• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ইতিহাস


বিনোদন প্রতিবেদক সেপ্টেম্বর ২২, ২০২০, ০৬:৩৯ পিএম
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ইতিহাস

ঢাকা : বাংলদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরষ্কার হল জাতীয় চলচ্চিত্র পুপুরস্কার। এখন পর্যন্ত যে ছবিগুলো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছে সেই ছবিগুলোর সাথে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যই দেশকন্ঠের এই আয়োজন। ১৯৭৫ সালে প্রথম বাংলা চলচ্চিত্রে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার দেয়া শুরু হয়।

আজকের প্রথম পর্বে থাকছে ৭০ দশকে যে ছবিগুলো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে সেই ছবিগুলো নিয়ে-
 
১৯৭৫- লাঠিয়াল : বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেয়া হয় ১৯৭৫ সালে। প্রথম বছর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে পুরষ্কার জিতে নেয় নারায়ণ ঘোষ মিতার “লাঠিয়াল” ছবিটি। ছবিটি পরিচালনা ও প্রযোজনা দুটিই করেছেন নারায়ন ঘোষ মিতা। গ্রাম্য পটভুমির এই ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন আনোয়ার হোসেন, ফারুক, রোজি আফসারী, ববিতা সহ আরও অনেকে। এই ছবিতে আনোয়ার হোসেন ও ফারুকের অভিনয় দর্শকদের হৃদয় ছুয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ২২শে আগষ্ট ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। ছবিটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র সহ মোট পাঁচটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার অর্জন করে। এই ছবি দিয়ে আনোয়ার হোসেন শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, ফারুক শ্রেষ্ঠ পার্শ্বঅভিনেতা, নারায়ণ ঘোষ মিতা শ্রেষ্ঠ পরিচালক, রোজী আফসারী শ্রেষ্ঠ পার্শ্বঅভিনেত্রী, বশীর হোসেন শ্রেষ্ঠ চিত্রসম্পাদনার পুরস্কার অর্জন করেন। ছবিটি শুধু পুরষ্কারই জিতেনি  ব্যাবসায়িকভাবেও সফল হয়েছিল।
 
১৯৭৬- মেঘের অনেক রং : ১৯৭৬ সালে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার  জিতে নেয় হারুনর রশীদের "মেঘের অনেক রং" ছবিটি। "মেঘের অনেক রং" বাংলাদেশের দ্বিতীয় রঙ্গীন চলচ্চিত্র। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সেসময় লাঞ্ছিত নারীদের দুর্দশা নিয়ে গড়ে উঠেছিল ছবিটির কাহিনী। ছবিটিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাথিন, ওমর এলাহী, রওশন আরা, আদনান প্রমুখ। "মেঘের অনেক রং" ছবির পরিচালক হারুনর রশীদ চাইছিলেন এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে একজন পাহাড়ী মেয়েকে দিয়ে কাজ করাতে। তাই তিনি পাহাড়ী মেয়ের অনুসন্ধান করছিলেন। এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করা মাথিন তখন রাঙামাটির নাটক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। তার মেসো রশীদের কাছে মাথিনের কাজের মহড়া নিয়ে আসেন। পরিচালক হারুন আর রশীদ তার কাজ দেখে তাকে এই ছবির জন্য নির্বাচন করেন। রত্না কথাচিত্রের ব্যানারে "মেঘের অনেক রং" ছবিটি প্রযোজনা করেছিল আনোয়ার আশরাফ ও শাজীদা শামীম। এই ছবিটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র সহ মোট পাঁচটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষাক্র জয়লাভ করেছিল। এই ছবি দিয়ে আনোয়ার আশরাফ- প্রযোজক(শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র), হারুনর রশীদ (শ্রেষ্ঠ পরিচালক), মাস্টার আদনান (শ্রেষ্ঠ শিশু শিল্পী), ফেরদৌসী রহমান (শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক), হারুনর রশীদ (শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক) জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
 
১৯৭৭- বসুন্ধরা : ঔপন্যাসিক আলাউদ্দিন আল আজাদের উপন্যাস তেইশ নম্বর তৈলচিত্র অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত৷ সুভাষ দত্তের পরিচালিত “বসুন্ধরা” ছবিটি ১৯৭৭ সালের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নেয়। এই ছবি দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়েছিল ইলিয়াস কাঞ্চনের। এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করার জন্য ইলিয়াস কাঞ্চন তিন মাস  চারুকলা ইন্সটিউটে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ইলিয়াস কাঞ্চন ছাড়াও এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন  ববিতা, নূতন, সৈয়দ হাসান ইমাম, শর্মিলী আহমেদ, আকরামসহ আরও অনেকে। “বসুন্ধরা” ছবিটি ১৯৭৭ সালের ১১ নভেম্বর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটির পরিবেশনার দায়িত্বে ছিল আনিস ফিল্ম কর্পোরেশন। ছবিটি পরিচালনা পাশাপাশি প্রযোজনাও করেছিলেন সুভাষ দত্ত। মুলত এক শিশুর মায়ের স্তনপানের চিত্রকর্মের উপর ভর করেই এই চলচ্চিত্রের কাহিনী। এই চলচ্চিত্রটি মোট ৬টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার অর্জন করে। এই ছবি দিয়ে  সুভাষ দত্ত (শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র এবং শ্রেষ্ঠ পরিচালক), ববিতা (শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী), সৈয়দ হাসান ইমাম (শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রে অভিনেতা), আলাউদ্দিন আল আজাদ (শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার), মহিউদ্দিন ফারুক (শ্রেষ্ঠ শিল্প নির্দেশক) জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারে ভূষিত হন।
 
