• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ

শিক্ষাক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে


নিজস্ব প্রতিবেদক অক্টোবর ১৬, ২০২১, ১২:২১ পিএম
শিক্ষাক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে

ঢাকা : আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করতে ২০২৩ সাল থেকে বদলে যাবে শিক্ষাব্যবস্থা। এরই মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমের খসড়া রূপরেখার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে পরীক্ষানির্ভরতা কমিয়ে শিখনকালীন মূল্যায়নে জোর দেওয়া হয়েছে।

অর্থাৎ শ্রেণিকক্ষেই একজন শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করবেন; কিন্তু কিছু শিক্ষকের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুগোপযোগী করা না গেলে, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যে শিক্ষক নিজে প্রশ্নই করতে পারেন না, তিনি কীভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করবেন। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তায়নের সিদ্ধান্ত ভালো উদ্যোগ। তবে এতে নতুন কিছু নেই। সব বিষয়ই এক সময়ে আমাদের দেশে ছিল; কিন্তু বাস্তবায়ন করতে না পারায় পরিবর্তন করা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির পরীক্ষা আগেও ছিল না। ৩০ বছর আগে এমন ব্যবস্থা চালু ছিল; কিন্তু দেখা গেছে এটা ভালোভাবে চলছিল না। এ কারণে এক সময়ে তা বাতিল করা হয়। আবার ১৯৬০ সালের দিকে বাংলাদেশে একমুখী শিক্ষা চালু ছিল।

সবাইকে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্যের বিষয় পড়তে হতো; কিন্তু এক সময়ে এসে নবম থেকেই বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য পৃথক করা হলো।

এর মূল কারণ যেভাবে চলার কথা ছিল, সেভাবে চলেনি। নতুন শিক্ষাক্রমে, আমরা আগের সেই অবস্থায় ফিরে যাচ্ছি। তবে কেন একমুখী থেকে বহুমুখী শিক্ষা চালু হয়েছিল, কেন প্রথম শ্রেণি থেকেই পরীক্ষা পদ্ধতি চালু ছিল, সেটি জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে একাধিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, শিক্ষকদের প্রস্তুত করতে হবে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যুগোপযোগী করে প্রস্তুত করতে হবে। শুধু ঢাকা শহরের প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালে হবে না। মফস্বল ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগুলোর দিকেও তাকাতে হবে। শিক্ষা খাতে বাজেট আরও বাড়াতে হবে। আর এই বাজেট ব্যবহারে সচ্ছতা থাকতে হবে।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, শিক্ষায় অনেক বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এই পরিবর্তনের আগে যথেষ্ট গবেষণা করা প্রয়োজন। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানো আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভালো পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে। পাঠদানে পরিবর্তন আনতে হবে। পাঠদানের সঙ্গে প্রযুক্তি যুক্ত করতে হবে।

জানা যায়, পরিবর্তিত শিক্ষাক্রমে এসএসসি পর্যন্ত কোনো পাবলিক পরীক্ষা থাকবে না। এইচএসসিতে একটি বোর্ড পরীক্ষার পরিবর্তে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে অনুষ্ঠিত হবে দুটি পাবলিক পরীক্ষা। পরে এই দুই পরীক্ষার পয়েন্ট মিলিয়ে তৈরি হবে এইচএসসির গ্রেড পয়েন্ট। আর তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য থাকবে না কোনো পরীক্ষা। বস্তুত পাঠদান শ্রেণিকক্ষেই শেষ করতে বলা হয়েছে।

হোমওয়ার্ক কম দিতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা নিজেরা সময় কাটাতে এবং খেলাধুলা করতে পারে। তৃতীয় লিঙ্গের শিশু ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের স্কুলে ভর্তি করতে হবে। তারা যেখানে ভর্তি হতে চায়, সেখানেই ভর্তি করতে হবে বলেও প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন।

গত সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা উপস্থাপন করা হয়। এ সময় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘২০২৫ সাল থেকে নতুন প্রণীত জাতীয় শিক্ষাক্রম পুরোপুরিভাবে কার্যকর করা হবে। তবে তার আগে আগামী বছর থেকে প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পাইলটিং শুরু হবে।

২০২৩ সাল থেকে প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে শুরু হবে নতুন শিক্ষাক্রম’। নতুন কারিকুলামে বেশ কিছু পরীক্ষা তুলে দেওয়া হলেও মেধার মূল্যায়নে কোনো ঘাটতি থাকবে না বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী।

তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত থাকছে না পরীক্ষা : খসড়া রূপরেখা অনুযায়ী প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো বার্ষিক পরীক্ষা থাকছে না। খুদে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে হবে না। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়েই ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে; অর্থাৎ ক্লাসে মূল্যায়ন করা হবে। এরপর চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ। আর ৪০ শতাংশ মূল্যায়ন হবে ক্লাস শেষে পরীক্ষার মাধ্যমে, যেটিকে রূপরেখায় ‘সামষ্টিক মূল্যায়ন’ বলা হয়েছে।

