• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একাই বিশাল বালুতটকে বানিয়েছেন ঘন জঙ্গল


নিউজ ডেস্ক জুন ২০, ২০২১, ০৫:১৮ পিএম
একাই বিশাল বালুতটকে বানিয়েছেন ঘন জঙ্গল

ঢাকা: ভারতের আসামের মিশিং উপজাতি সম্প্রদায়ের লোক যাদব। পুরো নাম যাদব পায়েং। আর ডাকনাম মুলাই। যদিও আমাদের দেশে তাকে নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি নেই তবে ভারত থেকে শুরু করে গোটা দুনিয়ায় তাকে নিয়ে একটা আবেগের ঢেউ আছে। ন্যাচার ম্যাগাজিনসহ পৃথিবীর খুব কম নামীদামি পত্রিকা আছে যাতে তার ঠাই হয় নাই। ফিল্ম, ডকুমেন্টারি এরকম বহু কিছু আছে তাকে নিয়ে। তিনি বিখ্যাত হয়ে গেছেন বন তৈরি করে। একাই তৈরি করেছেন ১৫৫ হেক্টর জমিতে বিশাল এক ঘন বন।

বনে রয়েছে বুনো জীব-জন্তু হাতী, বাঘ, হরিণ। আর তার বনায়নের কাহিনী সেদেশের বন কর্তৃপক্ষকে রীতিমত লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। কারণ সংশ্লিষ্ট লোকেদের উদাসীনতা ও জনগণের সচেতনতার অভাবে ভারত উপমহাদেশে বনের পরিমাণ কমছে দ্রুত হারে। সে জায়গায় যাদব তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায়।

১৯৭৯ সালে যখন তার বয়স মাত্র ষোল বছর, তখন পায়েং একদিন সকালে ব্রহ্মপুত্রের বালির চড়ায় শতাধিক মৃত সাপ দেখতে পান। আগের দিনের হঠাৎ আসা জলের তোড়ে এদের সেখানে এনে ফেলে। তখন সেখানে কোনও গাছ ছিলো না। প্রচণ্ড তেতে ওঠা বালির তাপে ওই সাপগুলো মারা যায়। ক্লাস টেন-এ পড়া সেদিনের কিশোরের মনে এই ঘটনা প্রচণ্ড নাড়া দিয়ে যায়, যা তার লক্ষ্য, তার জীবন সবকিছু পাল্টে দেয়। পায়েং সেদিন ছুটে গিয়েছিল বন দফতরের কাছে, আবেদন করেছিল ওখানে গাছ লাগানোর জন্য। ছুটে গিয়েছিল সাধারণ স্থানীয় মানুষের কাছেও, কেউ বলেছেন ওখানে গাছ লাগালে বাঁচবে না, কেউ বলেছে ওটা ডুবে যাবে। কেউ তাকে পাত্তা দেয় নি।

পায়েং নিজের হাতেই দায়িত্ব নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি পড়াশোনা ছাড়লেন, ঘরও ছাড়লেন, এসে উপস্থিত হলেন ওই বালির চড়ায়। প্রথম দিকে লাগাতেন শুধুই বাঁশ ও ঘাস জাতীয় গাছ। তাদের বাঁচিয়ে রাখতে নিয়মিত সকাল বিকেল পানি দিতেন। ধীরে ধীরে অন্যান্য গাছপালাও গজিয়ে উঠতে শুরু করল। তিনি সেই উদ্যমে আজও একইভাবে কাজ করে চলেছেন।

শুধুমাত্র গাছ লাগানোর মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন না যাদব। মাটিকে উর্বর রাখতে নিয়মিতভাবে উইপোকা, কেঁচো, পিঁপড়া ও কীটপতঙ্গ ছাড়েন তিনি। তার নিজের কথায়, ‘মাটির উর্বরতা বাড়াতে উইপোকা ও পিঁপড়া খুবই উপকারী। এগুলো খুব কঠিন মাটিকেও নরম করে তোলে। জীবন্ত প্রাণীর দেহকোষে উত্পন্ন জৈব রাসায়নিক পদার্থবিশেষ, যা নিজে পরিবর্তিত না হয়ে অন্য পদার্থের পরিবর্তন সাধনে সক্ষম নিঃসৃত করে রাসায়নিকভাবে মাটির পরিস্থিতিকে উন্নত করে।’

