• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অভিযানে বাড়ে বৈধ কল


নিজস্ব প্রতিবেদক সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২১, ০৩:৩৮ পিএম
অভিযানে বাড়ে বৈধ কল

ঢাকা : অবৈধ ভিওআইপির বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এরই অংশ হিসেবে গত ১৫ সেপ্টেম্বর অভিযান চালানো হয় লালমাটিয়ায়। এসময় ভিওআইপি সরঞ্জামসহ গ্রেপ্তার করা হয় একজনকে।

বিটিআরসির সূত্র জানায়, জব্দ করা এসব সরঞ্জামের মূল্য প্রায় ৩০ লাখ টাকা। এক সৌদি প্রবাসীসহ ৪ জনের সিন্ডিকেট প্রায় দেড় বছর ধরে এই অবৈধ ব্যবসা করে আসছিল। বিটিআরসির এনফোর্সমেন্ট টিম একটি আবাসিক ভবন থেকে ৫১২টি পোর্টের ৩টি ও ২৫৬ পোর্টের ২টি সিমবক্স, ৭টি ল্যাপটপ, ৫টি মডেম, একটি সুইচ ও ৯০০টি টেলিটক সিম জব্দ করা করেছে। দীর্ঘদিন পর ভিওআইপির বিরুদ্ধে অভিযানে এটি একটি বড় সফলতা। এই ঘটনার ৮ দিন পর গতকাল বৃহস্পতিবার আরো বড় অভিযান চালানো হয় ফকিরারপুলে। এসময় ৪ জনকে গ্রেপ্তার ও উদ্ধার করা প্রায় অর্ধকোটি টাকার মালামাল।

সূত্র জানায়, করোনার কারণে অভিযান কমে যাওয়ায় তৎপর হয়ে উঠেছিল চোরাকারবারিচক্র। ফলে বছরের বেশির ভাগ সময়ই বৈধ পথে আন্তর্জাতিক কলের পরিমাণ কম থাকে। এতে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় সরকার। তবে নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হলে তখনই বেড়ে যায় বৈধ পথে আসা আন্তর্জাতিক কলের সংখ্যা। গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে এক অভিযানের পরদিন অন্তত ৮০ লাখ মিনিট কল বেড়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।

জানা যায়, ভিওআইপির অবৈধ কারবার বন্ধ হলে এই খাত থেকে বছরে অন্তত ২১৮ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হতে পারে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিও এ বাস্তবতা স্বীকার করে নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে চাচ্ছে।

সংস্থাটির সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা বলছেন, নিয়মিত ও দক্ষ পর্যবেক্ষণ ছাড়া এই চোরাকারবার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই চুরিচামারি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। টেলিযোগাযোগ খাতে কোনো অন্যায় করতে দেব না এই নিশ্চয়তা দিচ্ছি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতি এ ক্ষেত্রেও কঠোরভাবে অনুসরণ করা হবে।’

বিটিআরসির অবস্থান : গত ২৭ জুলাই বিটিআরসির ২৫৩তম সভায় সংস্থাটির ইঅ্যান্ডআই বিভাগের মহাপরিচালক ভিওআইপির অবৈধ কারবার রোধে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে একটি কার্যপত্র উপস্থাপন করেন। এই নথিতেও সংকটের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

কার্যপত্রে বলা হয়, ভিওআইপি প্রযুক্তির অবৈধ ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন অননুমোদিত টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আন্তর্জাতিক গেটওয়ে বাইপাস করে একটি অসাধুচক্র আন্তর্জাতিক কল আনার ব্যবসা চালাচ্ছে। মোবাইল অপারেটরদের সিম ও পিএসটিএন (ল্যান্ডফোন) অপারেটরদের সার্কিটের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে তারা এই অপরাধমূলক কাজ করে যাচ্ছে। বিটিআরসি ভিওআইপির অবৈধ কার্যক্রম বন্ধে সরেজমিনে পরিদর্শনসহ বিভিন্ন মনিটরিং ব্যবস্থা গ্রহণ করে আসছিল।

