• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
কদমতলীতে তিন খুন

নেপথ্যে পরকীয়া ও সম্পত্তির লোভ


নিজস্ব প্রতিবেদক জুন ২২, ২০২১, ০৪:৩৬ পিএম
নেপথ্যে পরকীয়া ও সম্পত্তির লোভ

ঢাকা : রাজধানীর কদমতলীতে তিন খুনের নেপথ্যে পরকীয়া ও সম্পত্তির লোভ কাজ করেছে।

এছাড়া অন্য পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করায় ক্ষোভ থেকে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে পুলিশ।

খুনের দায় স্বীকার করা মেহজাবিনের দুই খালার দাবি, তার স্বামী শফিকুল নিজে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। মেহজাবিন হয়তো সহায়তা করে থাকতে পারে।

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন,  ২০১৬ সালে মেহজাবিনকে দিয়ে তার মা ‘অনৈতিক কাজ’ করিয়েছিলেন। বেশ কয়েকবার অন্য পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করা হয় তাকে। ওই ঘটনার পর থেকেই মায়ের প্রতি ক্ষোভের জন্ম হয় তার। পরে বাবা মাসুদ রানাকে বিষয়টি অবহিত করলেও তিনি কর্ণপাত করেননি। সেই ক্ষোভ থেকেই এ ধরনের হত্যার পরিকল্পনা করা হতে পারে বলে তারা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছেন।

মেহজাবিনের দুই খালার বর্ণনায় উঠে এসেছে এক সময়ের গৃহশিক্ষক আমিনুল হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু শফিকুলের সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারার বিষয়টি।

মেহজাবিনের খালা ইয়াসমিন বলেন, শফিকুলের সঙ্গে বিয়ের আগে মেহজাবিন আমিন নামে একজনের কাছে প্রাইভেট পড়ত। সে সময় মেহজাবিনের সঙ্গে প্রেমের পরে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে আমিনের। বিষয়টি জানাজানি হলে দ্রুত শফিকুলের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পর শফিকুল সন্দেহ করত, আমিনের সঙ্গে মেহজাবিনের সম্পর্ক এখনো আছে। এরপর ২০১৬ সালে আমিনকে হত্যা করা হয়।

হত্যার ঘটনায় যে মামলা হয় তাতে শফিকুল ইসলাম, তার শাশুড়ি মৌসুমী, খালাশাশুড়ি শিউলি আক্তার ও স্ত্রী মেহজাবিনকে আসামি করে মামলা হয়। সে মামলায় তারা জেলও খেটেছেন। মেহজাবিনকে পরে আদালত খালাস দেন।

ইয়াসমিন বলেন, মেহজাবিনকে বিয়ের পর শফিকুল অনেক মারপিট করত। শফিকুলের বাসা থেকে মেয়েকে নিয়ে একবার সে পালিয়েও যায়। পরে মীমাংসা করে তারা আবার সংসার শুরু করে। আমার বোনের কোনো ছেলে নেই।

এ কারণে শফিকুল ভাবত, জান্নাতুল আর মেহজাবিনকে ‘একসঙ্গে পেলে’ তাদের বাবার সব সম্পত্তি তার হাতের মুঠোয় নেওয়া যাবে।

তিনি আরো বলেন, ‘আমার আরেক ভাগনি জান্নাতুলের সঙ্গেও শফিকুল অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। শারীরিক সম্পর্কের পর শফিকুল জান্নাতুলকে বলত, ‘তুমি যদি আমার কথা না শোনো তাহলে আমাদের ভিডিওগুলো ফেসবুকে ছেড়ে দেব।’

অন্যদিকে মেহজাবিনকে বলত, ‘তুমি যদি এগুলো কাউকে বলো তাহলে তোমাকে মেরে ফেলব।’ যেহেতু শফিকুল আগে একটি ‘খুন করেছে’ এজন্য মেহজাবিন ভয় পেত। এছাড়া তাদের বাচ্চাটাকেও জিম্মি করে রাখত, হত্যার ভয় দেখাত।’

