• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এবার আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ


নিজস্ব প্রতিবেদক আগস্ট ১৮, ২০২২, ১১:২২ এএম
এবার আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ

ঢাকা : ডলার সংকটের কারণে সরকার বেশ কিছুদিন ধরেই আমদানিতে লাগাম টানতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। এবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাশ্রয় এবং অপ্রধান পণ্য আমদানি বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। 

এ জন্য বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের একটি কমিটি সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ৬টি প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এতে ৩৩০ ধরনের পণ্যে আমদানি নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করা হয়েছে।  

আমদানি ব্যয় কমিয়ে অত্যাবশ্যকীয় নয় এমন পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে গত ২০ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে নির্দেশ দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ট্যারিফ কমিশন ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটি যাচাই-বাছাই শেষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠায়।

প্রতিবেদনে ট্যারিফ কমিশন ৬টি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনতে ট্যারিফ কমিশন ৩৩০ ধরনের পণ্যের শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) ও ট্যারিফ মূল্য বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে। 

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বিদেশি ফল, স্বর্ণ, মদ-বিয়ার, স্মার্টফোন, গাড়ি, এয়ারকন্ডিশন, রেফ্রিজারেটর, মশলা জাতীয় পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য রয়েছে।

তাছাড়া বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, গোয়েন্দা সংস্থা, পণ্য সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং এফবিসিসিআই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়। 

একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত পণ্যের মিথ্যা ঘোষণা, আন্ডার ইনভয়েসিং ও অন্য অসাধু পন্থায় আমদানি রোধে শুল্ক স্টেশনগুলোকে নির্দেশনা প্রদান করা যেতে পারে। পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে ইনফরমাল ট্রেড রোধ করার জন্য বর্ডার গার্ডকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করা যেতে পারে। 

একই সঙ্গে সাময়িক সময়ের জন্য বন্ডের ক্যাটাগরি (শতভাগ রপ্তানিমুখী, হোম কনজাম্পশন ও ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড) অনুযায়ী বন্ডেড ওয়্যার হাউসে পণ্যের সংরক্ষণকাল কমিয়ে আনার বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ আমদানিতে ব্যয় করেছে ৮২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। যেখানে রপ্তানি হয়েছে ৪৯ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার এবং বাণিজ্য ঘাটতি ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। 

কিন্তু ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ বেশ কিছুদিন ধরেই আমদানিতে লাগাম টানতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে এসব পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছে ট্যারিফ কমিশন।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ করা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তি ৪৬ শতাংশ বেড়ে ৮ হাজার ৩৬৮ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। 

এর মধ্যে প্রধান ২৫ ধরনের পণ্যের আমদানির পেছনে ব্যয় হয়েছে ৭০ দশমিক ৪১ শতাংশ। বাকি ২৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে ‘বিবিধ’ বা অপ্রধান পণ্য আমদানির পেছনে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ করা পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তি ৪৬ শতাংশ বেড়ে ৮ হাজার ৩৬৮ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এককভাবে আমদানি ব্যয়ের সবচেয়ে বড় খাত অপ্রধান পণ্য আমদানি। এই ব্যয় ছিল প্রায় ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় এসব পণ্যের আমদানি ঋণপত্র নিষ্পত্তি বেড়েছে ৪৪ শতাংশ।

ট্যারিফ কমিশনের প্রস্তাবিত নিয়ন্ত্রিত পণ্যের তালিকায় আছে সব ধরনের মদ-বিয়ার, সিগারেট, চুরুট বা তামাকজাতীয় পণ্য, আম, কমলা, ছোট কমলালেবু, তাজা-শুকনা আঙ্গুর, তরমুজ, আপেল, নাশপাতি, পাম ফল, চেরি ফল, স্ট্রবেরি, কিউই ফল, কফি, গ্রিন টি, চা পাতা, গোলমরিচ, দারচিনি, লবঙ্গ, পাস্তা, মিষ্টি বিস্কুট, ওয়েফার, কেক, পাউরুটি, জ্যাম-জেলি, কমলা-আপেলের জুস, সব ধরনের ফলের রস, সয়া সস, টমেটো কেচাপ, স্যুপ, আইসক্রিম, পানি, লবণ, কাজুবাদাম, পেস্তাবাদাম, পাইনবাদাম, সুপারি, খেজুর, ডুমুর ফল আভোকাডো ইত্যাদি।

