• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তারুণ্যের ভাবনায় ভাষার মাস


সানাউল্লাহ আল ফাহাদ ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২১, ০৬:৪৪ পিএম
তারুণ্যের ভাবনায় ভাষার মাস

প্রতিনিধি

জবি : বাংলাদেশের ইতিহাসে ফেব্রুয়ারি মাস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাণ দিয়েছিল এদেশের তরুণ ছাত্রসমাজ ও জনতা। তাদের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। বাঙালি জাতির কাছে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রেরণার মাস ফেব্রুয়ারি। প্রাণের ভাষাকে তরুণ প্রজন্ম আজও ভালোবাসে, অনুভব করে মন থেকে।

ভাষার মাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভাবনা ও প্রত্যাশা তুলে ধরেছেন সানাউল্লাহ আল ফাহাদ-

নাঈম রাজ
নাট্যকলা বিভাগ, চতুর্থ বর্ষ।

ভাষা একটা জাতিসত্তার বহিঃপ্রকাশ। বাংলা ভাষা শুধুমাত্র আমাদের মাতৃভাষায় নয় এটি আমাদের অস্তিত্বের মেরুদণ্ড। প্রতিটি ভাষায় চলমান স্রোতের মতোই খরস্রোতা হলেও ভাষার একটা নিজস্ব তাল, লয়, ছন্দ থাকে। যেগুলো সচেতন ভাবে ব্যবহার না করলে এবং যত্ম করা না হলে ভাষার আসল সত্ত্বার গন্ধ কালের মালা বদলে বিলিন হয়ে যাবে। এতো রক্ত, এতো সংগ্রাম, এতো ত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করা আমাদের মাতৃভাষা আজ সীমান্তরেখা পেরিয়ে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে যার সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে, সে তো অমূল্য রতন! অহংকারের বসন। ভাষার মাসে আমার এতোটুকুই আহ্বান আসুন বাংলা ভাষার সঠিক চর্চা ও ব্যবহার করি।

জয়ন্তী জয়া 
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, দ্বিতীয় বর্ষ। 

প্রতিবছর ভাষা আন্দোলনের বেদনা বিধুর স্মৃতি ও সংগ্রামী চেতনার অমিয় ধারা কে বহণ করে গৌরবোজ্জ্বল একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের দ্বারে ফিরে আসে। ভাষা আন্দোলনের মতো বিশেষ ঘটনা ও ভাষার জন্যে সালাম, জব্বার, রফিক, শফিকদের আত্মত্যাগ সুদূর প্রসারী তাৎপর্য বহণ করে আমাদের জীবনে। এই তাৎপর্য কোন নির্দিষ্ট জাতি কিংবা ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং তা সকল সীমানা পেরিয়ে আজ সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন স্রোতে বিশ্বায়িত। বাংলা' শুধু একটি ভাষা নয়, বাংলা জুড়ে আছে আমাদের আবেগ, অনূভূতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংগ্রাম। বর্তমান আধুনিক সভ্যতা আর পশ্চিমা সংস্কৃতির করাল গ্রাসে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে বাংলা ভাষার মর্যাদা। আমাদের ভাষা শহীদরা যে চেতনা বুকে ধারণ করে ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগ করেছিল, তার কতোটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, সঙ্গত কারণেই এ প্রশ্ন আজ জাতির কাছে। ১৯৫২ সালের পর থেকে ভাষা দিবস পালিত হলেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হয়েছে কি? উচ্চ আদালত ও প্রশাসনসহ সর্বত্র এখন ইংরেজির দাপট চলতে দেখা যায়। বর্তমান অভিবাবকরা তাদের ছেলে মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করতে রীতিমতো যুদ্ধ করে। অথচ অবজ্ঞা করে বাংলা ভাষা, যা অর্জিত হয়েছে তাজা প্রাণের রক্তের বিনিময়ে। কত বুক খালি হয়েছে শুধু ভাষার জন্যে। কিন্তু আফসোস! আমরা তার দাম দিতে পারিনি। একুশ আমাদের জাতীয় মুক্তির চেতনার উৎস হিসাবে কাজ করেছে। আমাদের মহান একুশ আজ স্বদেশের আঙিনা পেরিয়ে বৈশ্বিক চেতনায় পরিণত হয়েছে। নিজেদের ইতিহাসকে ও ভাষার ঐতিহ্যকে আপন করে নিয়ে বর্জন করতে হবে বিকৃত অপসংস্কৃতিকে। নতুন প্রজন্মকে বিশ্বায়িত করার সাথে সাথে তাদের আপন ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপারেও সচেতন করে তুলতে হবে প্রতিনিয়ত। ফেব্রুয়ারিতে অঙ্গীকার হোক বিশ্বের বুকে মায়ের ভাষাকে সমুন্নত রেখে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার। একুশের চেতনাকে সবার মধ্যে সঞ্জীবিত করার মধ্যেই নিহিত আছে এই মহান দিবসের সার্থকতা।

