• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পরিত্যক্ত জালে মারা যায় অধিকাংশ ডলফিন


নিজস্ব প্রতিবেদক সেপ্টেম্বর ১১, ২০২১, ০৩:০৭ পিএম
পরিত্যক্ত জালে মারা যায় অধিকাংশ ডলফিন

ঢাকা : এ বছরের ১ আগস্ট চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী থেকে একটি মৃত ডলফিন উদ্বার করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির দল। ডলফিনটির মুখে জড়ানো ছিল জাল। পরে ময়নাতদন্ত করে জানা যায়, মুখে জাল জড়িয়ে শ্বাসনালি বন্ধ হওয়ায় এর মৃত্যু হয়েছে।

আগস্টে পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় মুখে জাল জড়ানো অবস্থায় আরো বেশ কয়েকটি মৃত ডলফিন পাওয়া যায়। এদিকে সারা দেশে জুলাইয়ে ১০টি ও আগস্টে ১৩টি মৃত ডলফিন পাওয়া গেছে।

ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) হিসাবে, বাংলাদেশের জলসীমায় ২০০৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ২৫০টির মতো সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর মৃত্যুর রেকর্ড রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই ডলফিন।

ডব্লিউসিএসর কান্ট্রি রিপ্রেজেনটিটিভ ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সমুদ্রে যেসব প্রাণির অকাল মৃত্যু হয়, এদের মধ্যে ডলফিনের সংখ্যা বেশি। এর মূল কারণ জেলেদের ফাঁস জাল। শুধুমাত্র এই জালেই ৬৫ শতাংশ সামুদ্রিক প্রাণির মত্যু হয়। এ ছাড়া বিহুন্দি জাল ও সমুদ্রে চলন্ত ফিশিং বোটের আঘাতও ডলফিনের মৃত্যুর কারণ। অবহেলার কারণে জেলেদের মাছ ধরার যেসব জাল সাগরে ও সৈকতে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে দেওয়া হয়, সেগুলোতে জড়িয়ে প্রতি বছর সাগরে ও নদীতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সামুদ্রিক প্রাণী, যেমন-ডলফিন, হাঙর, সামুদ্রিক কচ্ছপ, তিমি, কাঁকড়া ও সামুদ্রিক পাখির মৃত্যু হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন ভূতুড়ে জাল একটি বৈশ্বিক সমস্যা; তবে সমপ্রতি বঙ্গোপসাগর ও দেশের নদীগুলোতে সমস্যাটি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।

চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন উপকূলে গত ২০ বছর ধরে মাছ ধরেন ছালেহ আহমদ। তিনি বলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে একটা পিঁপড়াও আমরা মারি না। কিন্তু অনেক সময় সমুদ্রে চলন্ত ফিশিং বোটের আঘাতে বা জেলেদের জালে পেঁচিয়ে ডলফিনের মৃত্যু হয়। ডলফিন জালে জড়িয়ে গেলে অনেক সময় জাল রক্ষা করার জন্য সেগুলোকে মেরে ফেলতে হয়, অথবা জাল কেটে দিতে হয়। পরে জাল ছাড়াতে না পেরে সাগরেই ওগুলোর মৃত্যু হয়। কুয়াকাটায় ডলফিন নিয়ে কাজ করছে ওয়ার্ল্ড ফিশ সেন্টার।

ডলফিনের সঙ্গে এ কেমন নিষ্ঠুর আচরণ : কক্সবাজার সৈকতে আসা অতিথি ডলফিনের সঙ্গে এ কেমন নিষ্ঠুর আচরণ প্রকৃতির শুদ্ধতায় কক্সবাজার সমূদ্র সৈকতে বেড়াতে আসা ডলফিনের দলকে এভাবেই মারা পড়তে হচ্ছে মানুষের হাতে

করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্ব থমকে গেলেও নতুন করে জেগে উঠেছে যেন পরিবেশ। নতুন করে, আপন মনে সেজে উঠছে প্রাণ ও প্রকৃতি। সারা বিশ্বেই দেখা যাচ্ছে এ চিত্র। বাদ নেই বাংলাদেশও।

