• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভিকারুননিসায় অনিয়ম দুর্নীতিতে গভর্নিংবডি!


নিজস্ব প্রতিবেদক আগস্ট ১, ২০২১, ০৩:২৩ পিএম
ভিকারুননিসায় অনিয়ম দুর্নীতিতে গভর্নিংবডি!

ঢাকা : রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের যত অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, তার বেশিরভাগই হয়েছে গভর্নিংবডির মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটির ৫০ কোটি টাকা তছরুপ, কলেজের জমি অবৈধভাবে হস্তান্তর ও অবৈধ নিয়োগসহ বিভিন্ন অভিযোগের প্রমাণ মিললেও গত দুই দশকে গভর্নিংবডির কোনো সদস্য বা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ বছরে স্কুলটির গভর্নিংবডির বিরুদ্ধে বেশিরভাগ অভিযোগের প্রমাণ পায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে ২০১৯ সালে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের স্বাক্ষর না নিয়ে গভর্নিংবডি অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করালে ওই ঘটনায় ব্যবস্থা নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রতিষ্ঠার পর রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিচালিত হতো বিশেষ কমিটির মাধ্যমে। ১৯৯৪ সালের পর নির্বাচিত গভর্নিংবডির মাধ্যমে পরিচালনা শুরু হয়। এরপর থেকেই প্রতিষ্ঠানটিতে ভর করে অনিয়ম-দুর্নীতি। ২০০১ শিক্ষাবর্ষে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগের প্রমাণ মেলে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে।

২০০২ সালের এপ্রিলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই সময়ের সিনিয়র সহকারী সচিব আখতারী বেগম স্বাক্ষরিত চিঠিতে তৎকালীন সাবেক অধ্যক্ষের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হয় গভর্নিংবডির সভাপতি সংসদ সদস্য মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুল মান্নানের কাছে। এরপর থেকে নির্বাচিত কমিটিগুলোর বেশিরভাগের বিরুদ্ধে ভর্তিবাণিজ্য ও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।

২০২০ সালে আবারো অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি নিয়ে আদালতে যেতে হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। এ বছরও এ নিয়ে দেখা দেয় অস্থিরতা। জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ অধ্যাপক কামরুন নাহার বলেন, যোগদান করেছি সাত মাস হলো। এর মাঝে ভর্তিবাণিজ্য বন্ধ করায় আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। গভর্নিংবডির সদস্য এবং অভিভাবকদের একটি অংশ ভর্তিবাণিজ্য ও উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন কাজে প্রভাব বিস্তার করছে।

জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সদস্য মনিরুজ্জামান খোকন বলেন, কতকগুলো জঞ্জাল পরিষ্কার করলাম, আর কত করব? অন্য কমিটির কথা বলব না। কারো কথা বলতে গিয়ে বিরাগভাজন হব না।

পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০১ সালে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত সিদ্ধেশ্বরী শাখায় ২২৭জন, ধানমন্ডি শাখায় ১০০ জন শিক্ষার্থী অতিরিক্ত ভর্তি করানো হয়।

১৯৯৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্থায়ী আমানত ভাঙানো বাবদ ওই বছরের ২৫ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৪ কোটি ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা ভিকারুননিসা বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে স্থানান্তর করা হয়। পরে আরো কয়েক দফায় মোট ৬ কোটি ১২ লাখ ৬৭ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয় শিক্ষা বোর্ডের অনুমতি না নিয়ে।

এছাড়া ১০ বিঘা জমি মাত্র ১৬ লাখ টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে দেওয়া হয় অবৈধভাবে।  এসব ঘটনায় পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনা থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ওই সময়ের গভর্নিং বডি। তৎকালীন অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগেরও প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

২০০৭ সালের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৫০ কোটি টাকা দুর্নীতির তথ্য উঠে আসে। ওই প্রতিবেদনে দরপত্র আহ্বান ও গ্রহণে অনিয়ম, খোলা দরপত্র আহ্বান না করা, যথাযথভাবে কোটেশন না করা, আয়কর ও ভ্যাট কর্তন না করা, কর্তন করা আয়কর ও ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা না দেওয়া, ব্যয়ের সমর্থনে ভাউচার উপস্থাপন না করা, ব্যয়ে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন না থাকা, ক্রয় করা আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি ও অন্য মালামালের মজুত ও বণ্টন রেজিস্টার না থাকার অভিযোগ তুলে ধরা হয়।  ওই সময় এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ফরম পূরণেও অতিরিক্ত ফি আদায় করা হয়। ফরম পূরণে নগদ আদায় করা হয় ৮১ লাখ টাকা।  প্রতিবেদনে দুজন অধ্যক্ষসহ ৪৫ জন শিক্ষক নিয়োগে সরকারি বিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

অফিস সহকারী কাম হিসাবরক্ষক পদে (তৃতীয় শ্রেণি) এক কর্মচারীকে নিয়োগ এবং এমপিওভুক্ত কর্মচারীকে প্রধান হিসাবরক্ষক পদবী ব্যবহার ও মাসিক ৫৩ হাজার ৫১২ টাকা বেতন দেওয়া হয় অবৈধভাবে। শিক্ষক-কর্মচারীদের অনুমতি ছাড়াই পিএফ ফান্ড থেকে ২ কোটি ২৪ লাখ ৩৩ হাজার টাকার এফডিআর স্থানান্তর করা হয়।

ছাত্রীদের কাছ থেকে আদায়যোগ্য ২৩ কোটি ২৩ লাখ ৪৩ হাজার জমার বিপরীতেও কোনো কাগজ দেখাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

প্রতিবেদনে ফ্যান বিক্রি থেকে শুরু করে ম্যাগজিন ছাপাতেও দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়। আইএসডি ফোন ব্যবহার করে অর্থ তছরুপ করার কথাও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগ প্রসঙ্গে ওই সময়কার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছিলেন, ‘প্রথম শেণিতে একজন শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে ১০ লাখ টাকা লাগে ভিকারুননিসায়। সে কারণে আমরা প্রথম শ্রেণির ভর্তিতে লটারি সিস্টেম চালু করেছি। ভিকারুননিসার ছাত্রী অরিত্রির আত্মত্যার ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের দিন ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর এ তথ্য জানিয়েছিলেন নুরুল ইসলাম নাহিদ।

এরপরও ২০১৮ সালে প্রায় এক হাজার ২০০ শিক্ষার্থী অতিরিক্ত ভর্তি করা হয়।  ২০১৯ সালে অধ্যক্ষর স্বাক্ষর না নিয়ে গভর্নিংবডি৪৪৩ জন শিক্ষার্থী অতিরিক্ত ভর্তি করায়। এই অভিযোগে একজন সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় মন্ত্রণালয়। তবে কমিটির কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

২০১৯ সালে সালে অবৈধভাবে স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগের চেষ্টা করা হলে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ওই অভিযোগের পর অধ্যক্ষ নিয়োগে স্থগিতাদেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!