জুনায়েদ সাব্বির
রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ, চতুর্থ বর্ষ।

ফেব্রুয়ারী নিঃসন্দেহে বাঙালি জাতির এক গৌরবময় ও ঐতিহ্যের মাস। আমাদের জাতীয় জীবনে সকল চেতনার উৎস এই মাসটি। প্রতি বছরই আমরা গেয়ে থাকি 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী' বাঙালিই এক মাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। এটি আমাদের বাঙালি জাতির অত্যন্ত গর্বের ও আনন্দের। বাঙালির রক্তঝরা এই একুশে  ফেব্রুয়ারি বর্তমানে সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করেছে। তবে এটিও বলার অপেক্ষা রাখেনা যে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলা ভাষার প্রতি অবমাননা দিন দিন বেড়েই চলেছে আমাদের দেশে। পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে, ব্যানারে মানা হচ্ছেনা বানানরীতি। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে বাংলার পরিবর্তে ইংরেজিকেই দেয়া হয় অধিক গুরুত্ব। একজন বাঙালি নাগরিক হিসেবে আমার প্রত্যাশা বাংলা ভাষার প্রতি সকল অবহেলার অবসান ঘটুক।

ঋতু সাহা 
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, দ্বিতীয় বর্ষ।

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকার রাজপথে জীবন উৎসর্গ করা স্মৃতি বাঙালির মনে এই মাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই মাসে রাজপথে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে দুর্বার আন্দোলনের জব্বার, রফিক, বরকত ও রফিক সহ আরো অনেকে বাঙালি রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পেয়েছে মাতৃভাষার মর্যাদা। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' ঘোষণা করে। এর মধ্যে দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয়। তাই এত কিছুর মধ্যে আমরা যেই ভাষা পেয়েছি আমাদের সেই ভাষাকে তা সঠিক মর্যাদা দেওয়া উচিত।

ভাষার গুরুত্ব তার ব্যবহারে; জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়ানো উচিত। সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালতে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলার ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তাই বাংলা সংবাদ মাধ্যমগুলোতে নিত্যব্যবহার্য ভোগ্য পণ্যের বিজ্ঞাপন ইংরেজি ভাষায় না করে বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞাপনও প্রচার করা উচিত। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার সব স্তরে বাংলা ভাষা শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া দরকার। এসব বিষয়ে চিন্তাভাবনা এই ভাষার মাসেই শুরু হোক।

মো: শাহারিয়ার 
উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, দ্বিতীয় বর্ষ।