করোনার কারণে ভ্রমণ নিষিদ্ধ হওয়ায় কক্সবাজার সমূদ্র সৈকত এখন পুরোপুরি পর্যটকশূন্য। সেখানে এখন নেই পরিবেশ দূষণ। নেই কোলাহল। কক্সবাজার সমূদ্র সৈকত যেন ফিরে পেয়েছে নতুন প্রাণ। সমূদ্রের পানি গাড় নীল। তাতেই সপ্তাহ খানেক আগে ভেসে বেড়াতে দেখা গেছে ডলফিনের দলকে।

পর্যটকশূন্য কক্সবাজারে যখন ডলফিন দলের খেলার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল। কক্সবাজার সৈকতে ডলফিনের বিচরণ দেখে দেশের পর্যটনকে নতুনভাবে সাজানোর কথাও উঠে আসছে নানা মাধ্যমে। ঠিক তখনই সৈকতে অতিথি হিসেবে আসা এই ডলফিনদেরকেও রেহাই দিলো না কিছু অমানুষ।

কক্সবাজারের টেকনাফের শাপলাপুর সৈকতে প্রথমে একটি ডলফিনকে তুলে হত্যার অভিযোগ ওঠে স্থানীয় জেলেদের বিরুদ্ধে। প্রথমদিন একটি ডলফিনকে পিটিয়ে মারার অভিযোগ আসার পরদিন দেখা যায়, সৈকতে আরও দু’ থেকে তিনটি ডলফিন মৃত পড়ে আছ।

মুহূর্তেই মৃত ডলফিনের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। মৃত ডলফিনগুলোর শরীরে দেখা যায় আঘাতের চিহ্ন। একটি ডলফিনের লেজের দিকে মোটা রশিও বাধা ছিল। কিন্তু কে বা কারা এই ডলফিনগুলোকে মেরেছে, সেটা রয়ে গেছে অজ্ঞাত।

মাছ ধরার জালে আটকা পড়লে জেলেরা ডলফিনগুলোকে পিটিয়ে মেরেছে বলে মিডিয়াকে জানিয়েছেন স্থানীয় পরিবেশকর্মী সেভ দ্য ন্যাচার অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন রিয়াদ।

মারাত্মক দূষণের কারণে কক্সবাজার সমূদ্র সৈকতে ডলফিনের দেখা পাওয়া ছিল দুঃস্বপ্নের মত। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের পদচারনা এবং দূষণের কারণে ডলফিন সৈকতের আশ-পাশেও ঘেঁষতো না কয়েক দশক। পরিবেশবাদীরা বলছে, অন্তত ৩০ বছর কক্সবাজারের সৈকতে ডলফিনের দেখা মেলেনি।

কক্সবাজার সৈকতে আসা অতিথি ডলফিনের সঙ্গে এ কেমন নিষ্ঠুর আচরণকক্সবাজার সৈকতে আসা অতিথি ডলফিনের সঙ্গে এ কেমন নিষ্ঠুর আচরণ

কিন্তু করোনায় লকডাউনের কারণে কক্সবাজার এখন পুরোপুরি পর্যটকশূন্য হওয়ার কারণে পরিবেশটাও বদলে গেছে। কলাতলি বিচ পয়েন্টের গাড় নীল পানিতে তাই দুই দলে অন্তত ২০ থেকে ২৫টি ডলফিনকে দেখা গেলো মনের আনন্দে ডুব-সাঁতার খেলতে। যেখানে ছিল গোলাপি রংয়ের দুর্লভ প্রজাতির একটি ডলফিনও।

কিন্তু সৈকতে অতিথি হয়ে আসা এসব ডলফিনের অবাদ বিচরণের ভিডিও প্রকাশের এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হলো তাদেরকে। জেলেদের জালে আটকে পড়ার পর যেখানে তাদেরকে অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে দেয়ার কথা, সেখানে নিষ্ঠুর কায়দায় রশি লাগিয়ে পিটিয়ে মারা হলো।

কক্সবাজারের বণ্যপ্রাণী গবেষক নাদিম পারভেজ জানান, গত দুই মাসেই অগভীর সমূদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে জেলেদের জালে আটকা পড়ে কিংবা ট্রলারের পাখায় আঘাত লেগে অন্তত ১১টি ডলফিন মারা গেছে। অধিকাংশ ডলফিনের গায়েই জালে আটকে পড়ার চিহ্ন ছিল।

কক্সবাজারের পরিবেশ সংরক্ষণ কর্মীরা জানান, গত শুক্র, শনি ও রোববার- এই তিনদিনে তিনটি ডলফিনকে মারা হয়েছে কক্সবাজারের বিস্তীর্ণ সৈকত এলাকায়।