১৯৭৮- গোলাপী এখন ট্রেনে : ১৯৭৮ সালে ছিল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ছিল “গোলাপী এখন ট্রেনে”র জয়জয়কার। আমজাদ হোসেনের "গোলাপী এখন ট্রেনে" পুরস্কার পায় মোট ১১টি বিভাগে। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, পরিচালক, চিত্রনাট্য, সংলাপ, সঙ্গীত, পার্শ্ব চরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, পার্শ্ব চরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী, চিত্রগ্রহণ, সংগীত পরিচালনা, শ্রেষ্ঠ গায়ক ও শ্রেষ্ঠ গায়িকা। এই ছবি দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার অর্জন করেন কিংবদন্তী অভিনেতা আনোয়ার হোসেন। ১৯৭৮ সালে "গোলাপী এখন ট্রেনে" ছবির সাথে মুক্তি পেয়েছিল "সারেং বৌ" ছবিটি। কে পুরস্কার পাবে এ নিয়ে তুমুল উৎকণ্ঠা ছিল দুই ছবির কলাকুশলীদের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছিল "গোলাপী এখন ট্রেনে" ছবিটি। "গোলাপী এখন ট্রেনে" ছবিটি চার দশক ধরে বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বাধিক শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের রেকর্ড ধরে রেখেছিল। মস্কো ফিল্ম ফেস্টটিভালেও "গোলাপী এখন ট্রেনে" ছবিটি প্রদর্শীত হয়েছিল। সেসময় ছবিটি দেখে ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন মৃণাল সেনের মতো নির্মাতারা। আমজাদ হোসেনের স্বরচিত উপন্যাস "দ্রোপদী এখন ট্রেনে"র চলচ্চিত্ররূপ "গোলাপী এখন ট্রেনে"। ছবিটি চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেছেন আমজাদ হোসেন। প্রযোজনার দায়িত্বে ছিলেন আমজাদ হোসেন ও বি. এফ. ডি. সি.। এই ছবিতে আমজাদ হোসেন আমাদের সমাজের বাস্তব রূপকে নগ্নভাবে তুলে ধরেছেন। সে সময়ের গ্রামীণ জীবনের চিত্র পর্দায় নিরূপণভাবে তুলে ধরলেন আমজাদ হোসেন। গোলাপীদের সংগ্রামের গল্পের পাশাপাশি মোড়লের ছেলেরূপী বিদ্রোহী মিলনও আছে। তার করুণ পরিণতি মনে করিয়ে দেয়, স্বার্থবাদী গোষ্ঠী পথের বাধা দূর করতে নিজের লোককেও বলি দিতেও দ্বিধা করে না। পরবর্তী সময়ে  আমজাদ হোসেন এই ছবির দুটি অনুবর্তী পর্ব "গোলাপী এখন ঢাকায়" (১৯৯৫) ও "গোলাপী এখন বিলাতে" (২০১০) এবং একটি ডকুফিকশন "গোলাপীরা এখন কোথায়"? নির্মাণ করেন।
 
১৯৭৯- সূর্য দীঘল বাড়ী : বিশিষ্ঠ গ্রন্থকার আবু ইসহাক এর ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত কালজয়ী (উপন্যাস) "সূর্য দীঘল বাড়ী" অবল্বনে ছায়াছবিটি যৌথভাবে নির্মাণ করেন মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী। এটিই বাংলাদেশের প্রথম সরকারি অনুদান প্রাপ্ত চলচ্চিত্র। ছবিটির নির্মান ব্যয় ছিল প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা। "সূর্য দীঘল বাড়ী" চলচ্চিত্রের গল্পের পটভূমি আবু ইসহাক সংগ্রহ করেছিলেন তাঁর যাপিত জীবন থেকেই। কুসংস্কার, সম্পদ, ধর্ম, প্রতিপত্তি, সামাজিক বাধা-নিষেধ, এমনকি জাতীয়তাবোধ এ সব কিছুকেই কাজে লাগিয়ে শ্রমজীবী ক্ষুধার্ত মানুষকে ক্রমাগত শোষণ এই চলচ্চিত্রের মূল বিষয়। এই ছবির মুল বিষয়গুলো চমৎকারভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী। এই ছবিতে প্রধান প্রধান চরিত্র গুলোতে অভিনয় করেছেন ডলি আনোয়ার, রওশন জামিল, জহিরুল হক, আরিফুল হক, কেরামত মাওলা, এ টি এম শামসুজ্জামান। এই ছবির সাড়াজাগানো চরিত্র 'জয়গুন' চরিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রথমে ফেরদৌসী মজুমদারকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল কিন্ত পরিবারকে সময় দেয়ার জন্য তিনি এই ছবিতে কাজ করতে পারেননি। পরবর্তীতে ডলি আনোয়ার 'জয়গুন' চরিত্রে অভিনয় করেন এবং শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার অর্জন করেন। "সূর্য দীঘল বাড়ী" ছবিটি মোট আটটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে।  মসিহউদ্দিন শাকের –প্রযোজক (শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র), শেখ নিয়ামত আলী ও মসিহউদ্দিন শাকের (শ্রেষ্ঠ পরিচালক), ডলি আনোয়ার (শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী), শেখ নিয়ামত আলী ও মসিহউদ্দিন শাকের (শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য), আনোয়ার হোসেন (শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রহণ), সাইদুল আনাম টুটুল (শ্রেষ্ঠ সম্পাদনা), ইলোরা গহর ও সজিব (শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী),  লেনিন (শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী -বিশেষ শাখায়) এই ছবি দিয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

সোনালিনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!