• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
এক মাসেই ঘটনার শিকার ১৮ হাজার ভুক্তভোগী

সাইবার ক্রাইম বাড়ছেই


নিজস্ব প্রতিবেদক নভেম্বর ৩০, ২০২০, ১১:০৬ এএম
সাইবার ক্রাইম বাড়ছেই

ঢাকা : রাজধানীতে একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আনিকা (ছদ্মনাম)। ভার্সিটির প্রথম বর্ষ থেকেই ক্লাসমেটের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান তিনি। ছয় মাস পর তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। একজনের সঙ্গে অন্যজনের কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। এ ঘটনার এক বছর পর আনিকা আরেকটি নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তখন তার সাবেক প্রেমিক সফিকুল ইসলাম এই সম্পর্ক না চালানোর জন্য জবরদস্তি করেন।

আনিকা রাজি না হলে তাদের আগেকার কাটানো কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ফুটেজ ভার্সিটির বন্ধুদের দেখাতে শুরু করেন সফিকুল। তার ফোন নম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন সাইটেও পোস্ট করেন। আনিকা সবার সামনে বিব্রত হতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারে যোগাযোগ করেন।

অপরাধী পরিচিত হওয়ায় পুলিশ সফিকুল ইসলাম নামের ওই শিক্ষার্থীকে সহজে আটক করে। তাকে সঙ্গে নিয়েই আপলোড করা নম্বরগুলো মোছা হয়। মুচলেকা দিয়ে মুক্ত হলেও সফিকুলের ওপর এখনো নজরদারি রেখেছে সিআইডি।

অপর আরেকটি ঘটনায় অন্তত ১৫ জন তরুণীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের নামে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে ভিডিও ধারণ করেছে মোহাম্মদ ইয়াসিন রাতুল নামের এক তরুণ। ওইসব ভিডিও দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আত্মসাৎ করে আবার শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে বাধ্যও করেছে সে।

সিআইডি বলছে, তরুণীদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলার পর প্রেমিকার মোবাইল ফোন দিয়েই আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ধারণ করত। পরে সুযোগ বুঝে রাতুল সেই ফোন চুরি করত। এরপর শুরু হতো ব্ল্যাকমেইল। কখনো নিজের পরিচয়ে, আবার কখনো অন্য পরিচয়ে সেই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করত। সর্বশেষ ছয় মাস আগে রাতুলের সঙ্গে রাজধানীর এক তরুণীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

একদিন তারা তিন বন্ধু মিলে রাতুলের সঙ্গে লঞ্চে চাঁদপুর ঘুরতেও যান। সেখানে তার অজান্তে আপত্তিকর ভিডিও ধারণ করে রাতুল। লঞ্চ থেকে নামার পর তার মোবাইল ফোনটি কথা বলার জন্য চেয়ে নেয়। এরপর পালিয়ে যায়। ওই দিন থেকেই তাকে ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি করতে থাকে রাতুল।

তরুণীর অভিযোগ পেয়ে সোমবার রাতে রাজধানীর বাংলামোটর এলাকা থেকে সিআইডির সাইবার টিমের সদস্যরা গ্রেপ্তার করে রাতুলকে। এরপর আদালত তাকে জেল হাজতে পাঠায়।

এভাবে প্রতিনিয়িত সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীরা। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ অপরাধের মাত্র এখন খুব কম।

সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার আশরাফুল আলম বলেন, রাতুলের সম্পর্কে আরো দুই তরুণী অভিযোগ করেছেন। তাদেরও প্রেমের ফাঁদে ফেলে ভিডিও ধারণ করে প্রতারণা করেছে রাতুল। সব মিলিয়ে তার হাতে প্রতারিত হয়েছে প্রায় ২০ তরুণী।

সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, রাতুল-সফিকুলের মতো এমন অনেককেই তারা আইনের আওতায় এনেছেন। অপরাধের গুরুত্ব বুঝে মামলা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

সিআইডির সদর দপ্তর সূত্র বলছে, এ বছরের ৫ থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত সাইবার পুলিশ সেন্টারের ফেসবুক পেজে ১৭ হাজার ৭০৩টি অভিযোগ এসেছে। ফোনে অভিযোগ করেছেন ৩৮ হাজার ৬১০ ভুক্তভোগী। এর মধ্যে হ্যারাসমেন্টের অভিযোগ ৩৬৫টি। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৮২টি। মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ১১৮টি। বাকিগুলোর তদন্ত চলমান।

পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, দুদিন আগে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডব্লিউ) ফেসবুক পেজ চালু করেছে সংস্থাটি। চালু হওয়ার দুদিনেই ৬৯১টি অভিযোগ গৃহীত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইউনিটটি দক্ষ জনবল কিংবা প্রযুক্তিগতভাবেও শক্তিশালী। প্রতিনিয়ত আপডেট হচ্ছে অপরাধীদের ডাটাবেজও। খুব অল্প সময়েই সক্ষমতা দেখিয়েছে সিআইডির সাইবার শাখা। তাই ভুক্তভোগী মানুষও তাদের প্রতি ঝুঁকছে বেশি।

সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রথম দিকে এই শাখায় অভিযোগ আসত খুব কম। কিন্তু সিআইডির পক্ষ থেকে নিরাপদ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ভিশন নিয়ে পুরোদমে কাজ শুরুর পর এখন অভিযোগ আসছে শত শত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাভাবে প্রতারণার শিকার হয়ে ভুক্তভোগী মানুষ আসছে তাদের কাছে।

সিআইডির সাইবার সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, তাদের ফেসবুক পেজে গত ১ সেপ্টেম্বর (২০২০) থেকে ১৮ নভেম্বর (২০২০) পর্যন্ত অভিযোগ আসে ৩৩৬টি। এর মধ্যে ৯টি অভিযোগের সমাধান করা হয়েছে। ৫টি অভিযোগ বাতিল করা হয়েছে। ২টি ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীদের থানায় মামলা করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

একই সময়ে ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করেছেন ৭ হাজার ২০ জন ভুক্তভোগী। অভিযোগ জানাতে ফোন করেছে ৮ হাজার ৪৮৬ জন। ফোনেই সমাধান হয়েছে ৫২৮টি অভিযোগের। অভিযোগ গ্রহণ করা হয়েছে ৩৩৬টি। এর মধ্যে হয়রানির বিষয়ে ৮৯টি, বিকাশ প্রতারণা নিয়ে ৪৯টি এবং অনলাইন বাজার নিয়ে ১০৩টি অভিযোগ নেওয়া হয়েছে। ডলার প্রতারণার ৩০টি, নাইজেরিয়ান প্রতারকদের বিষয়ে ৫টি এবং অন্যান্য বিষয়ে ৬০টি অভিযোগও আমলে নেওয়া হয়েছে। অসম্পূর্ণ তথ্য বা ঘটনা তুচ্ছ হলে কিছু অভিযোগ গ্রহণ করে না সিআইডির এই সাইবার টিম।

সংশ্লিষ্টরা আরো জানান, গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সাইবার বিভাগসহ সিআইডির সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোতে নভেম্বর পর্যন্ত মামলার পরিমাণ দাঁড়ায় এক হাজার ৬৪৬টি। এ সময়ে তদন্ত শেষে ৫৪টি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। নিষ্পত্তি করা হয়েছে ১১৮টি মামলার।

সিআইডির কর্মকর্তারা আরো জানান, এ বছরের মার্চের দিকেই দিনে গড়ে অভিযোগ ছিল ৫ থেকে ৬শ। সে সংখ্যা এখন ঠেকেছে প্রায় আড়াই হাজারে।

প্রতিদিন নতুন নতুন অভিযোগ যোগ হচ্ছে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারে। যেগুলোর বেশিরভাগই অনলাইন প্রতারণা, বিকাশ ও তরুণীদের ব্ল্যাকমেইলিং নিয়ে। সাইবার অপরাধীদের ডাটাবেজও সংরক্ষণ করা হচ্ছে সিআইডিতে। ফিঙ্গারপ্রিন্টসহ বিভিন্ন ফরেনসিক নমুনা রেখে দেওয়া হয়। যাতে পরে কেউ আবার একই অপরাধ করে ধরা পড়লে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

সিআইডি সাইবার পুলিশের সেন্টারের অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান বলেন, আমাদের কাছে যতগুলো অভিযোগ এসেছে তার অধিকাংশই প্রেমঘটিত সাইবার ক্রাইম। এসব ক্ষেত্রে তরুণীদের আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে সাইবার জগতে পদচারণা করাই ভালো। সেক্ষেত্রে অনেকাংশে ঝুঁকি কমে আসবে।

পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি অপারেশন খুরশিদ হোসাইন বলেন, ‘সাইবার ক্রাইম যে পর্যায়ে চলে গেছে এখন লজ্জা আর ভয় পেয়ে থাকলে চলবে না। ভুক্তভোগীদের অনুরোধ করব, সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার হলে সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগ করবেন। আমাদের সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলো আপনাদের সহায়তা করার জন্য পাশে থাকবে।’

সাইবার ক্রাইমের বিষয়ে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত সাইবার অ্যাক্টে ৬ হাজার ৯৯টি মামলা হয়েছে। এই অপরাধগুলো নিয়ে ডিএমপি, ডিবি, সিআইডি, পিবিআই কাজ করছে।

আপনারা যারা সাইবার জগতে প্রবেশ করছেন, সাইবার জগতের ঝুঁকি বিষয়ে সচেতন হয়েই ব্যবহার করবেন। তারপরও যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা তৈরি হয় সে বিষয়ে আমরা কাজ করব। এ ক্ষেত্রে ভিকটিমের সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করেই সেবা দেওয়া হবে।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!