২০১০ সালে অবৈধ স্থাপনায় ব্যবহূত নম্বরগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করার লক্ষ্যে বিটিআরসির প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনায় মোবাইল অপারেটরদের আর্থিক সহায়তায় আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সিমবক্স ডিটেকশন সিস্টেম ব্যবহার শুরু করে। পরে থ্রিজি লাইসেন্সিং গাইডলাইনে অবৈধ প্রক্রিয়ায় সিম নিবন্ধন নিরুৎসাহ করাসহ ভিওআইপি কল শনাক্ত করার লক্ষ্যে যথাযথ পদ্ধতি রাখার বাধ্যবাধকতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যার ধারাবাহিকতায় মোবাইল অপারেটররা সম্মিলিতভাবে সিমবক্স ডিটেকশন সিস্টেম স্থাপনের কার্যক্রম চলমান রেখে আসছিল।

কার্যপত্রে আরো বলা হয়, মোবাইল অপারেটররা রিভ সিস্টেম লিমিটেডের সঙ্গে ‘সিমবক্স ডিটেকশন সার্ভিস’ সিস্টেমের চুক্তি করে ২০১৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি। এর মেয়াদ ছিল গত ৩১ মে পর্যন্ত। এককালীন ২১ হাজার ৪৩৯ ইউএস ডলার এবং প্রতি মাসে সার্ভিস চার্জ ৯ হাজার ১৪৮ ইউএস ডলার নিয়ে রিভ সিস্টেম লিমিটেড এ সেবা চালু রাখে।

এতে প্রতি মাসে টেস্ট কলের পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৫০ হাজার, কিন্তু গত ২৩ মে মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন এমটব ই-মেইলে বিটিআরসিকে জানায়, সিমবক্স ডিটেকশন সিস্টেম (এসবিডি) পরিচালনাকারী ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান রিভ সিস্টেম চিঠিতে জানিয়েছে যে ২০২১ সালের ৩১ মের পর তারা আর সেবা দেবে না। গত ৩১ মে থেকে ওই সেবা বন্ধ হয়ে যায়।

এতে আরো বলা হয়, ‘সিমবক্স ডিটেকশন সিস্টেমটি প্রথম দিকে কার্যকর হলেও গত এক বছর ভেন্ডরের দক্ষতা ও সিস্টেমের কারিগরি সক্ষমতায় ত্রুটি দেখা যায়। এ অবস্থায় বিটিআরসির তথা সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে আধুনিক প্রযুক্তির বিশেষায়িত ডিটেকশন সিস্টেম স্থাপনের লক্ষ্যে দ্রুত পরিকেল্পনা প্রণয়ন জরুরি।’

আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বিশেষায়িত ডিটেকশন ও মনিটরিং সিস্টেম থাকলে সরকারের রাজস্ব বিপুল পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে উল্লেখ করে এতে বলা হয়, এর ফলে বিটিআরসির নিজস্ব কারিগরি সক্ষমতাও বাড়বে।

কার্যপত্রে বলা হয়, ‘থ্রিজি লাইসেন্সিং গাইডলাইন অনুসারে অবৈধ কল টার্মিনেশন চিহ্নিত করা, এর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া, ভুল তথ্যে সিম নিবন্ধন এসবের  জন্য প্রয়োজনীয় সিস্টেম স্থাপন করা মোবাইল অপারেটরদের জন্য বাধ্যতামূলক। এ বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুযোগ না থাকায় বিটিআরসি মোবাইল অপারেটরদের নতুন ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর  মনিটরিং এবং ডিটেকশন সিস্টেম স্থাপনে নতুন কোনো ভেন্ডরের সঙ্গে চুক্তি করে সার্ভিস চালুর জন্য একাধিকবার চিঠি দেয়, কিন্তু মোবাইল অপারেটররা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।’

২৪ দিনে সাড়ে সাত হাজার সিম বন্ধ : বিটিআরসি নির্দেশিত মোবাইল অপারেটরদের দুই স্তরের নিজস্ব  নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা এসআর (সেলফ রেগুলেশন) এবং এসআরপিতেও (সেলফ রেগুলেশন প্রসেস) ভিওআইপির অবৈধ কারবারের যুক্ত থাকতে পারে এমন সন্দেহের সিম প্রতিদিন শনাক্ত হচ্ছে।

বিটিআরসিকে দেওয়া মোবাইল অপারেটরদের তথ্য অনুসারে, গত ১ আগস্ট থেকে গত ২৪ আগস্ট পর্যন্ত চার অপারেটরের এ ধরনের সিম শনাক্ত হয়েছে মোট সাত হাজার ৫৩৮টি। এর মধ্যে টেলিটকেরই দুই হাজার ৩৮৮টি।

