• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একাত্তরে কণ্ঠ দিয়ে যুদ্ধ করেছি : শাহীন সামাদ


বিনোদন প্রতিবেদক মার্চ ২৮, ২০২১, ১২:৫৩ পিএম
একাত্তরে কণ্ঠ দিয়ে যুদ্ধ করেছি : শাহীন সামাদ

ঢাকা : শাহীন সামাদ কেবল একজন নজরুল সংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী নন, ৭১-এর মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন কণ্ঠযোদ্ধা। স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিসেনারা যেমন অস্ত্র দিয়ে দুর্নিবার গতিতে পাকসেনাদের পরাজিত করেছিলেন, ঠিক তেমনি শাহীন সামাদ যুদ্ধ করেছেন কণ্ঠ দিয়ে। কণ্ঠকে হাতিয়ার বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছিলেন গানে গানে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যুদ্ধদিনের নানা স্মৃতি তুলে ধরেছেন স্বাধীন বাংলা বেতারের কেন্দ্রের এই কণ্ঠযোদ্ধা। বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তীসময় থেকে বর্তমান সময়ের সমসাময়িক বিষয়গুলোও।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই কণ্ঠশিল্পীর বিশেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোনালীনিউজ-এর বিশেষ প্রতিনিধি
 
সোনালীনিউজ : আপনি তো মুক্তিযুদ্ধের একজন সাহসী যোদ্ধা এবং সাক্ষী। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আপনার অনুভূতি কী?

শাহীন সামাদ : আমি সেই সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ছিলাম। যুদ্ধের প্রারম্ভে বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির আত্মপ্রকাশ ঘটে যারা তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করত। সেই ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে বাংলাদেশি মুক্তি সংগ্রামী শিল্প সংস্থা। আমাদের সেই দলে আরো ছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম, মুস্তফা মনোয়ারসহ অনেকেই। এভাবেই শুরু। আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করলাম।

সোনালীনিউজ : যুদ্ধের সময় আপনি দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তরে গিয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতেন। সেদিনগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন।

শাহীন সামাদ : সেই সময় আমি অনেক রিফিউজি ক্যাম্পে, যুদ্ধবিধ্বস্ত গ্রাম, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়েছিলাম। মুক্তিসেনাদের জন্য বিভিন্ন জায়গায় গান গেয়েছি, স্টেজ পারফর্ম করেও যে অর্থ পেয়েছি তা তাদের পেছনে ব্যয় করেছি। তাদের ক্যাম্পে গিয়ে স্বাধীনতার উদ্যমী, জাগ্রত, শাশ্বত, গতিময় গানগুলো গেয়ে তাদের ক্লান্তি, ব্যথা ভুলিয়ে দিয়েছি, যা তাদের নতুনভাবে প্রেরণা জুগিয়ে আরো অপ্রতিরোধ্য, অসীম সাহসী হয়ে পাক হানাদারদের নিশ্চিহ্ন করার প্রত্যয়ে অগ্রগামী করেছিল। এভাবেই আমরা এগিয়ে গিয়েছিলাম দিনের পর দিন। হাল ছাড়িনি।

সোনালীনিউজ : একজন নারী হয়েও আপনি থেমে থাকেননি, যুদ্ধে ঠিকই অংশগ্রহণ করেছিলেন। এতটা শক্ত মানসিকতা কোথা থেকে পেয়েছিলেন?

শাহীন সামাদ : একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতের কথা আমি এখনো ভুলতে পারি না। কখনো ভুলতে পারবও না। যতদিন বেঁচে থাকব এদিনটার কথা মনে থাকবে। ওই দিনের গুলির বিদীর্ণ শব্দ এখনো আমার কানে বাজে। চারদিকে আগুন, ধোঁয়া, থেমে থেমে গুলির আওয়াজ। আমরা সবাই ভেঙে পড়েছিলাম আগত দিনগুলোর কথা ভেবে। তারপরও মনোবল হারাইনি। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দেশের জন্য কিছু একটা করব। অস্ত্র দিয়ে না পারি, কণ্ঠ তো আছে। এই কণ্ঠ দিয়েই যুদ্ধ করব। সেটাই করেছি মহান মুক্তিযুদ্ধে। প্রেরণাদায়ী গান গেয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনীর ভাইদের সাহস জুগিয়েছি। এটা রণক্ষেত্রের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

সোনালীনিউজ : বর্তমান প্রজন্মদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা, চিন্তা-বোধ কতটুকু কাজ করছে বা দেখছেন?