শনিবার মৃত একটি ডলফিনের ছবি ফেসবুকে শেয়ার করেন স্থানীয় যুবক জালাল উদ্দিন চৌধুরী। তিনি মিডিয়াকে জানান, জালে আটকা পড়ায় জালেরা সেটি সৈকতে এনে ফেলে দেয়। ডলফিনটি অনেক বড় এবং তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। সন্ধ্যা থেকে ডলফিনটি আর দেখা যাচ্ছে না বলেও জানান তিনি।

কক্সবাজারের পরিবেশকর্মী, সেভ দ্য ন্যচার অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন রিয়াদ জানান, শাপলাপুরে যে ডলফিনটা উদ্ধার করা হয়েছে, সে ডলফিনের মাথায় বিশাল ক্ষত এবং লেজের দিকে যে রশি দিয়ে বাধা হয়েছিল কিংবা কিছুতে আটকে ছিল, তা ক্ষত দেখেই প্রতীয়মান হয়।

মোয়াজ্জেম হোসেন আরও জানান, নানা টোটকা ওষুধের জন্য ডলফিন হত্যা করে তার মাংস ও হাড় নিয়ে যায় জেলেসহ একটি চক্র। এ ডলফিনগুলোকেও সে কারণে মারা হতে পারে বলে ধারণা করছেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি এও জানান, প্রশাসনকে জানানো হলে ডলফিনটি মাটি চাপা দেয়া ছাড়া আর কোনো তৎপরতা দেখায় না তারা। বিচার না হওয়ার কারণেই সামুদ্রিক প্রাণী হত্যার হার বাড়ছে।

কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা দোষিদের বিরুদ্ধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে মিডিয়াকে জানানি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যদি এ সম্পর্কে যদি কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা যায়, তাহলে যে সমস্ত জেলে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

কক্সবাজারের জেলা মৎস কর্মকর্তা এসএম খালেকুজ্জামান বলেন, ‘যেহেতু এই ডলফিনগুলো আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেছে, সেটা জেলেদের কারণেও হতে পারে, আবার প্রাকৃতিক কারণেও হতে পারে।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশেনোগ্রাফি বিভাগের অধ্যাপক মোসলেম উদ্দিন মুন্না শঙ্কা প্রকাশ করেন, এমন চলতে থাকলে তা হবে পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশের যে বন্ধু, সমূদ্রের যে বন্ধু- ডলফিন, যেগুলো আমাদেরকে সু-বার্তা দিচ্ছিল, সেগুলো যদি এভাবে মারা পড়ে, তাহলে সেটা কিন্তু আমাদের জন্য অশনি সঙ্কেত।’

সমূদ্র পরিবেশের বন্ধু ডলফিন রক্ষর জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান এই সমূদ্র বিশেষজ্ঞ। অধ্যাপক মোসলেম উদ্দিন মুন্নাা বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে ডলফিনের যে ইকোলোকেশন পদ্ধতি, সেই ইকোলোকেশন পদ্ধতিতে তারা সাউন্ড দিয়ে কম্যুনিকেট করে। সে সাউন্ড ফ্রিকোয়েন্সি ইউজ করে তাদেরকে কিন্তু লোকেট (অবস্থান নির্ণয়) করা যায়, অথবা এভাবে তাদের গতিবিধিও এখন ফলো করা হচ্ছে। যে কেনো পর্যায়ে সেই উন্নতি পদ্ধতি ব্যবহার করে হলেও আমাদের বঙ্গোপসাগরে এই ডলফিনকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ বলে আমি মনে করি।’

জেলেদের প্রতি পরামর্শ দিয়ে কক্সবাজার জেলা মৎস কর্মকর্তা এসএম খালেকুজ্জামান বলেন, ‘জেলেদের প্রতি আমাদের পরামর্শ এই যে, যখনই আপনাদের জালে ডলফিন ধরা পড়বে, তৎক্ষণাৎ জাল উঠিয়ে তাকে মুক্ত করে দিতে হবে খুব সাবধানতার সঙ্গে। এমনভাবে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যে, তাকে সুন্দরভাবে কোলে নিয়ে মাথায় এবং লেজে হাত বুলিয়ে তাকে পানিতে ছেড়ে দিতে হবে। জেলেদের প্রতি এই পরামর্শ আমরা সব সময় দিয়ে থাকি।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!