• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাবি অধ্যাপকের চাকুরি ফেরাতে স্ত্রীকে দিয়ে ফাঁদ


জাবি প্রতিনিধি অক্টোবর ২৮, ২০২০, ০৩:০৭ পিএম
জাবি অধ্যাপকের চাকুরি ফেরাতে স্ত্রীকে দিয়ে ফাঁদ

ছবি: প্রতিনিধি

জাবি : গত বছর সেপ্টেম্বরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সানওয়ার সিরাজের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করে একই বিভাগের স্নাতকোত্তরের এক ছাত্রী। এ অভিযোগে সানওয়ারকে এক বছরেরও বেশি সময় একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে বিরত রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। 

তবে সানওয়ারের বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরিচ্যুত অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আকন্দ মামুনের পাতানো ফাঁদ। যা তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে জিম্মি করে দাখিল করান। স্ত্রীর ওপর অত্যাচার করায় আকন্দের সাথে বিচ্ছেদ ঘটানোর পর ওই ছাত্রীর বয়ানে বেরিয়ে আসে এসব তথ্য। এই প্রতিবেদকের হাতে এসবের তথ্য-উপাত্ত ও ছাত্রীর বর্ণনা সংরক্ষিত রয়েছে।

গতবছর সেপ্টেম্বরে ‘দুর্নীতির অভিযোগে’ জাবিতে ভিসি বিরোধী আন্দোলন চড়াও হয়। এই আন্দোলনকে পুঁজি করে মামুন আকন্দ চাকুরি ফেরাতে ফন্দি আঁটেন। আন্দোলন চলাকালে ১৯ সেপ্টেম্বর সরকার ও রাজনীতি বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী (আকন্দের স্ত্রী) একই বিভাগের ভিসিপন্থী সহকারী অধ্যাপক ড. সানওয়ার সিরাজের বিরুদ্ধে পরীক্ষার খাতায় কম নম্বর দেওয়া, যৌন নিপীড়ন এবং সানওয়ারের ‘পৃষ্ঠপোষক’ শিক্ষকদের বৈরী আচরণের প্রতিকার চেয়ে বিভাগের সভাপতি বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ২৬টি ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ‘নাটক’ করে হাসপাতালে ভর্তি হন ওই ছাত্রী। বিষয়টি জানাজানি হলে ২৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ পত্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলে প্রেরণ করেন বিভাগের সভাপতি। ২৯ সেপ্টেম্বর সেলের সুপারিশক্রমে উপাচার্য সানওয়ারকে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। 

আন্দোলনের সময় এই ছাত্রীর অভিযোগটি আগুনে ঘি ঢালে। ভিসিপন্থী শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগে আন্দোলন আরো তীব্র হয়। তখন মামুন আকন্দ সানওয়ারের সাথে যোগাযোগ করে বলেন, যদি প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা এখনই তার চাকুরি ফেরত দেয় তবে তিনি সানওয়ারকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য সকল তথ্য সরবরাহ করবেন। তখন মামুন আকন্দ সানওয়ারে বিরুদ্ধে সেলে দাখিল করা কিছু বানানো অডিও ও স্ক্রিনশর্ট সানওয়ার সহ বিভিন্ন জনের কাছে ছড়িয়ে দেয়। আর এতে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ দিয়ে ওই ছাত্রীটি উল্টো বিপাকে পড়েন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এ অভিযোগের আগে ওই ছাত্রী প্রথমে গোপন (ফেইক) ও পরে নিজের ফেসবুকের মাধ্যমে সানওয়ারের স্ত্রীকে স্বামীর নামে নানা রকম প্ররোচনা দিয়ে স্বামীর শাস্তির দাবিতে ভিসির কাছে অভিযোগ দাখিলের পায়তারা করে। এতে ক্যাম্পাসের কয়েকজন ছাত্রীর ছবি দিয়ে তাদের সাথে সানওয়ারের সম্পর্ক আছে বলে স্ত্রীর কাছে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। এসময় স্বামীর বিরুদ্ধে চলমান চক্রান্ত বুঝতে পেরে ওই ছাত্রীর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করেন সানওয়ারের স্ত্রী। এই প্ররোচিত করা ম্যাসেঞ্জার ও মুঠোফোনের কথোপকথন প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মামুন আকন্দ ও তার স্ত্রী (ওই ছাত্রী) দু’জন মিলেই এই ফাঁদ তৈরী করে।

