• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
অর্থনীতিবিদদের পর্যালোচনা

বাজেটে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা নেই


নিজস্ব প্রতিবেদক জুন ৫, ২০২১, ১২:৩৭ পিএম
বাজেটে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা নেই

ঢাকা : জাতীয় সংসদে গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেছেন। বাজেটের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে অর্থনীতিবিদদের পক্ষ থেকে দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ সামগ্রিকভাবে বাজেটকে ভারসাম্যপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন। তারা সরকারের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। তবে অনেকেই রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়া, বাজেট ঘাটতি পূরণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও করোনার টিকা নিয়ে বাজেটে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা না থাকার বিষয়কে নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) শুক্রবার (৪ জুন) রাজধানীতে বাজেট-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় এক সংবাদ সম্মেলনে বাজেটে বিশাল ঘাটতির অর্থসংস্থান নিয়ে শঙ্কা জানিয়েছে। 

সংস্থাটি তাদের পর্যালোচনায় বলছে, বাজেটে অনুদান বাদ দিলে ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ। এই পরিমাণ অর্থ কোথা থেকে আসবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। 

সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘২০২০-২০২১ অর্থবছরের ১০ মাসের গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনা করে পুরো অর্থবছর কেমন হতে যাচ্ছে, সে বিষয়টি মাথায় রেখে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে গতিপ্রকৃতি ঠিক করা হয়নি। আমরা এখানে দুর্বল অবস্থায় রয়েছি।’

তিনি বলেন, রাজস্ব আহরণের বিষয়ে বাজেটে বলা হয়েছে, আগামী অর্থবছরে চলতি সংশোধিত বাজেটের তুলনায় রাজস্ব আহরণ ১০.০৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ঘাটতি বাজেটের অর্থায়ন রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে কতটুকু সম্ভব হবে, সে বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ আছে।’

তবে রাজস্ব আদায়ে দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানো গেলে রাজস্ব আহরণ ৩০.৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব বলে সিপিডি পর্যালোচনায় দেখতে পায়।

যদিও সরকার বাজেটের এই ঘাটতি মেটাতে সরকার ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে নেবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। তবে ব্যাংক থেকে ৭৬ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হলে এর কোনো বিরূপ প্রভাব ব্যাংকিং খাতে পড়বে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেছেন, এতে কোনো প্রভাব পড়বে না। 

গভর্নর বলেন, ‘ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ কোটি টাকার বেশি। গত এক বছরের ব্যবধানে অতিরিক্ত তারল্য বেড়েছে ৯২ দশমিক ৪২ শতাংশ। বিশাল এই তারল্যের একটি বড় অংশ বিলবন্ডে বিনিয়োগ করার পরেও বর্তমানে থাকা তারল্যের পরিমাণ এখনো ৪০ হাজার কোটি টাকা।’

এদিকে, নতুন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন ভাতাভোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এতে সব মিলিয়ে আরো প্রায় ১৪ লাখ গরিব মানুষ সরকারের সহায়তা পাবে। কোভিড-১৯ সংকটের মধ্যে নতুন অর্থবছরের বাজেটে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা খরচের যে পরিকল্পনা অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাজিয়েছেন, তার মধ্যে ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪  কোটি বরাদ্দ রেখেছেন সামাজিক নিরাপত্তা খাতে। এই অংক মোট বাজেটের প্রায় ১৮ শতাংশ। আর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ১১ শতাংশ।

তবে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানসহ দরিদ্র মানুষের আয় বাড়ানোর বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম বাজেটে সুনির্দিষ্ট কর্মকৌশল ও বাস্তবায়ন কৌশল নির্ধারণ করা থাকবে। এটা নিয়ে অনেক কথা-বার্তা হয়েছে। কিন্তু তা কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাস্তব প্রতিফলন ঘটেনি।’

এই অর্থনীতিবিদের মতে, শুধু অংকের হিসেবে বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু বাস্তবে বাজেটে সাধারণ মানুষের জন্য খুব বেশি কিছু করা হয়েছে তা না। এছাড়া, এডিপিতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাও বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করেন তিনি। 

সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘এডিপিতে এমন অনেক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে যা ততটা গুরুত্বপূর্ণ না; বরং এডিপিটা কমিয়ে দিলে ঘাটতিটা কমে আসতো। অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যা বর্তমান বাস্তবতায় জনগণের জন্য খুব একটা উপকারে আসবে বলে মনে হয় না। আরেকটু বাস্তবসম্মত এবং বাস্তবায়নযোগ্য হওয়ার দরকার ছিল।’

বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে মোট ৩২,৭৩১ কোটি টাকা, বা জিডিপি-র মাত্র ০.৯৫ শতাংশ, যা গেল বছরের সংশোধিত বাজেটের ১.০২ শতাংশের চেয়েও কম। আগামী অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের ৫.৪২ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। পাশাপাশি আরো অতিরিক্ত ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের মতে, যেহেতু করোনা নিয়ন্ত্রণের ওপরই নির্ভর করছে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ, তাই বাজেটে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা দরকার ছিল। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুরের মতে, আকার ও বরাদ্দের দিক থেকে সামগ্রিকভাবে একটা ব্যালেন্সড বাজেট। করোনাকে ফোকাস করা হয়েছে। কিন্তু কীভাবে করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করবো সেই রোডম্যাপ দেওয়া হয়নি। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ, দেশের প্রবৃদ্ধি বিনিয়োগ সবকিছুই নির্ভর করছে করোনার ওপর। করোনাকে যতদিন দূর করতে না পারবো ততদিন কোনো অগ্রগতি হবে না। শুধু ১০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে দিলাম আর টিকা হয়ে গেলো তাতো হবে না।

তিনি বলেন, ‘সরকার মাসে ২৫ লাখ টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু এই রেটে টিকা দেওয়া হলে ১২ কোটি লোকের ২৪ কোটি টিকা দিতে ৭ বছর লাগবে। সে হিসেবে দিনে ১ লাখেরও কম লোকে টিকা পাবে। যেখানে দিনে কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ লোককে টিকা দেওয়া দরকার। তাহলে ৫-৬ মাসের মধ্যে টিকা দেওয়া সম্পন্ন হবে। ৭ বছর দীর্ঘসময়। এটা গ্রহণযোগ্য না। এছাড়া, এখনো পর্যাপ্ত টিকা পাওয়া নিয়েও সংশয় রয়েছে। টিকা প্রদানের জন্য সরকারের টার্গেট ঠিক করা উচিত ছিল। সেটি ঠিক করা হয়নি।’

এছাড়া, রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা সম্পর্কে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। কমপক্ষে ৩০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি থেকে যাবে। তবে গতবার ৮০ হাজার কোটি হয়েছিল সেটা হবে না। কিন্তু জাতীয় আয়ের তুলনায় রাজস্ব আদায় কমবে। গত রাজস্ব আদায় ছিল জাতীয় আয়ের ৭.৬ শতাংশ। এবার তা ৭.২-৭.১ এ নেমে আসবে। এটা কমতেই থাকবে। যা খুবই খারাপ লক্ষণ।’

তবে অর্থনীতিবিদরা বৈদেশিক ঋণগ্রহণসহ কয়েকটি বিষয়কে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। এরমধ্যে, ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি-রপ্তানির ধারা বজায় থাকা, রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহ, ব্যালেন্স অব পেমেন্টের স্বস্তিদায়ক অবস্থা, মুদ্রার বিনিময় স্থিতিশীলতা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি।

সোনালীনিউজ/এমএএইচ

Wordbridge School
Link copied!