এছাড়াও রয়েছে প্লাস্টিকের প্লেট, বাথটাব, রান্নাঘরের বেসিন, দরজা-জানালা, হাতব্যাগ, স্যুটকেস, চামড়ার বেল্ট, প্লাস্টিকের বোর্ড, অগ্নিনির্বাপক দরজা, সিগারেট পেপার, সুতির প্যান্ট-শার্টের কাপড়, প্রিন্টেড কাপড়, কার্পেট, থ্রি-পিস, হাতে তৈরি লেস, ছাতা, প্লাস্টিকের ফুল, মার্বেল-গ্রানাইট, ইমিটেশন জুয়েলারি, ছাদে ব্যবহত টাইলস, সিরামিকের সিংক, বাথরুম ফিটিংস, বাথরুমে ব্যবহত গ্যাসওয়্যার, টেবিলওয়্যার (কাপ-পিরিচ), স্যানিটারি ওয়্যার, রেজর, ব্লেড, ইলেকট্রিক ওয়্যার, সব ধরনের তালা-চাবি, সব ধরনের ফ্যান, এয়ারকন্ডিশনার, ডিপ ফ্রিজ, রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেন, হোম অ্যাপ্লায়েন্স সামগ্রী, স্মার্টফোন, স্পিকার, সব ধরনের ব্যক্তিগত গাড়ি, সাইকেল, দেয়াল ঘড়ি, অ্যালার্ম ঘড়ি, গাড়ির সিট, কাঠের ফার্নিচার, ভিডিও গেম, তাস, টেবিল টেনিস ও টেনিস খেলার সরঞ্জাম, বল (গলফ, টেবিল টেনিস, টেনিস), মাছ ধরার বড়শি ইত্যাদি।

এর বাইরে স্বর্ণালংকার ও স্বর্ণের বার আমদানি নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। বর্তমানে ব্যাগেজ রুলের আওতায় স্বর্ণের বার আমদানিতে ২ হাজার টাকা শুল্ক-কর দিতে হয়। এটি বাড়িয়ে ৩ হাজার টাকা করার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি স্মার্টফোন আমদানিতে ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের সুপারিশ করা হয়েছে।

যে সব পণ্যের আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি করলে শিল্পোৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই, সে সব পণ্যের আমদানি সাময়িকভাবে বাড়তি শুল্কারোপের মাধ্যমে নিরুৎসাহিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। আর যে সব ভোগ্যপণ্য সমাজের উচ্চ ক্রয়ক্ষমতা সম্পন্ন শ্রেণি ভোগ করে থাকে, সে সব পণ্যের শুল্কহার বৃদ্ধি করার পাশাপাশি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে শুল্কায়নযোগ্য মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে সম্ভাব্য রাজস্ব ক্ষতির প্রভাব কিছুটা হলেও লাঘব হবে। বিশেষ প্রয়োজনে আমদানিযোগ্য পণ্যের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের ভিত্তিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। 

বন্ডের মাধ্যমে শতভাগ রপ্তানি খাতের জন্য যে পণ্য আমদানি হয় তা স্থানীয় বাজারে প্রবেশ করলে স্থানীয় শিল্প সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অন্যদিকে সরকার রাজস্ব হারায়। এজন্য বন্ডের মাধ্যমে রপ্তানি খাতের জন্য আমদানিকৃত পণ্যের সম্ভাব্য অপব্যবহার রোধ করা গেলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। 

এছাড়া রপ্তানি খাতে মজুদ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনয়নের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব। যেমন সাময়িক সময়ের জন্য বন্ডের ক্যাটাগরি (শতভাগ রপ্তানিমুখী, হোম কনজাম্পশন ও ডিপ্লোমোটিক বন্ড) অনুযায়ী বন্ডেড ওয়্যার হাউজে মজুতকাল কমিয়ে আনার বিষয়টি সরকারকে বিবেচনার সুপারিশ করা হয়েছে। 

শুল্ক-কর ও ট্যারিফ মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হলে, অর্থনীতিতে এর সম্ভাব্য কী প্রভাব পড়তে পারে তাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়তে পারে আমদানি পর্যায়ে রাজস্ব কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে। বিদ্যমান পণ্য মজুদের কারণে মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। মিথ্যা ঘোষণা, মিস ডিক্লারেশন, আন্ডার ইনভয়েসিং ও অন্য অসাধু পন্থায় আমদানি বৃদ্ধির প্রবণতা বাড়তে পারে। অন্যদিকে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর ও শুল্কায়নযোগ্য মূল্য বৃদ্ধি করা হলে রাজস্ব সংগ্রহের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!