবেশের চরম বিপর্যয় ও বার বার অগ্নিকান্ডে শত শত একর বনাঞ্চল পুড়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাওয়া সুন্দরবনকে বাঁচাতে এখনই সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানান তারা।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!