অন্য অপারেটরদের মধ্যে গ্রামীণফোনের ৬৯২টি, রবি/এয়ারটেলের দুই হাজার ৭৪৪টি এবং বাংলালিংকের এক হাজার ৭১৪টি। কোনো গ্রাহকের সিমে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি কল, কিংবা শুধু বহির্গামী কল, একই অবস্থান থেকে কল, স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণ এসএমএস করা এবং আরো কিছু অস্বাভাবিক আচরণের তথ্য পেলে অপারেটররা নিজ উদ্যোগে ওই সিম বন্ধ করে দেয়।

দেশে আন্তর্জাতিক কল আদান-প্রদানের লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বেসরকারি ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডাব্লিউ) অপারেটরদের ফোরাম আইওএফের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা মুশফিক মঞ্জুর জানান, বর্তমানে দেশে বৈধ ও অবৈধ পথে আসা আন্তর্জাতিক কলের বাজার রয়েছে দৈনিক প্রায় পাঁচ কোটি থেকে ছয় কোটি মিনিট।

এই হিসাবের মধ্যে ওটিটি (ওভার দ্য টপ) কল অন্তর্ভুক্ত নয়। বর্তমানে বৈধ পথে সরকারি ও বেসরকারি আইজিডাব্লিউ হয়ে দৈনিক প্রায় এক কোটি ৯০ লাখ মিনিট থেকে দুই কোটি মিনিট কল আসছে।

দেশে বৈধ পথে ঈদ উৎসবের দিনগুলো ছাড়াও সাধারণ দিনগুলোতে দিনে ১১ কোটি মিনিট আন্তর্জাতিক কল আসারও রেকর্ড রয়েছে, কিন্তু এখন তা আসছে না কেন এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ভিওআইপির  অবৈধ কারবার এ জন্য প্রথমত ও প্রধানত দায়ী।

এর ফলে সরকার ও আইজিডাব্লিউগুলো তথা দুই পক্ষরই প্রচুর লোকসান হচ্ছে জানিয়ে বলা হয়, দৈনিক অবৈধ পথে আসা তিন কোটি মিনিট কল থেকে বিদ্যমান রেটে সরকারের রাজস্ব হারানোর পরিমাণ বছরে ২১৮ কোটি টাকা এবং দেশের সব আইজিডাব্লিউর হারানো আয়ের পরিমাণ বছরে ১০৯ কোটি টাকা।

এই বাস্তবতায় আইজিডাব্লিউ অপারেটরদের ব্যাংকঋণ, প্রশাসনিক ব্যয়, স্টেকহোল্ডারদের অর্থ পরিশোধ ও নিজেদের অর্থ পরিশোধের পর নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক আইজিডাব্লিউ ক্ষতি লাঘব করতে জনবল ছাঁটাই করতে বাধ্য হচ্ছে বলেও জানানো হয়।

ভিওআইপির অবৈধ কারবারিদের বিরুদ্ধে বিটিআরসির পদক্ষেপ যথেষ্ট কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিটিআরসি ও আইন-শৃঙ্খলারক্ষাবাহিনীর অভিযানের জন্য আইওএফ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ, কিন্ত শুধু এই অভিযান চলাকালে ভিওআইপি কার্যক্রমে সাময়িক ভাটা পড়ে; কিছু কল অবৈধ পথ থেকে বৈধ পথে পরিচালিত হয় এবং বৈধ পথে আসা কলের পরিমাণ সাময়িক বৃদ্ধি হয়।

দাহরণ দিয়ে আইওএফ বলে, গত ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে বিটিআরসি ও র‌্যাবের যৌথ অভিযানে বিপুল পরিমাণে অবৈধ ভিওআইপি সরঞ্জাম ধরা পড়ার পর  ওই মাসে বৈধ পথে দৈনিক ৮০ লাখ মিনিট কল বেড়ে যায়।

ফলে রাজস্ব আয়ের পরিমাণও দৈনিক ৪২ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৫৮ লাখ টাকায় উন্নীত হয়, কিন্তু মার্চে আবারো কল কমতে থাকে। আগস্ট মাসে কলের পরিমাণ দাঁড়ায় দৈনিক এক কোটি ৯০ লাখে।

এদিকে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন,  র‌্যাব বিপুল পরিমাণ ভিওআইপি কারবারিদের গ্রেপ্তার করেছে। এক্ষেত্রে বিটিআরসি সহায়তা করে থাকে। বিটিআরসি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমরা অভিযান পরিচালনা করে থাকি। তিনি বলেন, আমাদের ধারাবাহিক অভিযান শুরু হয়েছে। এটি অব্যাহত থাকবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!