• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাতের হাতিরঝিল অপরাধীর আস্তানা


নিউজ ডেস্ক জুন ১০, ২০২২, ১২:৩২ পিএম
রাতের হাতিরঝিল অপরাধীর আস্তানা

ঢাকা : রাত হলেই রাজধানীর অন্যতম বিনোদনের স্পট হাতিরঝিল এলাকা অপরাধীদের দখলে যাচ্ছে। বিশেষকরে ছিনতাইকারীরা বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে।

স্থানীয়রা বলছেন, রাতের হাতিরঝিল দিনদিন বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। তবে পুলিশ বলছে, রাতে পুলিশের টহল আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে।

এদিকে, হাতিরঝিল থেকে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসি নিউজের প্রডিউসার আবদুল বারীর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়েছে। গুলশান থানায় অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন নিহতের বড় ভাই আবদুল আলিম। মামলাটির তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

এর আগেও চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি মধ্যরাতে সময়ের আলোর সিনিয়র রিপোর্টার হাবিব রহমানের আপাত দৃষ্টিতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু বলা হলেও সেটি নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

জানা যায়, গত মঙ্গলবার রাত ৮টা ৪৯ মিনিটে মহাখালীর ভাড়া বাসা থেকে বের হন বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসি নিউজের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার আব্দুল বারী। এরপর আর বাসায় ফেরেননি তিনি। গুলশান থানাধীন হাতিরঝিল লেকপাড়ে পড়েছিল তার নিথর রক্তাক্ত মরদেহ।

পুলিশ জানায়, গত বুধবার সকালে ছিন্নমূল কয়েকজন শিশু নিকেতনের পাশে লেকপাড়ে একজনের মরদেহ দেখে পুলিশকে খবর দেয়। পরে সকালে আবদুল বারীর মরদেহ উদ্ধার করে গুলশান থানা পুলিশ। পুলিশের ধারণা, ৭-৮ ঘণ্টা আগে তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।

কে বা কারা আব্দুল বারীকে হত্যা করেছে তা স্পষ্ট না হলেও পুলিশ বলছে, পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে তাকে। এর নেপথ্যে যে বা যারাই থাক তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। ইতোমধ্যে থানা পুলিশের পাশাপাশি ছায়া তদন্তে নেমেছে গুলশান গোয়েন্দা পুলিশ।

গুলশান পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসি নিউজের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার আব্দুল বারী কেন, কীভাবে এখানে আসলেন, কারা এই হত্যার ঘটনা কেন ঘটিয়েছে, ঘটনার পেছনে কারা জড়িত, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমাদের প্রাথমিক ধারণা, তাকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। আশা করছি দ্রুতই জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে পারব।

তিনি বলেন, আমরা সুরতহালে দেখেছি, তার গলায় দাগ ও নাভির ওপরে কাটা দাগ দেখেছি। সব কিছু নিয়েই কাজ করছি। তথ্য-প্রযুক্তিগত সহায়তা ও ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করা হবে।

মামলার বিষয়ে গুলশান ডিসি বলেন, আইনগত প্রক্রিয়ায় এই ঘটনায় মামলা হবে।

গুলশান গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বলেন, ডিবিসি নিউজের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার আব্দুল বারী হত্যার শিকার তা স্পষ্ট। এটা নিয়ে থানা পুলিশ কাজ করছে। পাশাপাশি আমরা ঘটনা জানার পর থেকেই ছায়া তদন্ত করছি।

তিনি কেন সেখানে গেলেন, সাথে কেউ ছিলেন কি না, কারা হত্যা করল তা জানার চেষ্টা করছি। আমরা বাসা ও ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করব। পাশাপাশি তথ্য-প্রযুক্তিগত সহায়তায় খুনিদের শনাক্তের চেষ্টা করছি।

এর আগে গুলশান থানার ওসি আবুল হাসান জানিয়েছিলেন, মরদেহ উদ্ধারের পর সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট হত্যাকাণ্ডের আলামত সংগ্রহ করেছে। এরপর ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।

ওসি বলেন, ৭-৮ ঘণ্টা আগে তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। প্রাথমিকভাবে ধারণা, পূর্বশত্রুতার জের ধরে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে। এ ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এই হত্যার তদন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।

গুলশান বিভাগ পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নাজমুল হাসান ফিরোজ জানান, মরদেহ এবং আলামত দেখে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে বারীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জখম করে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে ঘাতকরা।

ধারণা করা হচ্ছে, প্রথমে বারীকে ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়। পরে সে বাঁচার জন্য পানিতে নেমে পড়ে। কারণ তার জামা কাপড় ভেজা ছিল। পরে বারী আবার লেকপাড়ে উঠে এলে তাকে মাটিতে ফেলে গলা কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। তার মরদেহের পাশ থেকে এ সময় রক্তমাখা ছুরি, মানিব্যাগ এবং মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে। বারীর গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ সদরে। মহাখালীতে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি।

