• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তরুণদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা


নিজস্ব প্রতিবেদক মে ১২, ২০২১, ১১:২০ পিএম
তরুণদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা

ঢাকা : উগ্র মতবাদে উদ্বুদ্ধ তরুণরা ফের আফগানিস্তানে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি এ ধরনের বেশ কিছু তরুণের বিষয়ে জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এতে নতুন করে তরুণদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এর আগে গত শতকের আশির দশকে যেভাবে বাংলাদেশ থেকে কিছু লোক সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে মুজাহিদ হতে আফগানিস্তানে গিয়ে জঙ্গি হয়ে ফিরেছিল, চার দশক পর ফের সেখানে যেতে তরুণদের উসকানো হচ্ছে।

পুলিশের সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, সম্প্রতি বাংলাদেশের তিন তরুণ আফগানিস্তানে হিজরত করতে বাড়ি ছেড়েছেন। তাদের মধ্যে কুমিল্লার তরুণ আব্দুর রাজ্জাক ও সিলেটের শিব্বির আহমেদ আফগানিস্তানে পৌঁছেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। রাজ্জাক সিলেটে একটি মাদরাসায় পড়াশোনার পাশাপাশি গাড়ি চালাতেন। তার সন্ধান চেয়ে ভাই সালমান খান ২৫ মার্চ সিলেটের কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন।

রবিউল নামে নোয়াখালীর এক তরুণও আফগানিস্তানে পাড়ি জমাতে বাড়ি ছেড়েছেন বলে জানালেও তার অবস্থান নিশ্চিত নয় পুলিশ। ওই দলের চারজনকে গত শনিবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারাও আফগানিস্তানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট জানায়। এই ইউনিটের উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা চারজনের কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি। সেগুলো যাচাই করা হচ্ছে।

উগ্র মতবাদে উদ্বুদ্ধ তরুণদের নতুন করে আফগানমুখী হওয়ার পেছনে সে দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টির কোনো যোগসূত্র থাকতে পারে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিআইপিএসএস)-এর ইনস্টিটিউট অব টেরোরিজম রিসার্চের প্রধান শাফকাত মুনীর। বলেন, আফগানিস্তান বর্তমানে একটি টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে সব বিদেশি সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। আফগান সরকারের অবস্থাও খুবই নাজুক। এমন পরিস্থিতি শুধু সে দেশের জন্য নয়, পুরো অঞ্চলের জন্যই অশনিসংকেত।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ঘোষণা অনুযায়ী, গত ১ মে আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়া শুরু করেছে দেশটি। টুইন টাওয়ারে হামলার বার্ষিকী অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বরের আগেই আফগানিস্তান থেকে সব সেনাকে দেশে ফিরিয়ে নেবে যুক্তরাষ্ট্র।

ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান ডিআইজি আসাদুজ্জামান বলেন, সম্প্রতি তারা একটি মেসেঞ্জার গ্রুপের সন্ধান পেয়েছেন, যেটা জঙ্গিবাদী মতাদর্শ প্রচার ও কর্মকাণ্ড পরিচালনার একটি নেটওয়ার্ক। সায়েন্স প্রোজেক্ট নামের ওই চ্যাট গ্রুপে ১০ তরুণ যুক্ত ছিলেন। এদের মধ্যে দুজন আফগানিস্তান গেছেন, আরেকজনের বিষয়টি নিশ্চিত নয়। ওই তরুণরা পাসপোর্ট ব্যবহার করে দেশ ছেড়েছেন এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। যে চার তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারাও ওই মেসেঞ্জার গ্রুপে যুক্ত ছিলেন।

গ্রেপ্তার চারজন হলেন-রাজধানীর অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ’র ছাত্র জসিমুল ইসলাম জ্যাক (২৫), হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ থানার মারকাজুস সুন্নাহ আল ইসলামিয়া মাদরাসার শিক্ষক আব্দুল মুকিত (২৯), সিলেটের আল হিদায়া ইসলামিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র আমিনুল হক (২০) এবং সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের অনার্সের শিক্ষার্থী সজীব ইখতিয়ার (২০)।

জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছেন, তাদের সহযোগীরা আফগানিস্তানে গেছেন চট্টগ্রাম হয়ে। আর সিলেট থেকে আব্দুল্লাহ নামের এক ব্যক্তি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সবার পাসপোর্ট প্রস্তুত করতে বলেছেন। তবে এই আব্দুল্লাহ কে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারেননি তদন্তকারীরা। গ্রেপ্তার সজীব ইখতিয়ার জানিয়েছেন, তার বন্ধু রাজ্জাক ঈদের আগেই তাকে আফগানিস্তানে নেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করছিলেন। সিলেটের আব্দুল্লাহও তাকে চাপ দিচ্ছিলেন।

