• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

টিকটক লাইকিতে সর্বনাশ


নিজস্ব প্রতিবেদক জুন ৩, ২০২১, ০৩:২০ পিএম
টিকটক লাইকিতে সর্বনাশ

ঢাকা : কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও। লাখ লাখ ভিউ। রাতারাতি নেট দুনিয়ার তারকা। এমন তারকা হতে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনছেন এক শ্রেণির তরুণ-তরুণী। সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশি তরুণীর পৈশাচিক নির্যাতনের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হলে টনক নড়ে প্রশাসনের। দেশব্যাপী বিপথগামী টিকটকারদের গ্রেপ্তারে শুরু হয়েছে অভিযান। ধরা পড়ার পর বেরিয়ে আসছে সব ভয়ংকর তথ্য। টিকটককে পুঁজি করে একটি চক্র গড়ে তুলেছে নারী পাচারের বিশাল সিন্ডিকেট।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, টিকটক নিয়ে অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ ভিডিও যারা বানাচ্ছে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি টিকটকের আড়ালে নারী পাচারে জড়িতদের কোনোভাবেই ছাড়া হবে না।

বিশেষ করে রাজশাহী মহানগর পুলিশের কমিশনার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, রাজশাহীতে টিকটক হূদয়ের মতো কারো জন্ম হবে না। টিকটক ভিডিও যারা বানাচ্ছে তাদের আইনের আওতায় আনার কাজ শুরু করেছি।

দেশে ফিরেছে সেই কিশোরী : টিকটক হূদয়ের ফাঁদে পড়ে ভারতে পাচার হওয়ার ৭৭ দিন পর দেশে ফিরে আসা এক কিশোরী রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মামলা করেছেন। গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে ওই কিশোরী বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর ৩। এই মামলায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

বুধবার (২ জুন) বেলা ১১টায় রাজধানীর শ্যামলীতে তেজগাঁও জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান তেজগাঁও জোনের ডিসি মো. শহিদুল্লাহ। গ্রেপ্তাররা হলো-মেহেদী হাসান, মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের। ডিসি শহিদুল্লাহ বলেন, টিকটক হূদয়ের মাধ্যমে ভারতে পাচার হওয়া এক কিশোরী তিন মাসের নির্মম নির্যাতন ও বন্দিদশা থেকে পালিয়ে দেশে ফিরে হাতিরঝিল থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করেছেন। এই মামলায় ১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ৫ জন। তারা দেশে অবস্থান করছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। বাকি ৭ জন ভারতের নাগরিক।

টিকটক গ্রুপের মাধ্যমে হাতিরঝিলের মধুবাগ ব্রিজ এলাকায় হূদয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় ওই কিশোরীর। হূদয় তাকে কখনো টিকটক স্টার বানানো, কখনো ভালো বেতনের চাকরির অফার দিয়ে প্রলুব্ধ করে।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নারায়ণগঞ্জের অ্যাডভেঞ্চার ল্যান্ড পার্কে ৭০/৮০ জনকে নিয়ে টিকটক হ্যাংআউট এবং একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের আফরিন গার্ডেন রিসোর্টে ৭০০ থেকে ৮০০ জন তরুণ-তরুণকে নিয়ে পুল পার্টির আয়োজন করে হূদয় বাবু।

তবে ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় বাউল লালন শাহ মাজারে টিকটিক হ্যাংআউটে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের অন্য সহযোগীদের সহায়তায় কৌশলে ওই কিশোরীকে ভারতে পাচার করে হূদয়। পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ার পর থেকে পালিয়ে দেশে ফেরা পর্যন্ত তার লোমহর্ষক করুণ কাহিনী কল্পনাকেও হার মানিয়েছে।

মামলার বাদী ওই কিশোরীর বরাত দিয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ভারতে পাচারের পর তাকে বেঙ্গালুরুর আনন্দপুর এলাকায় পর্যায়ক্রমে কয়েকটি বাসায় রাখা হয়। ভারতে অবস্থানের সময়ে এ চক্রের মাধ্যমে পাচার হওয়া আরো কয়েকজন বাংলাদেশি কিশোরীকে দেখেন, যাদের তিনি আগেই চিনতেন। পাচারের শিকার অনেকেই তার পূর্বপরিচিত। তাদেরও সুপার মার্কেট, সুপার শপ, বিউটি পার্লারে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয়েছে।

বেঙ্গালুরুতে পৌঁছার কয়েকদিন পরই ভিকটিমকে চেন্নাইয়ের ওইয়ো হোটেলে ১০ দিনের জন্য পাঠানো হয়। সেখানে তিনি অমানবিক শারীরিক ও বিকৃত যৌন নির্যাতনের শিকার হন। সামান্য দয়াও দেখায়নি এ চক্রের সদস্যরা। বরং কৌশলে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে কিংবা জোর করে বিবস্ত্র ভিডিও ধারণ করে পরিবারের সদস্য পরিচিতদের তা পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে জিম্মি করে রাখা হয় তাকে। ভারতে পাচারের ৭৭ দিন পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল ভিডিওর ঘটনার ভিকটিম জেসমিন মীমের সহযোগিতায় দেশে ফিরে আসেন এই কিশোরী।

গ্রেপ্তার তিনজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে, তারা একটি মানব পাচার চক্রের সক্রিয় সদস্য। এই কিশোরীসহ তারা এক হাজারের বেশি নারী পাচার করেছে।