সানওয়ারের স্ত্রী অভিযোগ না করায় মামুন আকন্দের কৌশল ও স্বার্থ হাসিলের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পরে আকন্দ নিজের স্ত্রীকে দিয়েই সানোয়ারের নামে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ দাখিল করান। এ বিষয়ে মামুন আকন্দের স্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি স্যারের (সানওয়ারের) নামে কোন অভিযোগ দিতে চাইনি। অভিযোগ পত্রটি মামুন আকন্দ নিজে লিখে আমাকে জিম্মি করে দাখিল করিয়েছে। অভিযোগ দাখিলের সময় উনি (মামুন আকন্দ) নানা রকম স্ক্রিনশর্ট ও অডিও বানায়। তা দ্বারা সানওয়ারের সাথে আমার অন্য রকম সম্পর্ক আছে বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করে।’

অভিযোগ দাখিলের পরে ছাত্রীটি ২৬টি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টার করে বলে অভিযোগ উঠেছিল। এ প্রসঙ্গে ওই ছাত্রী বলেন, ‘গত বছর ১ সেপ্টেম্বর আমি ও মামুন আকন্দ বিয়ে করি। এরপর সে আমার ওপর শারীরিক ও মানসিক  অত্যাচার শুরু করে। আমি এসব সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেঁছে নিই। কিন্তু এই ঘটনাকেও মামুন আকন্দ অন্য দিকে প্রভাবিত করে সানওয়ারের ওপর দোষ চাপায়।’ পরের মাসেই মামুন আকন্দকে তিনি ডিভোর্স দেন বলে জানান।

মামুন আকন্দের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পরেও অত্যাচার ও নিপীড়ন করে যাচ্ছেন বলে জানান এই ছাত্রী। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘উনি (মামুন আকন্দ) আমার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট আটকিয়ে রেখেছে। এছাড়া আমার ফেসবুক একাউন্টটিও সে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে। আমি তাকে তালাক দিলেও সেগুলো ফেরত দেয়নি। উল্টো ফেইক স্ক্রিনশর্ট ও অডিও তৈরী করে প্রতিনিয়ত আমাকে ব্লাকমেইল করে যাচ্ছে। এমনকি আমার কিছু গোপন ছবি ও অডিও-ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে আমাকে এখনো হয়রানি করছে।’

গণমাধ্যমের সাথে কথা বলার সময় এই ছাত্রী মামুন আকন্দের নির্যাতন থেকে মুক্তি কামনা করে বলেন, ‘একটা মানুষ কতোটা খারাপ হতে পারে তা তার (মামুন আকন্দের) সাথে না মিশলে জানতে পারতাম না। আমি তার অত্যাচার-নিপীড়ন থেকে মুক্তি চাই।’

তবে এই ছাত্রীর মুখ খুলার আগে তাদের বিয়ের বিষয়টি গোপন ছিল।

জানা যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী ও প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আকন্দ মামুনকে একাধিক আচরণবিধি ভঙ্গের দায়ে ২০১৪ সালের ২৪ আগস্ট অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট তাকে স্থায়ীভাবে চাকুরিচ্যুত করে। পরবর্তীতে হাইকোর্টের একটি রায় নিয়ে তিনি বিশ‌্ববিদ্যালয়ের যোগদানের চেষ্টা করেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাতে সাড়া না দেওয়ায় অভিনব ও নেক্কার পন্থা অবলম্বন করেন। ৪৩ ব্যাচের এক ছাত্রীকে বিয়ে করে তাকে দিয়েই ফাঁদ পেতে চাকুরিতে যোগদানের পায়তারা করেন। কিন্তু স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ স্ত্রী ডিভোর্সের পর ফাঁস করেন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

এ অভিযোগের বিষয়ে মোহাম্মদ আলী আকন্দ মামুনকে মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। আর আমি সাংবাদিকদের সাথে তো কোন কথাই বলবো না।’

যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলের প্রধান অধ্যাপক রাশেদা আখতার বলেন, ‘আমাদের তদন্ত চলমান রয়েছে। তদন্তের কয়েকটি ধাপ এখনো বাকি আছে।’ সেলে আসা যে কোন অভিযোগ ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ করার নিয়ম থাকলো এ অভিযোগটি এক বছর পার হওয়া প্রসঙ্গে রাশেদা আখতার বলেন, ‘করোনার কারণে তদন্ত কমিটি কাজ করতে পারছে না। এজন্য সময় লাগছে।’ তবে কবে নাগাদ এ প্রক্রিয়া শেষ হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছুই বলেননি তিনি।

এ বিষয়ে সহকারী অধ্যাপক সানোয়ার সিরাজ বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি আমার বিরুদ্ধে একটা মিথ্যা ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগ দিয়ে আমাকে অপমাণিত ও হয়রানি করা হচ্ছে। আমি চাই এ বিষয়ের দ্রুত সমাধান হোক। মানুষ সত্যটা জানুক।’

সোনালীনিউজ/এমএএইচ

Wordbridge School
Link copied!