নতুন প্রণীত জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানান, চতুর্থ শ্রেণি থেকেই বছর শেষে প্রতি ক্লাসে মূল্যায়ন হবে। শিখনকালীন ও ক্লাস শেষে পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করে ফল জানানো হবে। প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা রাখা হয়নি। কারণ আমরা সনদের জন্য শিক্ষা নয়, পারদর্শিতা নিশ্চিত করতে চাই। সনদ দেওয়ার জন্য পাবলিক পরীক্ষার দরকার নেই।

নবম-দশমে নেই বিভাগ বিভাজন : অষ্টম থেকে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পরই শিক্ষার্থীদের একটি বিভাগ পছন্দ করতে হতো; অর্থাৎ বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের যে কোনো একটি বেছে নিতে হবে। তবে নতুন প্রণীত জাতীয় শিক্ষাক্রমে এ বিভাজন থাকছে না। নবম ও দশম শ্রেণিতে সব শিক্ষার্থীকে অভিন্ন ১০টি বিষয় পড়তে হবে। দশম শ্রেণির আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষাও নেওয়া হবে না।

একেবারে দশম শ্রেণির পর এসএসসি নামে পাবলিক পরীক্ষা হবে, তবে তা হবে শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে। এখন যেমন নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে পাবলিক পরীক্ষা হয়।

ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন ১০ বিষয় : খসড়া শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ১০টি অভিন্ন বিষয়ে পড়ানো হবে। এরপর একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে শাখা পরিবর্তনের সুযোগ রাখা হবে। বর্তমানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কিছু অভিন্ন বই পড়তে হয় এবং নবম শ্রেণিতে গিয়ে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা এসব শাখায় ভাগ হয়ে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে।

নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত যে ১০ বিষয়ে পড়ানো হবে; সেগুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, সামাজিক বিজ্ঞান, জীবন ও জীবিকা, ধর্ম, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। বর্তমানে এসব শ্রেণিতে ১২ থেকে ১৪টি বই পড়ানো হয়।

একাদশ ও দ্বাদশে পাবলিক পরীক্ষা : আগের মতো একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি শেষ করার পর এইচএসসি ও সমমানের পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হবে না। একাদশ শ্রেণিতে বছর শেষে একটি ও দ্বাদশে আরেকটি পরীক্ষা নেওয়া হবে। এ দুটিই হবে পাবলিক পরীক্ষা। দুই পাবলিক পরীক্ষার ফল মূল্যায়ন করে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে। এ ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ পরীক্ষাভিত্তিক এবং ৩০ শতাংশ ক্লাস মূল্যায়ন করা হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।

নতুন শিক্ষাক্রম যেভাবে বাস্তবায়ন হবে : প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ১০০টি প্রতিষ্ঠানে পাইলটিং করা হবে। তার মধ্যে কারিগরি ও মাদ্রাসাকে যুক্ত করা হবে। আর ২০২৩ সাল থেকে প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে শুরু হবে নতুন শিক্ষাক্রম।

২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণি এবং ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে এ শিক্ষাক্রম শুরু হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে পুরো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য : দীপু মনি বলেন, আনন্দময় পড়াশোনা হবে মূল লক্ষ্য। বিষয়বস্তু ও পাঠ্যপুস্তকের বোঝা ও চাপ কমানো হবে। গভীর শিখনে গুরুত্ব দেওয়া হবে। মুখস্থ নির্ভরতার বিষয়টি যেন না থাকে, এর বদলে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে খেলাখুলা ও অন্যান্য কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।’

তিনি আরও বলেন, ক্লাস শেষে যেন শিক্ষার্থীরা নিজেদের মতো সময় কাটাতে পারে। পড়াশোনার বাইরে খেলাধুলা বা অন্যান্য বিষয়ের সুযোগ কমে গেছে, এটি যেন না হয়। জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।

সরকারের নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহছানুল হক মিলন বলেন, সরকার অনেক দেরিতে এ উদ্যোগ নিয়েছে। আরও আগে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারত।

কেননা সরকার এখন শিক্ষাক্রমে যেসব পরিবর্তন নিয়ে এসে বাহবা নেওয়ার চেষ্টা করছেন, এগুলো ২০০৬ সালেই তৎকালীন জোট সরকার বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু করেছিল। শুধু রাজনৈতিক মনোবৃত্তির কারণেই সরকার ১৪টি বছর নষ্ট করেছে।

সরকার শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের জিপিএ বাড়িয়ে সস্তা বাহবা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। প্রকৃত অর্থে শিক্ষার্থীদের শিখন পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে মানবসম্পদ উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

 

Wordbridge School
Link copied!