ইয়াসমিনের দাবি, ‘তিনজনকে হত্যা করেছে শফিকুল নিজেই। এরপর তাকে যাতে সন্দেহ না করা হয় সেজন্য সেও ওষুধ খেয়ে অসুস্থতার ভান করে। নিজে হত্যার পর সে (শফিকুল) মেহজাবিনকে দিয়ে ৯৯৯-এ ফোন দেওয়ায়।’

আরেক খালা শিউলি আক্তার বলেন, মেহজাবিনের সঙ্গে বিয়ের পর জান্নাতুলকে ব্ল্যাকমেইল করে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে মেহজাবিনের স্বামী শফিকুল। এরপর আমরা জানার পর জান্নাতুলকে অনেক বুঝিয়েছি। বোঝানোর পর সে অবৈধ সম্পর্কের পথ থেকে সরে আসে। বিষয়টি মেহজাবিন জেনে গেলে শফিকুল নিজের মেয়েকে মেরে ফেলার ভয় দেখাত। মেহজাবিনকে মারপিটও করত শফিকুল। একপর্যায়ে সম্পত্তি দখলের জন্য শফিকুল জান্নাতুলকে স্ত্রী হিসেবে দাবি করে। জান্নাতুলের বিয়ের কোনো প্রস্তাব এলে বিয়ে ভেঙে দিত শফিকুল।’

তিনি বলেন, ‘শফিকুল আমিন হত্যা মামলার আসামি। আমাকেও ওই মামলায় আসামি করা হয়। আমার দুলাভাই (নিহত মাসুদ রানা) বিদেশ থেকে ফেরার পর নানারকম টালবাহানা করে সম্পত্তি ও টাকাপয়সা হাতিয়ে নিতে চায় সে। আমিন হত্যা মামলা শেষ করার জন্য ২০ লাখ টাকা চায় শফিকুল। কিন্তু আমার বোন তাকে টাকা দিতে রাজি হয় না।

এজন্য পরিকল্পনা করে মেহজাবিন ও শফিকুল মিলে চা ও পানির সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে তাদের হত্যা করে। এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। শফিকুলকে রিমান্ডে নিলে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে।

যেভাবে তাদের হাত শক্ত করে বাঁধা ছিল, সেটা মেহজাবিনের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের বাসায় সিসিটিভি আছে সেগুলো চেক করলে ঘটনা জানা যাবে। এই হত্যাকাণ্ডে মেহজাবিনের যদি ৫০ ভাগ দোষ থাকে তাহলে শফিকুলের দোষ ১০০ ভাগ।

গত শনিবার সকালে রাজধানীল কদমতলীর মুরাদপুরে পাঁচতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলা থেকে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতরা হলেন-মাসুদ রানা (৫০), তার স্ত্রী মৌসুমী আক্তার (৪৫) এবং তাদের ছোট মেয়ে জান্নাতুল (২০)। সেখান থেকে অচেতন অবস্থায় মেহজাবিন ইসলাম মুনের স্বামী শফিকুল ইসলাম ও মেয়ে তৃপ্তিকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঘটনার পরপরই আটক করা হয় মেহজাবিনকে।

এ ঘটনায় নিহত মাসুদ রানার বড় ভাই সাখাওয়াত হোসেন বাদী হয়ে মামলা করেন। ওই মামলায় মেহজাবিন ইসলাম মুনের গত রোববার চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। একই দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্বামী শফিকুলকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কদমতলী থানার পরিদর্শক (অপারেশন্স) জাকির হোসেন বলেন, ‘নিহত মাসুদ রানার বড় ভাই বাদী হয়ে মামলা করেছেন। সে মামলায় শফিকুলকে এক নম্বর ও মেহজাবিনকে দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে।’

কদমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জামাল উদ্দিন মীর বলেন, গ্রেপ্তার মেহজাবিন ইসলাম মুনের স্বামী শফিকুলকে হাসপাতাল থেকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, অনৈতিক সম্পর্কের জেরে ঘটে যাওয়া এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে আরো কোনো কারণ লুকিয়ে আছে কি না এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় আর কারো জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে পুলিশ। পরিবারের অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ ও বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করে মামলাটির তদন্ত চলছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!