ধীরে ধীরে ১৫৫ একর জমি জুড়ে তৈরি করেন এই মানব সৃষ্ট বন। আসাম সরকার তার ডাকনাম অনুসারে এই বনের নাম দেন মুলাই বন। এ বন নানা প্রাণীর বাসস্থান, এমনকি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির একশৃঙ্গ গণ্ডার, রয়েল বেঙ্গল টাইগারও রয়েছে এই তালিকায়। নানা জাতের গাছ লাগিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন উদ্ভিদ বৈচিত্রও। শিমূল, বাঁশ, শিশু, ডিমারু, ভেলকো, পাম, গামারি, সোনারু, কৃষ্ণচূড়া, সেগুন প্রভৃতি ছাড়াও আরও অসংখ্য প্রজাতির গাছ লাগিয়েছেন সেখানে।

২০১২ সালে যাদবের এই অসামান্য ও একক অবদানের জন্য জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটি ‘আর্থ-ডে’র দিন তাকে Forest Man of India শিরোপা দেয়। ওই বছরেই ভারতের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এপিজে আব্দুল কালাম মুম্বইয়ে যাদব পায়েংকে আর্থিকভাবে পুরস্কৃত করেন।

একই বছরে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত International Forum for Sustainable Development-এর এক কনফারেন্সে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ৯০০ জন বিশেষজ্ঞের মধ্যে যাদব পায়েংও ছিলেন। Wildlife Service Award দিয়েছে Sanctuary Asia। ২০১৫ সালে পেয়েছেন পদ্মশ্রী পুরস্কার।

শুধু তাই নয় নিজের সীমানা ছাড়িয়ে তিনি এখন রাজস্থান, উত্তর ঝাড়খন্ডসহ বিভিন্ন জায়গায় গাছ লাগাতে ছুটে যাচ্ছেন। এইত কিছুদিন আগেও তিনি ঝাড়খন্ডের প্রায় ২৭০০ পোস্ট অফিসের সামনে একটি করে গাছ লাগিয়েছেন! এটা প্রতীকী।

তার দর্শন অত্যন্ত চমৎকার এবং একদমই সোজাসাপটা। তিনি মনে করেন মাটিতে বীজ ফেললে গাছগুলি নিজেই জন্মে। তিনি বলেন, প্রকৃতি এভাবেই কাজ করে আপনি এটিকে কিছুটা সহায়তা করুন এবং এটি নিজেই পালটা সহায়তা করবে।

পেশায় দুধ বিক্রি করে চলা যাদব মোলায় পিয়াং জংগলের মধ্যে ২০০ টি গাভী পালেন। সবচেয়ে অবাক তথ্য দুধ বিক্রির এই টাকা দিয়ে তিনি নিজেরসহ ৩০০ আদিবাসী পরিবার চালান। এই পরিবার গুলোর আয়ের একমাত্র উৎস যাদব।

বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে যাদব মোলায় পিয়াং নিজেকে সুখী মানুষ এবং প্রকৃতির পাহারাদার বলে দাবী করেন।

যাদব মোলায় পিয়াং আবার একটি বই নিয়ে কাজ করছেন। যার লক্ষ্য হচ্ছে শিশুদের বর্তমান সময়ে গাছ লাগানোর প্রক্রিয়া এবং গুরুত্ব শেখানো। এই ফরেস্ট ম্যান আজও নিজের এই জংগলে গাছ লাগিয়ে যাচ্ছেন। এবং এও বলেছেন যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত তিনি এ কাজ চালিয়ে যাবেন।

তার স্বপ্ন, অরণ্যটি প্রথমে মাজুলি, তারপর কমলাবাড়ি হয়ে একদিন ডিব্রুগড় জেলার সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছেন ‘ফরেস্ট ম্যান’ মোলাই পায়েং। পুরস্কার হিসেবে পাওয়া সমস্ত অর্থ তিনি ব্যয় করছেন বনসৃজনের জন্য। জঙ্গল লাগোয়া আরও ৫০০০ একর বন্ধ্যা জমিকে অরণ্যের রূপ দান করবেন যাদব।

সূর্যের শেষ রশ্মি যখন কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদায় নেয়, তখন যাদব পায়েং-এর সাইকেল ছোটে উল্টো পথে। আবার সাইকেল-নৌকা-সাইকেল পর্ব মিটিয়ে বাড়ি ফেরেন যাদব।

রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি বিছানায় যান যাদব। কাকভোরে উঠতে হবে যে! বিছানায় শুয়ে যাদব মনে মনে হিসাব করেন আগামীকাল কতটা জমিতে কতগুলি চারা লাগাবেন। একসময় সবুজ যোদ্ধার সবুজ দুটি চোখে নেমে আসে ঘুম। সত্যিই ঘুমোন, না কি সবুজের স্বপ্নে বিভোর হয়ে সবুজ ভোরের জন্য জেগে থাকেন ভারতের ‘ফরেস্ট ম্যান’ যাদব মোলাই পায়েং!

সোনালীনিউজ/আইএ

Wordbridge School
Link copied!