বাংলাদেশ আমার, মা আমার বাঙালি। বাংলা আমার মায়ের ভাষা। ২১শে ফেব্রুয়ারি  আমাদের গৌরবের, এটা আমাদের প্রত্যয় ও প্রত্যাশার। তদানীন্তন পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকেও উর্দুর সাথে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিশেষ করে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। এরপর গৌরবময় ৬৮টি বছর পেরিয়ে গেছে। রাজনৈতিক বহু পটপরিবর্তন হলেও একুশের শিক্ষা আজও আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক ও কার্যকর। একুশকে আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে আবারও সদা সচেষ্ট থাকবো। বাংলা ভাষা  এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এখানে আর রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমস্যার প্রশ্নই ওঠে না। তবু আজ প্রত্যেকে নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করেন ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে কতটুকু? সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন তো নেইই, বরং অবস্থা দেখে আশঙ্কা হয়, ইংরেজী ভাষার দাপটে স্বদেশেই বাংলা ভাষার কি হবে। তাই এখনই আমাদের  সবাইকে  ১৯৫২, একুশের পথ ধরে আমাদের নিজস্ব ধারায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ ঘটাতে হবে এবং শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা করতে হবে।

নাদিয়া সুলতানা 
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, প্রথম বর্ষ। 

পৃথিবীতে ভাষার লড়াইয়ে এমন রক্ত ক্ষরণের ইতিহাস রচনাকারী মাতৃভাষার অধিকার লড়াইয়ের বিপ্লবী জাতি হলাম একমাত্র আমরা যা ভাবতেই গর্বে বুক ফুলে ওঠে। তবে এতো কষ্টের অর্জিত এই রত্নসম মাতৃভাষার যথার্থ সম্মান দিতে আমরা বেশিরভাগ বাঙালিই অক্ষম। আজকাল আমাদের মধ্যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি-প্রেমের পাশাপাশি পাশ্চাত্য ভাষার প্রতিও মোহ প্রবলভাবে লক্ষনীয়। তরুণ প্রজন্ম ইংরেজিতে কথা বলাটাকেই একমাত্র তথাকথিত "স্মার্টনেস" বলে জ্ঞান করছে আর বাংলায় কথা বললে ভাবছে সেটা তথাকথিত "ক্ষ্যাত" মানসিকতার পরিচায়ক, যা বাংলা ভাষার পক্ষে যথেষ্টক অপমানজনক এবং দুঃখজনক বলে মনে করি। শুধুমাত্র আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়ে বাংলা ভাষা তার স্বকীয়তা-নিজস্বতা হারাচ্ছে, তরুণ প্রজন্মের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে "বাংলিশ" নামক এক আশ্চর্য জগাখিচুরি ভাষা। অথচ আমরা এটা ভুলে যাচ্ছি যে নিজস্ব ভাষাকে সম্মান জানাতে না পারলে পৃথিবীর সব ভাষায় পারদর্শী হলেও দিনশেষে ভাষাজ্ঞানে "শূন্য" ছাড়া আর কিছুই জোটার নয়। এ অবস্থা থেকে উদ্ধার হতে সবাইকে বিশেষ করে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে নিজস্ব ইতিহাস-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে হবে। স্ব-আদর্শ আগে ধারণ করতে হবে, বিদেশি-সংস্কৃতির প্রতি অন্ধ মোহে আবদ্ধ হওয়া চলবে না। মায়ের ভাষা মুখের ভাষা প্রাণের ভাষা বাংলাই হোক সবার আগে আমাদের সুখ-দুঃখ আনন্দ অনুভূতির প্রকাশক, যেই ভাষাকে আনতে গিয়ে শহীদ হয়েছে লক্ষ লোক। নিরবচ্ছিন্ন সুন্দর বহমান নদীর মতো প্রাণোচ্ছল এই বাংলা ভাষাকে আমরা মিশ্রতায় কলুষিত করবো না, আমাদের মহান শহীদদের মহান ত্যাগকে অসম্মান করবো না। শুধুমাত্র ভাষার মাসেই ভাষাকে সম্মান জানিয়ে থেমে যাবো না। বাংলা হোক আমাদের হৃদয়ের সুর, আমাদের মুখে প্রাণ পাক  চির অমলিন এই প্রাণের মাতৃভাষা।

সোনালীনিউজ/এমএএইচ

Wordbridge School
Link copied!