• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফেসবুকে সক্রিয় গুজবচক্র, কঠোর সরকার


নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ২৪, ২০২২, ০২:০২ পিএম
ফেসবুকে সক্রিয় গুজবচক্র, কঠোর সরকার

ঢাকা : সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সক্রিয় গুজবচক্র। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা এই চক্রের টার্গেট। ফেসবুকে এসব ব্যক্তিদের নামে নানা ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা করছে তারা। এই গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। তাদের গ্রেপ্তারে মাঠে নেমেছে র‌্যাব-পুলিশ।    

যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট থেকে র‌্যাব-পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর গুজব রটনাকারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবে রাষ্ট্রবিরোধী নানা ধরনের গুজব ছড়ানো শুরু হয়।

অতি সম্প্রতি কয়েকটি মানাবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে র‌্যাবকে শান্তিমিশনে না রাখতে চিঠি দেওয়ার পর গুজব আরো তীব্র আকার ধারণ করে।

এমন পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মনিটরিং ব্যবস্থা আরো জোরদার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

বিশেষ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট, র‌্যাবের সাইবার ক্রাইম ইউনিট, সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইউনিটসহ বেশ কয়েকটি সংস্থা গুজব প্রতিরোধে কাজ করছে। পাশাপাশি গুজব সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় আনতে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। দেশের বাইরে থেকে যারা গুজব ছড়াবে তাদের বিষয়ে সেসব দেশের কর্তৃপক্ষকেও এ ব্যাপারে অবহিত করা হবে।  

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের বাইরে থেকে একশ্রেণির লোক এসব কাজে লিপ্ত। বিভিন্ন পেজে গুজব সৃষ্টিকারী কথাবার্তা বলে সেগুলো বুস্ট করে। দেশের বাইরে থাকায় তাদের আইনের আওতায় আনাও যাচ্ছে না।

সম্প্রতি দেশের বাইরে থাকা ব্যক্তিদের পাসপোর্ট বাতিলের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। পাসপোর্ট বাতিলের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত আসলে দেশের বাইরে থেকে গুজব কিছুটা হলেও কমে আসবে। পাশাপাশি ওই ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও অবহিত করার বিষয়েও একটি সিদ্ধান্ত আসছে।

ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের ডিআইজি আসাদুজ্জামান বলেন, আমাদের মনিটরিং চলমান রয়েছে। জঙ্গি কার্যক্রম থেকে শুরু করে গুজব ছড়ানো, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার আমরা মনিটরিং করে থাকি। বর্তমানে এটি আরো জোরদার করা হয়েছে।

সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় ফেসবুক মনিটরিংয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ ব্যাপারে আরো সজাগ থাকার নির্দেশনা দিয়ে সরকারবিরোধী প্রচারণা চালানো ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেলকে আরো নজরদারির পাশাপাশি তাদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সভায় বলা হয়, কিছু ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল সরকারবিরোধী প্রচারণা, গুজব, এমনকি জঙ্গি কার্যক্রমের বিভিন্ন কন্টেন্ট ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। দেশ ও দেশের বাইরে থেকে এ ধরনের কার্যক্রম চলছে বলে জানানো হয়। সামনে এ ধরনের কার্যক্রম আরো বাড়বে আশঙ্কা করে এখন থেকে কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনার  নির্দেশনা দেওয়া হয়।

কাউন্টার টেরোরিজম সূত্র জানায়, অনলাইনে মনিটরিংয়ের ফলেই জঙ্গিরা সুবিধা করতে পারছে না।

সর্বশেষ আনসার আল ইসলামের অনলাইন দাওয়াতি শাখার প্রধানকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারের মধ্যে দিয়ে অনলাইনে যে তাদের প্রচারণা তার ৮০ শতাংশই বন্ধ হয়ে গেছে।

সূত্র জানায়, জঙ্গিদের পাশাপাশি যারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও গুজব চালায় তাদের বিরুদ্ধেও মনিটরিং ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে অপপ্রচার চালানো প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার আইডি চিহ্নিত করা হয়েছে।

এছাড়াও কিছু পেজ চিহ্নিত করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই পেজগুলো থেকে সরকারবিরোধী নানা অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এই পেজগুলোকে ডিঅ্যাকটিভ করে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