এর আগে চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি রাত আড়াইটার পর রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয় সাংবাদিক হাবিব রহমানকে। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।

মোটরসাইকেল আরোহী সাংবাদিক হাবীব রহমান দুর্ঘটনা কবলিত নাকি হত্যার শিকার সেই রহস্য নিয়ে এখনো তদন্ত চলমান। তার ব্যবহার করা মোটরসাইকেলটি সেই সময় প্রায় অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। হাবীব রহমান সময়ের আলোতে আওয়ামী লীগ বিটে কর্মরত ছিলেন। তার প্রকৃত নাম হাবীবুর রহমান।

এদিকে স্থানীয়রা বলছেন, হাতিরঝিলে এমন লাশ পাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও কয়েকবার হাতিরঝিলের বিভিন্ন স্থান থেকে লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।

তারা জানান, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো হাতিরঝিল এলাকা নীরব হয়ে যায়। এ সুযোগেই অপরাধীরা অপরাধ সংঘটিত করে পালিয়ে যায়। যদিও রাত কিংবা দিনে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তা টহল থাকলেও সুযোগ বুঝে এসব অপরাধ করছে অপরাধীরা।

এলাকাবাসীর দাবি, হাতিরঝিলজুড়ে নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি সিসি ক্যামেরা বৃদ্ধি করা গেলে কমে আসবে অপরাধ।

সূত্রে জানা গেছে, সন্ধ্যার পর থেকে হাতিরঝিলের সঙ্গে সংযুক্ত অন্তত ৩৮টি চোরাগোপ্তা গলি আর বাসাবাড়ির চোরাগেট ঘিরে বেড়ে যায় মাদক ব্যবসায়ী ও নেশাখোরদের আনাগোনা। তৎপরতা বাড়ে ছিনতাইচক্রের। ঝিলের সংযোগ সেতুর আশপাশেই মাদক বিক্রেতা ও সেবনকারীদের তৎপরতা বেশি।

রাতে আলো স্বল্পতার সুযোগে সেখানে জুটিবদ্ধ হয়ে আপত্তিকর কর্মকাণ্ড করছে কেউ কেউ। রাত যত গভীর হয় নিশিকন্যাদের উপস্থিতিও বাড়তে থাকে। কোথাও দলবেঁধে চলছে নেশার আসর। দেহব্যবসাকে ঘিরে হাতিরঝিলজুড়ে বেশ কজন দালাল তৎপর রয়েছে।

সমপ্রতি হাতিরঝিলে ঘুরতে এসেছিলেন সুমন, রবিউল ও রাহুল নামে তিন বন্ধু। রাত সাড়ে ৯টায় হাতিরঝিলে তেজগাঁও অংশে লেকের পাড়ে তাদের ঠেক দিয়ে তিনটি মোবাইল সেট নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।

ভুক্তভোগী সুমন বলেন, থানায় অভিযোগ করে লাভ কি? আরো বাড়তি ঝামেলায় পড়তে হবে। এ চক্রের অধিকাংশই কিশোর ও যুবক। ইয়াবার নেশায় বুঁদ হয়ে এদের অনেকেই অশালীন নৃত্যে নেচে ওঠে। ফাঁকে ফাঁকে চলে বাইক রেসিংয়ের প্রতিযোগিতা। ধনীর নেশাখোর ছেলেমেয়েরা এসে আড্ডা জমায় হাতিরঝিলে। এছাড়া ব্রিজগুলোর রেলিং ঘেঁষে বসে চলে মাদকসেবনসহ অসামাজিক কার্যকলাপ।

হাতিরঝিল প্রকল্প পরিচালক জামাল আখতার ভূঁইয়া বলেন, হাতিরঝিলের নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিরাপত্তাকর্মীরা কাজ করছে।

তিনি বলেন, ছিনতাই, দুর্ঘটনাসহ নানা ঘটনার অভিযোগ আসার পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের আপত্তিকর আড্ডার বিষয়টি নিয়ে অনেকেই অভিযোগ করছেন। আমরাও বিষয়টি খতিয়ে দেখেছি।

রেলিং ঘেঁষে বসে কেউ যেন অযথা আড্ডা দিতে না পারে, এ জন্যই কাঁটাতার বসানো হচ্ছে। আরো বিভিন্ন পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে।

হাতিরঝিল থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুর রশিদ বলেন, অপরাধ দমনের লক্ষ্যে অনেক বড় এলাকাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকায় বিভক্ত করে অপরাধীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করে থাকি। ঠিক তেমনিভাবে হাতিরঝিলেও আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি রয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি উদ্বোধনের পর হাতিরঝিলে সড়ক দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েকশ। আত্মহত্যা করেছেন ১৫ জন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!