৫০০ তরুণীকে পাচার করেছে টিকটক হূদয় ও বস রাফি : র‌্যাব জানায়, আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফি (৩০) গত আট বছরে ৫০০ নারীকে ভারতে পাচার করেছে। ওই ৫০০ নারীকে যৌন কাজ করতে বাধ্য করা হয়। মানব পাচারকারী এই চক্রের সঙ্গে প্রায় ৫০ জন জড়িত। চক্রের গ্রেপ্তার বাকি চার সদস্য হলো-বস রাফির অন্যতম নারী সহযোগী সাহিদা বেগম ম্যাডাম সাহিদা (৪৬), মো. ইসমাইল সরদার (৩৮) ও মো. আব্দুর রহমান শেখ ওরফে আরমান শেখ (২৬)।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার বস রাফির শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। আট বছর আগে থেকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে তার যাতায়াত শুরু। প্রথমে সেখানে ট্যাক্সি ড্রাইভার ও পরে হোটেলে রিসোর্ট কর্মচারী এবং কাপড়ের ব্যবসা করত।

এ ছাড়া গত দুই বছর আগে টিকটক হূদয়ের সঙ্গে বস রাফির পরিচয় হয়। এরপর টিকটক হূদয়ের মাধ্যমে অর্ধশতাধিক তরুণীকে ভারতে পাচার করে সে।

নারী পাচারচক্রের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ওই ভুক্তভোগী তরুণীর বাবা ২৭ মে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মানব পাচার আইন ও পর্নোগ্রাফি আইনে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় টিকটিক হূদয়সহ অজ্ঞাতনামা আরো চারজনকে আসামি করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে।

এর ধারাবাহিকতায় ৩১ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা ও র‌্যাব-৩-এর অভিযানে ঝিনাইদহ সদর, যশোরের অভয়নগর ও বেনাপোল থেকে আশরাফুল ইসলাম ওরফে বসসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করত তারা। পাচারের পর সেফ হাউসে তাদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে এবং জোর করে মাদক সেবন করতে বাধ্য করানো হতো। মাদক সেবনের পর তাদের জোর করে যৌন নির্যাতন করে ভিডিও ধারণ করা হতো, যাতে তাদের পরবর্তীতে ব্ল্যাকমেইল করা যায়।

গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায়, ভিকটিমদের বৈধ বা অবৈধ উভয় পথেই সীমান্ত অতিক্রম করানো হতো। তারা কয়েকটি ধাপে পাচারের কাজটি সম্পূর্ণ করত।

প্রথমত ভিকটিমদের তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সীমান্তবর্তী জেলা যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ নিয়ে আসত। এরপর ভিকটিমদের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন সেফ হাউসে নিয়ে অবস্থান করত। সেখান থেকে সুবিধাজনক সময়ে লাইনম্যানের মাধ্যমে অরক্ষিত এলাকা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করত। এরপর ভারতের এজেন্টদের কাছে হস্তান্তর করা হতো।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, সেফ হাউসগুলো থেকে তরুণীদের কাছে ১০-১৫ দিনের জন্য বিভিন্ন খদ্দেরদের সরবরাহ করা হতো। এ ক্ষেত্রে পরিবহন ও খদ্দেরের নির্ধারিত স্থানে অবস্থানের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা নেওয়া হতো। ভারতের এজেন্ট প্রত্যেক খদ্দের প্রতি তরুণীদের ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা কমিশন দিত। ক্ষেত্রবিশেষে নারীদের অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করা হতো।

দেশব্যাপী শুরু হয়েছে গ্রেপ্তার অভিযান : রাজধানীসহ সারা দেশে বিপথগামী টিকটকারদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু হয়েছে। বুধবার (২ জুন) রাজশাহীতে ৯ জনকে আটক করেছে রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

এ বিষয়ে মহানগর পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক বলেন, টিকটকাররা দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের প্রলোভন দেখিয়ে ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে ছেড়ে দিয়ে আসক্ত করছে। টিকটকারদের শক্তিশালী গ্রুপ রয়েছে যারা প্রলোভন দেখিয়ে ভিডিও বানিয়ে দেশের বাইরেও মেয়েদের পাঠানোর চেষ্টা করছে।

তিনি বলেন, আটকদের জিজ্ঞাসাবাদের জেনেছি রাজশাহীতে টিকটক ভিডিও বানানোর সঙ্গে প্রায় ৫০০ তরুণ-তরুণী জড়িত রয়েছে। টিকটক তৈরিতে যেসব তরুণীকে ব্যবহার করা হচ্ছে তারা রিকশাচালকসহ সমাজের নিম্ন শ্রেণির পরিবারের মেয়ে। যাদের বেশিরভাগই অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রী। তাদের তালিকা তৈরির চেষ্টা চলছে।

আপনাদের মাধ্যমে তাদের প্রতি আমাদের বার্তা, তোমরা এ পথ থেকে ফিরে এসো। নইলে তোমাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, রাজশাহীতে টিকটক হূদয় নামে কারো জন্ম হবে না। যারা এগুলো করছ সাবধান হয়ে যাও।

রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি আব্দুল বাতেন বলেন, রেঞ্জের ৮ জেলার পুলিশ সুপারকে এ বিষয়ে  নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।  যারা বিপথগামী তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার লুৎফুল কবির বলেন, আমরা এ ধরনের বিপথগামী আইনের আওতায় আনার জন্য কাজ করছি।

চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, যারা টিকটকে কুরুচিপূর্ণ ভিডিও বানায়, টিকটকের আড়ালে নারী পাচার করে এদের ব্যাপারে সব পুলিশ সুপারদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!