সায়েন্স প্রোজেক্ট গ্রুপটি গত বছরের আগস্টে তৈরি করা হলেও গ্রেপ্তার চারজনের মধ্যে পরিচয় দুই বছরের বেশি সময় ধরে। গত দুই মাসের মধ্যে তাদের আফগানযাত্রার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তারা বাংলাদেশে নাশকতা ঘটিয়ে আফগানিস্তানে হিজরত করার পরিকল্পনায় ছিলেন বলে জানান ডিআইজি আসাদুজ্জামান। বলেন, আনসার আল ইসলাম উপমহাদেশের আল-কায়েদার শাখা বলে নিজেদের দাবি করে। সেই সূত্র ধরেই তারা হয়তো আফগানিস্তানে গিয়েছে। তবে এটা তাদের ভাষ্য। এ বিষয়ে আমরা এখনো নিশ্চিত নই।

প্রসঙ্গত, আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিলেন বেশ কিছু তরুণ-যুবা, যাদের একটি বড় অংশ উগ্রপন্থি ধারার কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক। সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও সেই আফগান ফেরদেরর হাত ধরেই নব্বই দশকের শুরুতে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের গোড়াপত্তন হয়।

আন্তঃদেশীয় সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ সুইডিশ সাংবাদিক ও লেখক বার্টিল লিন্টনার ২০০২ সালের ৪ এপ্রিল ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউয়ে (পত্রিকাটির প্রকাশনা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে) ‘বাংলাদেশ : এ কোকুন অব টেরর’ নিবন্ধে লেখেন, পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠনের শাখা হিসেবে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পায় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী (হুজি)। তালিবান নেতা ওসামা বিন লাদেন এদেশে হুজি প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিলেন।

হুজির প্রতিষ্ঠা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রিয়াজ লিখেছেন, এ দেশে জঙ্গিবাদের উৎসমুখ বলে যাকে চিহ্নিত করা যায়, সেই হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী (হুজি) কার্যত ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। আফগান মুজাহিদদের কাবুল বিজয়ে উল্লসিত বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবীদের একাংশ সংবাদ সম্মেলন করেছিল সেদিন। হুজি সংগঠিত হচ্ছিল আরো কয়েক বছর আগে থেকে।

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, হুজিই বাংলাদেশে প্রথম জঙ্গি কর্মকাণ্ড শুরু করে। প্রতিষ্ঠার পর হুজি প্রথম বোমা হামলা চালায় যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ। ওই হামলায় ১০ জন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। ১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত হুজি দেশে ১৩টি বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে অন্তত ১০৬ জন নিহত ও সাত শতাধিক মানুষ আহত হন। সবচেয়ে ভয়াবহ হামলাটি ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনাটি। রাজধানীতে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার জনসভায় ওই হামলায় ২২ জন নিহত হন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর হুজির সব শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

শুরুর দিকের সেই সময়ে জঙ্গিদের মধ্যে আফগানিস্তান যাওয়ার একটা প্রবণতা ছিল। কারণ সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গিরা নিজেদের মহলে উচ্চ মর্যাদা পেতেন। গত এক দশকে ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উত্থানের পর শুরু হয় সিরিয়ায় যাওয়ার ধারা। বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি সিরিয়ায় গিয়ে কথিত জিহাদে অংশ নেন। তাদের কয়েকজনের মৃত্যুর খবরও রয়েছে পুলিশের কাছে। জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, হুজি ফের মাথাচাড়া দিতে চাইছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহাবুব আলম বলেন, হেফাজতে ইসলামের মানহাজি গ্রুপটির মধ্যে বেশ কয়েকজন আফগানফেরত ব্যক্তি রয়েছেন। তারা উগ্রপন্থা ধারণ করেন। তাদের ইন্ধনেই মূলত চট্টগ্রাম অঞ্চলে সম্প্রতি সহিংসতা চালায় হেফাজত। ওই আফগানফেরত যোদ্ধাদের মধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) কয়েকজন সাবেক সদস্যও রয়েছেন। এরকম বেশ কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট গত ৪ মার্চ নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হুজির তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। এরা হলেন-হুজির অপারেশন শাখার প্রধান মো. মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিন ওরফ মিঠু ওরফে হাসান, সংগঠনের শেখ সোহান শাদ ওরফে বারা আব্দুল্লাহ ও মুরাদ হোসেন কবির। এদের মধ্যে মাইনুল ঢাকায় মাদরাসা পরিচালনার নামে শিশুদের জিহাদি প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!