• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ক্যাসিনো অ্যাপে অর্থ পাচার


নিজস্ব প্রতিবেদক এপ্রিল ১১, ২০২১, ০৯:৪১ এএম
ক্যাসিনো অ্যাপে অর্থ পাচার

ঢাকা : বাংলাদেশে ভার্চুয়াল জগতে কোটি কোটি টাকা মানি-লন্ডারিং করার পাশাপাশি অভিনব পন্থায় সরকারকে ভ্যাট ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে বিদেশি ভিত্তিক নিষিদ্ধ অ্যাপ স্ট্রিমকার।

স্ট্রিমকার অ্যাপটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতো দেখালেও সত্যিকার অর্থে এটি অনলাইন জুয়ার জন্য পরিচিত একটি অ্যাপ।

স্ট্রিমকার অ্যাপের ফাঁদে পড়ে যুবসমাজের একটি অংশ যেমন জুয়ায় অর্থ খোয়াচ্ছে তেমনি মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। লোভে পড়ে জয়েন করার পর টাকা না পাওয়ায় আত্মহত্যাও করতে গেছেন অনেকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশে বেকারত্বের হার বাড়তে থাকলে অনলাইন জগৎকে বর্তমানের তরুণ এবং যুবসমাজ বাড়তি আয়ের একটি মাধ্যম হিসেবে পছন্দ করে আসছে। কয়েক বছর ধরে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে অনেকেই ঘরে বসে বাড়তি আয় করছেন লেখাপড়ার পাশাপাশি। আর সেই সুযোগ নিচ্ছে স্ট্রিমকার নামক এই অ্যাপ।

বিশেষ করে সুন্দরী তরুণীদের টাকা লোপাটের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করাই এই অ্যাপের অন্যতম একটি ফাঁদ। দিনে কমপক্ষে একঘণ্টা ২০ মিনিট লাইভে থাকার কথা বলে সুন্দরীদের সাজিয়ে লাইভে রেখে উঠতি তরুণদের আকর্ষণ করেই টাকা আদায় করে স্ট্রিমকার। এই একঘণ্টা বিশ মিনিট এক মাস লাইভে থাকার পরে নির্ধারিত একটি বেতন দেওয়ার কথা বলে সেটিও দেয় না স্ট্রিমকার কর্তৃপক্ষ।

ফলে স্ট্রিমকারের লাইভে এসে অনেকেই আত্মহত্যা করেন। এমনকি চলচ্চিত্র জগতের অনেকেই নিরীহ তরুণ-তরুণীদের মাধ্যমে নিজেদের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে টাকা আয়ের জন্যও এই অ্যাপে এসে লাইভে যুক্ত হচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ভুক্তভোগী বলেন, আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে এখন তো অনেকেই আয় করেন। স্ট্রিমকারের অফারের বিষয়টি আমাদের অনুপ্রাণিত করে। যেহেতু বাসায় বসে থাকি সুতরাং এখানে একটু সেজেগুজে লাইভে এসে কথা বলে যদি আয় আসে তাহলে কোনো সমস্যা না দেখে আমরা শুরু করি। তাদের নির্ধারিত প্রতিদিন ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট করে লাইভে আসি।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে তারা যে টাকা দেওয়ার কথা বলছিল তা দেয় না। এভাবে একমাস, দুই মাস কিংবা তিনমাস করার পরও তারা টাকা দেয় না। এভাবে এক সময় আগ্রহ হারিয়ে ফেললে দেখা যায় তাদের জমানো টাকা আর আসে না। এই টাকা তারা হাতিয়ে নেয়।

ভুক্তভোগীরা আরো বলেন, লাইভে আসার পর তাদের টার্গেট থাকে মাসে ১০ লাখ কয়েন জমানোর। এক্ষেত্রে অনেকে ব্যর্থ হয় আবার অনেকে সফলও হয়। তবে সফল হোক আর ব্যর্থ হোক এখানে তারা যে অফার দেয় সেই অফারের প্রেক্ষিতে তারা টাকা দেয় না। ১০০ জনের মধ্যে ৫/৭ জন পায়। আর এদের শো করে আরো তরুণ-তরুণীকে টার্গেট করে।