জানা গেছে, বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি অনলাইন মনিটরিং করে র‌্যাব, সিআইডি ও পুলিশ সদরদপ্তরের সাইবার ক্রাইম ইউনিট। আগামী সময়ে অনলাইনকেন্দ্রিক গুজব বাড়ার আশঙ্কাতে সব সংস্থাই তারা তাদের মনিটরিং কার্যক্রম আরো গতিশীল করেছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, ফেসবুকে গুজব অপপ্রচার রোধে র্যাব সদরদপ্তর কঠোরভাবে মনিটরিং করে। দুর্গাপুজার সময় সাম্প্রদায়িক বিভিন্ন ঘটনায় যারা ফেসবুকে অপপ্রচার ও গুজব এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে কন্টেন্ট ছাড়িয়েছে এ রকম প্রায় অর্ধশত গ্রেপ্তারের আওতায় আনা হয়েছে।

তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশের পর এর পরিধি আরো বাড়ানো হয়েছে।

সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, আমাদের পক্ষ থেকেও মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। ফেসবুক ও ইউটিউবকেন্দ্রিক অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে আরো জোরালো কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

গুজবের শিকার হওয়া ডিএমপির গুলশান বিভাগের ক্যান্টনমেন্ট জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) ইফতেখায়েরুল ইসলাম বলেন, আমার সম্পর্কে যে গুজব ছড়ানো হয়েছে তাতে করে ওই আইডিগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করব।

তিনি বলেন, যেহেতু দেশের বাইরে থাকা ব্যক্তিরা এ ধরনের গুজবের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে এ দেশে মামলা হলে কখনো যদি তারা দেশে আসে তবে গ্রেপ্তার হবেন। পাশাপাশি তারা যে দেশে বসবাস করে সে দেশেরও একটি ভূমিকা রয়েছে। সর্বোপরি গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের বরাবরই কঠোর অবস্থান।

সূত্র মতে, বর্তমানে দেশের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুককে বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে একটি চক্র। বিশেষ করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে জনগণের মাঝে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করছে।

গেল দুর্গাপূজায় পবিত্র কোরআন অবমাননার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের অধিকাংশই জেলায় হামলা ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কয়েকটি স্থানে গুলিও চালায়। এতে করে ১০ জনের মতো নিহত হয়।

এছাড়াও নোয়াখালী ও রংপুরে কয়েকজন হিন্দুধর্মালম্বী নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ফেসবুক ও ইউটিউবে নানা ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে দাঙ্গা উেক দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

তার আগে মার্চে স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে ঘিরে ফেসবুক ও ইউটিউবে নানা গুজব ও অপপ্রচার চালানো হয়। এতে করে পুলিশের সঙ্গে হেফাজত কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় হতাহত হয়।

এছাড়াও ফেসবুক ও ইউটিউবে গুজব ছড়িয়ে নানা সময়ে দেশে নানা ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মসজিদের মাইকে ডাকাত ঘোষণা দিয়ে ২৫ এপ্রিল নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে তুচ্ছ ঘটনার জেরে সুমন নামের এক তরুণকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়।

লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের সামনে ঘটে যাওয়া জুয়েল হত্যাকাণ্ড।

ধর্ম অবমাননার গুজব রটিয়ে আবু ইউনুছ মো. গাহিদুন্নবী জুয়েল নামের ওই ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার পর তার লাশও পুড়িয়ে ফেলার মতো বীভৎস বর্বরতার ঘটনায় হতবাক দেশবাসী।

পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা ও রক্ত লাগবে, এমন গুজবে ছেলে ধরা সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয় ১৭ জনকে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, গত ১০ বছরে বিভিন্ন মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনির নামে হত্যা করা হয়েছে ৮৯৫ জনকে।

আসকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২০ সালে মাসে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা ৩০। এর মধ্যে খুলনায় ১০ জন, ঢাকায় ৯ জন, রাজশাহীতে তিন, রংপুরে এক, চট্টগ্রামে পাঁচ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুজন নিহত হয়েছে।

২০১৯ সালে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে হত্যার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫। এর মধ্যে চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ ২৫ জন এবং ঢাকায় ২৪ জনকে। ২০১৮ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিল ৩৯ জন। এর মধ্যে ঢাকাতেই নিহত হয় সর্বোচ্চ ২১ জন। এর আগে ২০১৭ সালে ৫০ জন, ২০১৬ সালে ৫১ জন, ২০১৫ সালে ১৩৫ জন এবং ২০১৪ সালে ১১৬ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ফেসবুক ও ইউটিউবে অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানো ব্যক্তিরা এখনো বসে নেই। তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। গুজব ও অপপ্রচারের কারণে দেশে আবারো কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারে সজাগ থাকার নির্দেশনা এসেছে।

পাশাপাশি এ ধরনের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলকে কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে। নজরদারি ও গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও কর্মকর্তারা জানান।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!