শাহীন সামাদ : আমি তো মনে করি নতুন প্রজন্মদের মধ্যে স্বাধীনতার চিন্তাচেতনা পুরোপুরিই কাজ করে। ওরা এখন সবকিছুই বুঝতে পারে, অনেকটাই প্রগ্রেসিভ। ওরা যা করছে ভালো বুঝেই করছে। আমরা যদি ৪৬ বছর আগে এত কম লোকজন নিয়ে দেশ স্বাধীন করে আনতে পারি, এখন তো প্রায় ১৮-১৯ কোটির মতো লোক। তাহলে নতুন প্রজন্ম কেন পারবে না? বুঝবে না? তা ছাড়া ইন্টারনেটের যুগে তারা এখন সবকিছুই দেখছে, সচেতন হচ্ছে। আমি তো সম্পূর্ণরূপে আশাবাদী।

সোনালীনিউজ : বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে এ জাগরণের প্রভাব কতটুকু দেখছেন?

শাহীদ সামাদ : এদেশের মেয়েদের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তারা এখন অনেক বেশি অগ্রগামী। তারা সবকিছু বুঝতে পারে, স্বাধীনতার চেতনা লালন করে। বুঝে তাদেরও দেশের জন্য কিছু করা দরকার এবং তারা করছেও।

সোনালীনিউজ : মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ কি আমরা পেয়েছি?

শাহীন সামাদ : অবশ্যই পেয়েছি। আমরা আমাদের দেশকে পেয়েছি। আমাদের দেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। আমাদের নিজস্ব পাসপোর্ট আছে, আগে আমরা কয়টাইবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেতাম। আর এখন বিদেশে সরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে অনেক অনুষ্ঠান হচ্ছে। ৭১-এর পরবর্তী সেই বাংলাদেশ আর বর্তমান বাংলাদেশ অনেক পার্থক্য। আমরা এখন নিজরাই স্বয়ংসম্পূর্ণ ।

সোনালীনিউজ : মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি সব ভুলে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, বর্তমান এ দেশকে স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে হলে কী কী করণীয় বলে আপনি মনে করেন?

শাহীন সামাদ : সেই সময় আমরা ছিলাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিলেন-‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ তার সেই এক ভাষণে আমরা সব বাঙালি এক মন, এক আত্মা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম মুক্তিযুদ্ধে। সেই সময়ে পারলে এখন কেন পারব না? এখন আমরা ভালো কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা না করে খারাপ বিষয় নিয়ে বেশি আলোচনা- সমালোচনা করি। খারাপ বিষয়টাই বা কেন বেশি বেশি চিন্তা করি আমি বুঝি না। যাই ইচ্ছে হয় তাই করতে মন চায়, যেভাবেই হোক পেতে চেষ্টা করি। আমাদের সবার কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি কে? নিশ্চয় মা। মাকেই কিন্তু আমরা দেখব সবার আগে, জগতে মাকে ভক্তি না করলে কি কিছু পাওয়া যায়? আমার সোনার বাংলা, আমার মা। আমার মাকে তো আমারই শ্রদ্ধা করতে হবে, মায়ের জন্য সবকিছু করতে হবে। সবার একসঙ্গে থাকতে হবে। আমরা পারলে তোমরা পারব না কেন?

সোনালীনিউজ : স্বাধীনতা, দেশপ্রেম বিশেষ দিনগুলোতে মনে না করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের অন্তরে কীভাবে লালন করা যায়?

শাহীন সামাদ : মা-বাবা একটি সংসারের অভিভাবক। মা-বাবাদের সন্তানকে শেখাতে হবে মুক্তিযুদ্ধ কী, বঙ্গবন্ধু কী। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে, যেগুলো দেশের সঙ্গে সম্পর্কিত সে অনুষ্ঠানে, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ঘুরে দেখানো, তাহলে কিন্তু সন্তান জানতে পারবে সবকিছু। মোটকথা, মা-বাবার এখানে ভূমিকা নিতে হবে। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, নিজে মানুষের মতো মানুষ না হলে দেশ-দশের সেবা করা যায় না।

সোনালীনিউজ : সব মিলিয়ে আপনি আশাবাদী?

শাহীন সামাদ : হ্যাঁ, আমি অবশ্যই আশাবাদী। তবে সাধনা দরকার। এ নতুন প্রজন্মই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশকে আরো উচ্চাসনে নিয়ে যাবে, সেদিন আর দূরে নয় যেদিন এ দেশ হবে তোমার আর আমার সোনার বাংলাদেশ।

সোনালীনিউজ : স্বাধীনতার দিবসের প্রাক্কালে সময় দেওয়ার জন্য দেওয়ার আপনাকে ধন্যবাদ।

শাহীদ সামাদ : আপনাকে ও পাঠকদের প্রতি স্বাধীনতা দিবসের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা রইল।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!