জানা যায়, স্ট্রিমকার মূলত আমেরিকাভিত্তিক একটি ক্যাসিনো অ্যাপ। যেটি নিয়ন্ত্রিত হয় পাকিস্তান এবং ভারত থেকে। বাংলাদেশে অনুমোদন না থাকায় এই দেশে অ্যাপটি চলে ভিপিএন অ্যাপের মাধ্যমে। আর বাংলাদেশে এই ক্যাসিনো অ্যাপটির নিয়ন্ত্রক কয়েকজন তরুণ। যাদের মধ্যে অন্যতম লগ আউট, মাসুদ আর খান, দেওয়ান এজেন্সি এবং স্বপ্ন এজেন্সি অন্যতম। তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে।

ব্যাংকের অনলাইন একাউন্ট, ডেভিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড এবং অনলাইন ও মোবাইল মানি ট্রান্সফার অ্যাপের মাধ্যমে এই স্ট্রিমকার টাকা আদায় করে পরে তা পাচার করে। যা মানি লন্ডারিংয়ের মতো বড় অপরাধ। কিন্তু অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রম চলায় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেই এই অ্যাপের মাধ্যমে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবীদ ড. হোসেন মনসুর বলেন, বিভিন্ন নিষিদ্ধ অ্যাপসের মাধ্যমে টাকা পাচারের ঘটনা উদ্বেগজনক। আমরা দেখছি বিভিন্ন উপায়ে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে এই অ্যাপসও রয়েছে।

তিনি বলেন, এটি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বিটিআরসির। বিটিআরসি নজরদারি করে যেগুলোর অ্যাপসের মাধ্যমে টাকা পাচার হয়ে যায় সেগুলো নিয়ে কাজ করা।  

তিনি আরো বলেন, এটি যেহেতু নিষিদ্ধ অন্য উপায়েও পরিচালিত হয় সেহেতু এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

সিআইডির অতিরিক্ত আইজিপি ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান বলেন, অনলাইন কিংবা মোবাইল অ্যাপসকেন্দ্রিক যে কোনো অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সিআইডি, সাইবার পুলিশ এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আমরা একসঙ্গে কাজ করি। এ বিষয় আমরা নজরদারি বাড়াচ্ছি। প্রয়োজনে মন্ত্রণালয়ে আমরা বসে এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।

তিনি আরো বলেন, এই কাজটি কারা, কীভাবে করছে এটি জানার জন্য আমাদের নজরদারি করতে হবে তারপর আমরা অ্যাকশনে যেতে পারবো।

স্ট্রিমকার অ্যাপের বাংলাদেশে কোনো বৈধ অফিস না থাকায় তাদের বক্তব্যে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে তরুণ-তরুণীদের ভবিষতের কথা মাথায় রেখে এবং মানি লন্ডারিং রোধে অবলিম্বে এই অ্যাপ বন্ধের তাগিদ দেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজমের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, অনেক অ্যাপস আছে যেগুলোর মাধ্যমে টাকা ইনকাম করা যায়। আবার অনেক অ্যাপস আছে যেগুলো জুয়ায় ব্যবহূত হয়। স্ট্রিমকার তেমনি একটি অ্যাপস যাতে জুয়া খেলে। এই অ্যাপসটি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। কিন্তু ভিপিএন কানেক্টের মাধ্যমে বাংলাদেশি কিছু যুবক এটি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এই অ্যাপটি নিয়ে আমরা কাজ করছি। এই গ্রুপকে ধরতে আমরা কাজ করছি।

তিনি আরো বলেন, সর্বোপরি সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। অনলাইনে আয় করবেন না খরচ করবেন সেটি নিজের ওপরই নির্ভর করে। লোভে পড়ে কোনো কিছু করতে গেলে সেই দায়-দায়িত্ব নিজের ওপরই বর্তায়।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!